খ্রীষ্টজন্মের চার পাঁচশো বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল৷ প্রাচীন মুদ্রা দীনায়, রূপক, দ্রম্ম, কপর্দক-পুরাণ ইত্যাদির মত কড়িও এক সময় ছিল বাংলা মুদ্রা৷
লক্ষণ সেনের আমলে কড়ির প্রচলন ছিল৷ মুসলমান ঐতিহাসিক মীন্ হাজুদ্দিন লিখিত ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে, রাজা লক্ষণ সেন কাউকে দান করার সময় লক্ষ কড়ির কম দান করতেন না৷ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কড়ির আকারে নির্মিত রৌপ্য মুদ্রাকেই বলা হত কপর্দক-পুরাণ৷ কিন্তু তার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি৷ তাই অনেকের ধারণা, কপর্দক-পুরাণ বলতে বোঝাত কিছু সংখ্যক কড়ি৷
সেন বংশের তাম্রশাসনে দেখা গেছে ভূমির বার্ষিক আয় কপর্দক-পুরাণের হিসাবে নির্ধারিত হত৷ একসময় ভারতে ভূমি-রাজস্বও রৌপ্য-মুদ্রায় ধার্য হত৷ বাংলায় গুপ্ত যুগে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল৷ গুপ্ত যুগের পরেও বাংলার রাজারা স্বর্ণ মুদ্রা চালু রেখেছিলেন৷ কিন্তু সেই সব স্বর্ণমুদ্রা ছিল অতি নিকৃষ্ট ধরনের--- অত্যধিক খাদ-মিশ্রিত৷ অতঃপর রৌপ্য মুদ্রারও অভাব দেখা দেওয়ায় বাংলা ও বিহারে কড়ির প্রচলন শুরু হয়৷ গুপ্ত আমলে মুদ্রার নিম্নতম মান ছিল কড়ি৷ ফা-হিয়েনের মতে চতুর্থ শতকে কড়ি দিয়েই ক্রয়-বিক্রয় হত৷
দশম-একাদশ শতকে কবড়ি অর্থাৎ কড়ির প্রচলনের কথা চর্যাপদে উল্লেখ আছে৷ ‘কবড়ি ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছরে পার করই’৷ অর্থাৎ কড়িও নেয় না, বুড়িও নেয় না, সহজে পার করে দেয়?৷ ত্রয়োদশ শতকে কড়ির প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও বিদেশী পর্যটকদের বিবরণে৷ বেহাইর পায়ে পড়ি/ ব্যবহার কৈল কড়ি’ (কবিকঙ্কন চণ্ডী)৷
ভাস্করাচার্যের লীলাবতী গ্রন্থের (১১১৪খ্রীঃ) আর্যানুসারে কুড়ি কড়িতে এক কাকিনী, চার কাকিনীতে এক পণ, ষোল পণে এক দ্রম্ম, ষোল দ্রম্মতে এক নিষ্ক৷
প্রাচীনকালে কশ্মীরেও সাধারণ ক্রয়-বিক্রয় কড়ির মাধ্যমে হত৷ স্টেইন সাহেবের মতে কাশ্মিরী মুদ্রা দিন্নার আসলে কড়ি ছাড়া অন্য কিছু নয়৷ কাশ্মীরে একশত কড়িকে বলা হত ‘হত্’৷ এখনো কাশ্মীরিরা পয়সাকে বলে হত৷ সে-সময় একশটি কড়ির বিনিময় তাম্রমুদ্রা পাওয়া যেত৷ এক খারী ধানের মূল্য ছিল ২০০ (দুইশত) কড়ি৷ এক খারী সমান ৮৪ (চুরাশি) কিলোগ্রাম৷ একাদশ শতাব্দে কশ্মীরের রাজা অনন্ত শাহি রাজকোষে ঘড়া ঘড়া কড়ি রাখতেন৷ প্রাচীনকালে প্রচলিত ‘দিন্নারোজ্জাম-চীরিকা’ কথাটির অর্থ হল কড়িতে টাকা ধার নেওয়ার খৎ৷
প্রাচীনকালে কোথা থেকে কড়ি আসত তা জানা না গেলেও মধ্যযুগের শেষভাগে ভারতে কড়ি আমদানি হত মালদ্বীপ থেকে৷ মালদ্বীপের ৩২০০ কড়ির মূল্য ছিল এখনকার ৩৫ পয়সা৷ মালদ্বীপের কড়ি পশ্চিম ভারতের সুরত বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসত৷
ঊনবিংশ শতাব্দেও বাংলাদেশে কড়ির প্রচলন ছিল৷ অষ্টাদশ শতাব্দে বিলাতেও এদেশের কড়ির চাহিদা ছিল বোঝা যায়৷ ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দের ৪ই সেপ্ঢেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি প্রস্তাব ছিল---সারা বছর যে-সকল কড়ি এদেশে রাজস্ব হিসাবে আদায় হবে তা প্রতিমাসে থলিতে ভরে একসপোর্ট ওয়ার হাউসের রক্ষকের কাছে পাঠাতে হবে৷ নির্দেশমতো সেগুলো যেন জাহাজে করে ইংল্যাণ্ডে সরবরাহ করা হয়৷
- Log in to post comments