কর্ষককুলের স্থায়ী কল্যাণ একমাত্র সমবায়ের  মাধ্যমেই সম্ভব

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

দেশের বেশিরভাগ অধিবাসীই গ্রামাঞ্চলের মানুষ৷  আর তারা  মূলতঃ কৃষির  সঙ্গে জড়িত৷ তার সঙ্গে  সঙ্গে  ওই কর্ষক পরিবারের অধিকাংশের  আবার  কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই৷ তারা  হয় আংশিক, নয়তো পূর্ণ বেকার৷

এদিকে সরকারী পরিসংখ্যান  থেকেই  জানা যায়, প্রতিবছর গড়ে  ১২ হাজার  কৃষিজীবী আত্মহত্যা করে৷  দারিদ্র্য,  ঋণ করে ফসল ফলিয়ে  প্রাকৃতিক  দুর্র্যেগের  ফলে ফসল নষ্ট হওয়া বা ফসলের দাম না পাওয়া প্রভৃতি নানাবিধ  কারণে  হতাশার  কবলে পড়ে তারা  আত্মহত্যা করে৷ তার সঙ্গে  এখন চাষী নয়, কিন্তু  এককালে  কৃষির  সঙ্গে  যুক্ত  ছিল এমন পরিবারের মানুষও দারিদ্র্যে, অনাহারে  আত্মহত্যা করতে বাধ্য  হচ্ছে৷

এই সমস্যার সমাধানের  উপায়  কী? আজকের কৃষির  অন্যতম  প্রধান  সমস্যা হল কৃষিজমির  ক্রমাগত  খন্ডীকরণ৷ ধরা যাক, একজনকার  এক বিঘা জমি ৷ হয়তো  একলপ্তেই রয়েছে৷ এবার  ওই চাষীটির  ৪ ছেলের মধ্যে  যখন জমি ভাগ হয়ে  গেল,  প্রত্যেকের  ভাগে  জমি হ’ল ৫ কাঠা৷ পরের প্রজন্মের  ক্ষেত্রে  ওই  ৫ কাঠা জমিও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেল৷ তখন এক একটা ভূমিখন্ডের  পরিমাণ হয়ে দাঁড়াল  ১/২ কাঠা করে৷ এইভাবে  যতদিন যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে  জমিখন্ড ক্রমশঃ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে৷

আধুনিক যুগে  সময়ের  সঙ্গে তাল রেখে  উৎপাদন  বাড়াতে  যখন  বৈজ্ঞানিক  প্রথায়  চাষ করাটা জরুরী, তখন  দেখা যাচ্ছে, এইসব ভূমিখন্ডের  ক্ষুদ্রত্বের কারণে  বৈজ্ঞানিক  প্রথায়  চাষ  করাটাই  সম্ভব হচ্ছে না৷

তারপর সেচের  জলের অভাব৷ কেবল বর্ষার বৃষ্টির  ওপর ভরসা  করে থাকলে  তো চলবে না! তাই সেচের  জলের ব্যবস্থা চাই ৷ উন্নত সেচব্যবস্থা না থাকার ফলে  বছরের  অধিকাংশ  সময়  জমি খালি পড়ে থাকছে৷ তারপর  খরা, বন্যার সমস্যা আছে৷ দেশের  নদ-নদী-খাল-বিল-পুকুর ভরাট  হয়ে গেছে৷ সংস্কার হচ্ছে না৷ ফলে  বর্র্ষর পর্র্যপ্ত  জল ধারণ করার মত  অবস্থায় নেই৷  তার ওপর  দরিদ্র চাষী পরিবারের  আর্থিক  অভাবের জন্যে  উন্নত  বীজ,  উন্নত সার প্রভৃতি  বিজ্ঞানসম্মত  চাষের  উপকরণই  জোগাড় হচ্ছে না৷

কৃষি ঋণ সবাই  পায়ও না৷  তারপর তো ফসলের  ন্যায্যমূল্যও  চাষীরা পায়না৷ এইভাবে  অজস্র কারণে  গ্রামের  চাষীরা  অধিকাংশই চরম দারিদ্র্যের  মধ্যে রয়েছে৷

