‘‘জয় বাংলা’’-বাংলার জয়

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে জয়ী সাংসদদের লোকসভায় শপথ গ্রহণের সময় পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত অধিকাংশ সাংসদ বাংলায় শপথ গ্রহণ করেন ও শপথের আগে বা পরে তাঁরা বিভিন্ন জয়ধবনিসূচক শব্দবন্ধও উচ্চারণ করেন৷ যদিও নিয়মানুযায়ী শপথের জন্যে নির্দিষ্ট বয়ানের অতিরিক্ত শব্দবন্ধগুলি সংসদের রেকর্ডে নথিবদ্ধ হয় না, তথাপি ওই জয়ধবনিগুলির মাধ্যমে বক্তার মানসিক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশটি অবশ্যই লক্ষ্যণীয়৷ ওইসকল শব্দবন্ধগুলিতে যেমন পৌরাঢ়ণিক দেব-দেবী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত জয়ধবনি ও ভারতমাতার নামে জয়ধবনি ছিল, ঠিক তেমনি ছিল জয়হিন্দ,বন্দেমাতরম্, জয় বাংলাও৷ কার্য-কারণ পরম্পরা যা-ই হোক না কেন, সংসদকক্ষে বাংলার নামে জয়ধবনি বড় একটা শোণা যায় না---সেদিক থেকে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা৷ সমাজ জীবনে  কিছু ঘটনা এমনভাবে ঘটে যায় যার জন্যে হয়ত আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি না--- কিন্তু সময়ের দাবী মেনেই সেই ঘটনা প্রবাহ আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এসে উপস্থিত হয়৷

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাক্রম পশ্চিমবঙ্গে হিংসা ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে৷ খুন জখম, এলাকা দখল, বাড়ি ঘর ভাঙচুর,  অন্যদলের কার্র্য্যলয় দখল, এমনকি পুলিশ প্রশাসনের লোকজনের ওপরেও হামলার ঘটনা ঘটছে৷ সবকিছু মিলিয়ে চরম অশান্তির পরিবেশ৷ নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকে৷ কিন্তু নির্বাচনোত্তর এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বাঙলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে কোনভাবেই মানানসই নয়৷ বাঙালী স্বভাবগত ভাবেই অতিথিবৎসল৷ অতিথি অভ্যাগতকে সাদর অভ্যর্থনা ও ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ করার মানসিকতা বাঙালীর জাতিগত বৈশিষ্ট্যের অঙ্গ হিসেবেই স্বীকৃত৷ অবশ্য বাঙালীর এই উদার মানসিকতার সুযোগ নিয়ে কিছু সুবিধাবাদীর দল বাঙলা ও বাঙালীর ক্ষতি সাধনে সদা তৎপর৷ অতীতে এই সুযোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা, আর একইভাবে বর্তমানে নিয়ে চলেছে হিন্দিসাম্রাজ্যবাদী মহল৷ পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যে বাঙালীদের কোণঠাসা ক’রে অবাঙালীদের দাপট, শিল্প কারখানায় অবাঙালী শ্রমিকদের ঢালাও অনুপ্রবেশ, শহরে নগরে বিপুল অর্থের বিনিময়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি করায়ত্ত করা ইত্যাদির মাধ্যমে  গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে বাঙালীকে ক্রমশঃ সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চক্রান্ত একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনারই অঙ্গ৷ এই চক্রে কেন্দ্রীয় প্রশাসক গণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃহৎ পুঁজিপতি ও শিল্পপতি গোষ্ঠী৷ তারা জানে, বাঙালীকে দুর্বল করতে হলে, তাদের ভূমিহীন ও জীবিকাহীন করতে হবে---তখন আশ্রয় ও অন্নচিন্তাতেই তারা ব্যস্ত থাকবে আর প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে একূল ওকূল  দুই-ই হারাবে৷ ফলে, তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না, বিপ্লব বা আন্দোলনও  সেভাবে দানা বাঁধবে না৷ আবার এই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও৷ তাদের দলীয় অগ্রাধিকারকে সামনে রেখে  নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস চালিয়ে যায়৷

