কৃত্রিম হিন্দিভাষা নয়; সংস্কৃতভাষা হোক ভারতবর্ষে লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা

লেখক
সুকুমার সরকার

" হিন্দি , হিন্দু , হিন্দুস্তান "এই শ্লোগান তুলে সংঘ পরিবার ও সংঘ পরিবারের বিজেপি সরকার  ভারতীয় রাজ্য-রাজনীতির আকাশ তোলপাড় করে তুলছে । অথচ শ্লোগানের এই তিনটি শব্দের কোনোটিই ভারতীয় শব্দ নয় । এই তিনটি শব্দ বহি:ভারতীয় মুসলমানদের দান । আরব মুসলমানেরাই তাদের ভাষার উচ্চারণে প্রাচীন সিন্ধু অববাহিকার মানুষদেরকে হিন্দু বলে অবিহিত করতেন । সিন্ধু সভ্যতাকে তারা হিন্দু সভ্যতা বলতেন । আর সমগ্র দেশকে তারাই হিন্দুস্তান বলেছেন । সুতরাং হিন্দু বা হিন্দুস্তান আজ যতটা জাতি বা ধর্মমত বাচক , তারচেয়ে বেশি দেশ বাচক । সেই দেশ বাচকতায় ভারতে বসবাসকারী সকল মানুষই হিন্দু । আর হিন্দুদের বাসস্থান অর্থেই হিন্দুস্থান বা হিন্দুস্তান । আর তাই ভারতের মুসলিম কবি আল্লমা ইকবাল লেখেন, "সারে জাহা সে আচ্ছা , হিন্দুস্থা হামারা " । এই 'হিন্দু' কিন্তু পরবর্তীকালের "হিন্দু ধর্মমত"নয়!

হিন্দু ধর্মমত কবে , কীভাবে গড়ে উঠলো ; এবং ভারতবর্ষে কারা হিন্দু ? এ প্রশ্নের আজও কোনো মীমাংসা হয়নি । উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণরা হিন্দু , না দলিত আদিবাসীরা হিন্দু ? কারা হিন্দু ? কাদের দেশ হিন্দুস্তান ? কাদের ভাষা হিন্দি ভাষা ?

       যতদূর জানি ভারতবর্ষের কোনো জাতিরই মাতৃভাষা হিন্দি নয়! উত্তরভারতের অবধ অঞ্চলের যে ক্ষুদ্র অংশের নাম আলাদাভাবে হিন্দুস্তান হয়েছিল , সেখানকার মানুষের প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে অমার্জিত যে ভাষা ছাদ গড়ে উঠেছিল , প্রাথমিকভাবে তাকেই বলা হতো হিন্দি ভাষা । এই ভাষা বহুলাংশে কৃত্রিম । এই ভাষার ব্যাকরণ প্রকরণের কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ নেই । পরবর্তীকালে এই ভাষাকে শাসক শোষকেরা বাহন করেছিল নব্য- ভারতীয় ভাষাগুলিকে ধ্বংস করে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মুছে ফেলার জন্য । সে ধারা আজও অব্যাহত । আজ সমগ্র ভারতের জন্য লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে যখন কোনো একক ভাষার দাবী উঠছে , তখন হিন্দিকেই বেছে নিচ্ছেন শাসক শোষকেরা । উদ্দেশ্য সেই একটাই --- শাসন ও শোষণের পথ প্রশস্ত করা । ভারতীয় সনাতন ধর্মাদর্শ তুলে ধরা নয় । সেটা চাইলে ভারতীয় সর্বভাষার প্রেরণাদায়িনী সংস্কৃতভাষাকে লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাশিক্ষা করতেন । যেমন ইহুদিরা করেছেন , তাঁদের হিব্রু ভাষাকে ফিরিয়ে এনে ।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি , সংস্কৃত ভাষা কিন্তু হিব্রুর ছেয়েও সহজ এবং ললিত মধুর ভাষা । তা ছাড়া সংস্কৃত ভাষার শব্দ-অক্ষর উচ্চারণে মানুষের জিহ্বার জড়তা কেটে যায় । যা অন্য ভাষায় ততটা সহজ নয় । কেননা, সংস্কৃত ভাষার পঞ্চাশটি বর্ণই মাতৃকাবর্ণ সঞ্জাত । যা নাভিমূল থেকে উঠে এসে বাগযন্ত্রের সমস্ত অঙ্গ স্পর্শ করে । ফলে যে কোনো ভাষার শব্দ অক্ষর উচ্চারণ করা সহজ হয় । স্কুল-কলেজে সংস্কৃত অবশ্য পাঠ্য হলে , যে কোনো ভাষার বিদ্যার্থীই উপকৃত হবে ।