এই অবস্থায় কৃষি, কৃষিজীবি তথা গ্রামাঞ্চলের  মানুষের  স্থায়ী যথার্থ কল্যাণ করতে গেলে  কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন নীতির  আমূল পরিবর্তন করতে  হবে৷ কেবল, কখনও কখনও  বিচ্ছিন্নভাবে  কোনো  কোনো  ক্ষেত্রে  সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে  দিয়ে  বা কিছু  কিছু  অনুদান  দিয়ে,কৃষি ঋণ মকুব করে সাময়িকভাবে  নির্বাচনে হয়তো  তাদের  সমর্থন  লাভ করা যাবে, কিন্তু  তাদের স্থায়ী কল্যাণ সম্ভব নয়৷

তাই বলাবাহুল্য কৃষি তথা  গ্রামাঞ্চলের স্থায়ী কল্যাণ  করতে  গেলে মূলনীতির ক্ষেত্রে আমূল  পরিবর্তন  দরকার৷  এজন্যে  প্রথমে যা করার তা হ’ল, ধাপে ধাপে কৃষির সমবায়ীকরণ একান্ত জরুরী৷ সমবায়ীকরণ হলে ভূমিখন্ড  আর বিভক্ত  হবে না, বরং খন্ড-বিখন্ড জমিগুলিকে  একত্রিত  করে একসঙ্গে  চাষ  করা হবে৷ একসঙ্গে বড় বড়  জমির প্লট তৈরী করে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ  করতে  তখন অসুবিধা হবে না৷  তাছাড়া, তখন অনেক চাষী একসঙ্গে তাদের  জমিকে  একত্রিত  করে সমবায় প্রথায় চাষ করলে ও সবাইকার আর্থিক ক্ষমতা একসঙ্গে যুক্ত করলে  তাদের মিলিত আর্থিক ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে৷ তখন  তারা মিলিতভাবে অনেক ছোট-খাট  সমস্যাকে সহজে সমাধান  করতে পারবে৷ সমবায়কে  সরকারও সবরকম  সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে৷ সমবায় নিজেই জলসেচের বা জৈব সার  তৈরী  প্রভৃতি  ক্ষেত্রে অনেক প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারবে৷

তখন এই কৃষি-সমবায় বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ করতে পারবে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে  যে সব  উপকরণ  দরকার  হয়,  সেগুলির  উৎপাদনের জন্যে  সমবায়  পদ্ধতিতেই  কৃষি সহায়ক  শিল্প গড়ার পরিকল্পনা নিতে  পারবে৷  অপরদিকে কৃষিজাত ফসলের ভিত্তিতে সমবায়  পদ্ধতিতেই  কৃষিভিত্তিক  শিল্প গড়ে তোলার  পরিকল্পনা  নিতে পারবে৷

এতে কৃষি পরিবারের  যে সমস্ত  সদস্যরা কৃষিকাজের  সঙ্গে যুক্ত  নয় তাদের ও গ্রামাঞ্চলের  অন্যান্য লোকেদের  কর্মসংস্থানের সুযোগ  হবে৷ এতে  গ্রামের  মানুষের  দারিদ্র্য ঘুচবে৷

তাছাড়া, কৃষি-উৎপাদন যেমন সমবায়  পদ্ধতিতে হবে (উৎপাদক  সমবায়), তেমনি কৃষিজাত  দ্রব্যের  বন্টনব্যবস্থাও হতে পারবে উপভোক্তা সমবায়ের  মাধ্যমে৷ কৃষিকে কীভাবে ধাপে ধাপে  সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত  করতে হবে, ‘প্রাউট’ দর্শনে প্রাউটের  প্রবক্তা তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে  অন্যান্য  সমবায়গুলির পরিচালনার ব্যাপারেও সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়েছেন৷

সংশ্লিষ্ট সরকারগুলির কাছে  তথা জনসাধারণের  কাছে  আমাদের অনুরোধ, এই সমবায় ব্যবস্থার বাস্তবায়নের দিকে নজর দিন৷ গ্রামাঞ্চলের  মানুষের তথা দেশের  সমগ্র  জনসাধারণের  স্থায়ী কল্যাণ একমাত্র  সমবায়ের মাধ্যমেই সম্ভব৷