ব্রিটিশ রাজত্বকাল থেকেই বাংলা ও বাঙালী শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে চলেছে৷ সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাঙলাকে শোষণ করে  ব্রিটিশ রাজশক্তি নিজেদের রাজকোষ পূর্ণ করেছে, আর বাঙালীর গোলা ভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, ফলে ভরা বাগান,শস্যেপূর্ণ জমি ধীরে ধীরে খালি হতে হতে একেবারে শূণ্যে নেমে এসেছে৷ বাঙলার কুটির শিল্পকে ধবংস করে এদেশকে ব্রিটেনের তৈরি পণ্যের বাজারে পরিণত করা হয়েছে৷ ইংরেজদের চক্রান্তে বাঙলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি,ঐতিহ্যের ওপর এসেছে প্রবল আঘাত৷ অপরদিকে তৎকালীন হিন্দিওয়ালাদের নেতৃত্বে চলা জাতীয় কংগ্রেসে বাঙলার নেতৃবৃন্দকে দ্বিতীয় সারিতেই থাকতে হত৷ কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাংঘটনিক ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার করে শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রথমবার কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে মেনে নিলেও দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরেও  হিন্দিওয়ালাদের অসহযোগিতা ও চক্রান্তে সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়৷ শুধুমাত্র বাঙালী হওয়ার কারণেই তাঁকে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল৷ ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীর স্বার্থে সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বরাজ৷ কিন্তু দুর্র্ভগ্যের বিষয় এই যে, ওইসব উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদলোভী, স্বার্থপর, হিন্দি ও উর্দুওয়ালা নেতৃত্বের জন্যেই ভারতবর্ষকে দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে দুইটি রাষ্ট্রে ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করা হল,আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে ভয়ঙ্কর এক বৃষবৃক্ষ রোপন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলো৷ শুধু তাই নয়, পূর্ব সীমান্তে বাঙলা ও পশ্চিম সীমান্তে পঞ্জাব দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ফলে লোক বিনিময়ের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর (হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই) রক্তের নদী বয়ে যায়৷ কোটি কোটি মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হল৷ প্রতিশ্রুতি মতো পঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের জন্যে সম্পূর্ণ পুনর্বাসন সুসম্পন্ন হলেও বাঙালী উদ্বাস্তুরা উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন৷ তারা আশ্রয় পেলেন বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরের অমানবিক পরিবেশে, নয়তো বনে-বাদাড়ে, সুন্দরবন অঞ্চলে৷ অর্থাৎ বাঙালীরা সেই শোষিত,বঞ্চিত, উৎপীড়িতই রয়ে গেলেন৷ এই বাঙালীরাই স্বাধীনতা সংগ্রামে সকলের চেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল, ফাঁসিতে বা গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল৷