      আর একটি কথা , ইংরেজি ভাষাও কিন্তু বিশ্বের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা । ভারতবর্ষেরও । ইংরেজি ভাষার কারণে বিশ্বের কোনো ভাষার মৃত্যু হয়নি । ইংরেজি ভাষার সংস্পর্শে এসে বিশ্বের অপরাপর ভাষাগুলি সমৃদ্ধই হয়েছে । তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাভাষা সহ নব্যভারতীয় সকল ভাষাগুলিই । ইংরেজরা   দুশো বছর শাসন করেও নব্য ভারতীয় কোনো ভাষার মৃত্যুর কারণ হয়নি । বরং নব্য ভারতীয় ভাষাগুলি আরও বেশি সমৃদ্ধ হ্য়েছে । কিন্তু হিন্দি ভাষার দাপটে ভারতবর্ষের বহু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষা ভুলে গেছে । যেমন ভোজপুরি ভাষা , আঙ্গিক ভাষা , অবধি ভাষা , মৈথলি ভাষা , ডোগরি ভাষা ইত্যাদি  । হিন্দি ভাষার দাপটে ওই ভাষাগুলির মানুষ  নিজেদের মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে কৃত্রিম ওই হিন্দি ভাষাকেই মাতৃভাষা মনে করছে ।

         আজ যাঁরা ক্ষমতার অলিন্দে বসে থেকে ভারতবর্ষের সব রাজ্যের কোমলমতি বিদ্যার্থীদের জন্য হিন্দি ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে চাইছেন কিংবা সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য কৃত্রিম  হিন্দিভাষাকে লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা করতে চাইছেন, তাঁদের কারোরই কিন্তু মাতৃভাষা হিন্দি নয় ! তবে কেন তাঁরা সবার ওপর হিন্দিভাষা চাপাতে মরিয়া হয়েছেন ? কারণ তাঁরা জানেন, যেহেতু হিন্দি ভারতবর্ষের কোনো জাতিরই মাতৃভাষা নয় , তাই তাতে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশও নেই । আর প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ নেই বলে  এই ভাষা খুব সহজেই মানুষের সাংস্কৃতিক শিকড় বৃক্ষ ধ্বংস করে দিতে পারবে । মানুষ চিরকালের জন্য প্রতিবাদহীন হয়ে শাসক শোষকের শাসন শোষণ মেনে নিতে বাধ্য থাকবে।সুতরাং আজ সর্বাগ্রে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে যে, পশ্চিমা বাদামি শাসক ও শোষকেরা কেন বারবার হিন্দিভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে মরিয়া তৎপর হয়ে উঠছে ?  নইলে বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতবর্ষ তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলে শুষ্ক এক মানস-মরুভূমিতে পরিণত হবে । 

  অতীতের হিন্দু বা হিন্দুস্তান কিন্তু একক কোনো জাতি বা ভাষা বা ধর্মমতের মানুষদের জন্য ছিল না । বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতবর্ষের সকল নৃতাত্ত্বিক, সকল ভাষাতাত্ত্বিক, সকল ধর্মমতের মানুষের মিলন সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল ভারতবর্ষ নামক হিন্দুস্তান। আর এই মিলনকে একসূত্রে গেথে রেখেছে ভারতীয় 'সংস্কৃতভাষা' ও  'আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক ভারতীয় সনাতন আদর্শ'। হিন্দিভাষা নয় ; হিন্দু ধর্মমতও নয় ! ভারতীয় সনাতন আদর্শ । ভারতীয় সনাতন আদর্শ হলো, বহু ভাষা, বহু ধর্মমতের মিলন সংস্কৃতি। সনাতন আদর্শে আদর্শায়িত হলে সংঘ পরিবার বা সংঘ পরিবারের বিজেপি সরকার ভারতীয় সংস্কৃত ভাষাকে লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা করতে পারতেন । 