স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বৃহত্তর বাংলার ভূমিখণ্ড কেটে অসম,  বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড), ওড়িশা ইত্যাদি প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত  করে দেওয়া হয়, যার মধ্যে ছিল উন্নত খনিজ অঞ্চল ও উর্বর কৃষিজমি৷ বাঙালী  অধ্যুষিত যে অঞ্চলগুলি অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হ’ল সেখানকার বাঙালীদের মাতৃভাষা পঠন-পাঠনের সুযোগ ধীরে ধীরে কমতে কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে৷ জনগণনার সময় তাদের মাতৃভাষাকে জোর করে বাংলার পরিবর্তে সেইসব রাজ্যের ভাষা হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে৷ ফলে সরকারী দস্তাবেজে সেইসব অঞ্চলে বাঙালীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ সেইসঙ্গে চলতে থাকল নানাবিধ  আর্থিক, সামাজিক, মানসিক নির্যাতন৷  এইভাবে বাঙালীরা ক্রমশঃ ভূমিহীন, মাতৃভাষাহীন  এক দুর্বল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে থাকল৷ অবশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গে চলতে লাগল বিভিন্নভাবে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ওপর অবদমন---শিক্ষায় সংস্কৃতিতে হিন্দির অনুপ্রবেশ ও  আগ্রাসন৷ উচ্চতর শিক্ষা ও চাকুরীতে  তাৎক্ষণিক সুবিধার আশায় বাঙালীরা বাংলা বিদ্যালয় ছেড়ে হিন্দি বা ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষায়তনে যোগ দিতে অধিক আগ্রহী হ’ল৷ এইভাবে ধারাবাহিক আগ্রাসনের দ্বারা বাংলাভাষাকে দুর্বল করার চেষ্টা চলেছে৷ কোন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আক্রান্ত ও দুর্বল হলে সেই জাতিটাই হীনন্মন্যতা ও ভীতন্মন্যতায় ভোগে, আর আত্মমর্যাদা বা আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে৷ আজকের বাঙালীর অবস্থা হয়েছে ঠিক এইরকম৷ পশ্চিমবঙ্গকে ভাঙার অপর একটি প্রচেষ্টা চালু রয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে৷ পশ্চিমবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অংশ দার্জিলিংকে গোর্খাল্যাণ্ড করবার অপপ্রয়াসে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বার্র্থন্বেষী গোষ্ঠী৷ নেপাল থেকে চা শ্রমিক হিসেবে ও অন্যান্য জীবিকার সন্ধানে অনুপ্রবেশকারী বিদেশী গোর্খারা দার্জিলিং ও সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস শুরু করে৷ সেই অঞ্চলের মূল অধিবাসী লেপচা- ভূটিয়াদের দাবিয়ে রেখে লক্ষ লক্ষ নেপালী অনুপ্রবেশকারী বেআইনীভাবে গোর্খাল্যাণ্ডআন্দোলন সংঘটিত করেছে৷ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার প্রথমে ‘‘দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল’’ ও পরে ‘‘গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল অথরিটি’’-র মাধ্যমে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে  রাখার চেষ্টা করে৷ কিন্তু গোর্খাদের মূল দাবী হল ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ রাজ্য ঘটন করা ও পরবর্তী পর্যায় সেটি হয়তো ‘গোর্খাল্যাণ্ড রাষ্ট্র’ ও হতে পারে৷ যাইহোক গোর্খাল্যাণ্ড হয়তো একদিন উত্তরপূর্বের কশ্মীরে পরিণত হবে--- কারণ এর চতুর্দিকে রয়েছে চীন, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাঙলাদেশ ইত্যাদি প্রতিবেশী রাষ্ট্র যাদের অনেকের সঙ্গেই ভারতবর্ষের সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়৷ এছাড়া এন.আর.সি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর নামে অসম থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালীকে বিতাড়নের অপচেষ্টা চলেছে যার শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে৷ পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বাঙালীকে আরও পর্যুদস্ত করার জন্যে অন্যান্য রাজ্যেও এন.আর.সি চালু হওয়ার  সম্ভাবনার কথাও শোণা যাচ্ছে৷ অর্থাৎ বাঙালী জাতিটাকেই ধবংস করে দেওয়ার এক সুগভীর চক্রান্ত৷ এই চক্রান্তে সামিল রয়েছে এক দিকে হিন্দি পুঁজিপতি মুনাফাখোরদের দল, অন্যদিকে একশ্রেণীর হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী মদতপুষ্ট রাজনৈতিক শক্তি৷ ভারতের স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্গত হয়েও  পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও অবদমিত হয়ে চলেছে, যথোচিত উন্নয়ন বা প্রাপ্য সম্মানের দিক থেকেও অবহেলিত হচ্ছে৷

এমতাবস্থায় সংসদের ভিতরে ও বাইরে ‘জয়বাংলা’ শব্দবন্ধের ব্যবহার যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ৷ ‘জয় বাংলা’ শব্দবন্ধের দ্বারা কোন খন্ডিত বাংলা নয়,কোন সম্প্রদায়-জাত-পাত বা গোষ্ঠীভেদ নয়, সমগ্র বাঙালী জাতিসত্তার জয়ই উদ্ঘোষিত হয়৷ এই ‘জয় বাংলা’ ধবনিকে অবলম্বন করেই উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের কব্জা থেকে বাঙালীর নিজস্ব রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’কে  উদ্ধার করা হয়েছে৷ হয়তো এই  ‘জয় বাংলা’ ধবনির মধ্যেই বর্তমানে বঞ্চিত ও শোষিত বাঙালী তাদের হারানো অতীত ও সংগ্রামী ঐতিহ্যবাহী জাতিসত্তাকে আবিষ্কার করতে পারবে৷ আত্মোপলদ্ধির ও পুনর্জাগরণের এই পথ ধরেই হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সংঘটিত হবে ও বৃহত্তর বাংলার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে৷ আর এটাই ভবিষ্যতের বাস্তব৷ তাই ‘জয় বাংলা’ এই জয়ধবনির অঙ্গীকারেই একদিন রচিত হবে বাঙলার ও বাঙালীর অনন্য বিজয়গাথা --- বাঙালী হিসেবে অবশ্যই সেই মুহূর্তের শুভাগমনকে ত্বরাম্বিত করার কর্মযজ্ঞে সব বাঙালী  সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ এটাই কাম্য আর এটাই যুগের দাবী৷