   আজ ভারতবর্ষের নব্য-ভারতীয় সকল ভাষাগুলি গড়ে উঠেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্কৃত ভাষার ওপর ভিত্তি করে।সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ প্রকরণই নব্য-ভারতীয় ভাষাগুলি প্রাণ সঞ্চার করে চলেছে। এই সংস্কৃত ভাষাই পারতো ভারতীয় জাতিটাকে এক সেন্টিমেন্টে গ্রথিত করে রাখতে । 

   না, সংস্কৃত কোনো কৃত্রিম ভাষা ছিল না। একইভাবে  সংস্কৃতভাষা কেবল মাত্র হিন্দু ধর্মমতের দেবতার ভাষাও ছিল না বা নেই। সংস্কৃতভাষা ছিল,একাধারে ভারতীয় আদিম অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মঙ্গোলয়েড সঞ্জাত অনার্য জনজাতির মুখের ভাষার সংস্কারজাত সংস্কৃত রূপ ; অন্যদিকে ছিল বহিরাগত আর্যদের বৈদিকভাষার সংস্কারজাত সংস্কৃত রূপ । এই দু'য়ে মিলে পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল নব্য-ভারতীয় সংস্কৃতভাষা । যে ভাষায় বাল্মীকি, ভবভূতি, কালিদাস প্রমুখেরা কাব্য-সাহিত্য রচনা করে গেছেন । যে সংস্কৃত ভাষা ভারতীয় সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার মধ্যে হাজারো শব্দ-অক্ষরে সমাহিত হয়ে আছে । বহিরাগত আর্যজাতির বৈদিকভাষার প্রভাব মুক্ত যে দক্ষিণ ভারত হিন্দির বিরুদ্ধে এত তীব্র প্রতিবাদ করছে, তাদের ভাষাতেও কিন্তু অনেক সংস্কৃত শব্দ এটাই প্রমাণ করে যে তাদের ভাষার নিজস্ব শব্দ ভাণ্ডারে পূর্ব থেকেই এই শব্দগুলি ছিল ।

   সুতরাং সংস্কৃত ভাষা ভারতবর্ষের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হলে, ভারতবর্ষের কোনো জাতিরই মাতৃভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে  না । সবাই আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে । কিন্তু হিন্দিভাষা বাধ্যতামূলক চাপানো হলে ভারতবর্ষ তো তার ভাষা বৈচিত্র্য হারাবেই । জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সংহতিও ধ্বংস হবে । তা ছাড়া হিন্দিভাষার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশক্ষম , অনেক বেশি ললিত মধুর গীতিধর্মী ভাষা ভারতে আছে । সে সব ভাষা থেকেও দাবী উঠবে , সেই সব ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার বা রাষ্ট্রভাষা করার। এ ব্যপারে বাংলাভাষা, তামিল ভাষা অগ্রণী ভূমিকায় আছে । বাংলা ভাষার দাবী তো আরও বেশি জরালো । ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত , জাতীয় ভাবনা , রণসঙ্গীত সবই তো বাংলা ভাষায় । নব্য ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে এই মুহূর্তে বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার সবচেয়ে বেশি । প্রায় দেড় লক্ষ । সে সব দাবী অলরেডি উঠতেও শুরু করেছে । এই সব দাবী ওঠাটাই বলে দিচ্ছে যে  , ভারতবর্ষের জন্য একক ভাষা চাপানো দাবী জাতীয় সংহতির জন্য কতটা ক্ষতিকর।

এমনিতেই এন. আর. সি ;  সি. এ. এ. -এর নাম করে বাঙালিসহ  ভারতবর্ষের বহু মানুষকে নাগরিকত্বহীন করে একটি আসন্তোষের বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার যদি  ভাষা কেড়ে নেবার চক্রান্ত শুরু হয় , কে বলতে পারে, বাঙালিরাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন  রাজ্যের মানুষ স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করবে না ? এই আসন্তোষের বাতাবরণে ভারতবর্ষের প্রতিটি জাতি সেই দাবী তুলে নিজেরা স্বাধীন হতে চাইলে অবাক হবারও কিছু থাকবে না। বিজেপি সরকারের এইসব আত্মঘাতী প্রবণতা ভারতবর্ষকে সেই দিকেই ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে !