‘কৌশিকা’ শব্দের একটি অর্থ হ’ল রেকাবি, পিরীচ (পেয়ালা–পিরীচ), ডিশ, প্লেট (চায়ের প্লেট), জলখাবারের জন্যে ব্যবহার করা ছোট আকারের কানা–উঁচু থালা, ফুলকাটা থালা, সরা প্রভৃতি৷ প্রাচীন ভারতে এই প্রত্যেকটি জিনিসই ‘কৌশিকা’ নামে পরিচিত ছিল ও জলখাবারের জন্যে এই বাসনই সাধারণতঃ ব্যবহার করা হত৷ প্রাচীন রাঢ়ে রান্না করা জলখাবারের জন্যে ‘কৌশিকা’–ই ব্যবহার করা হত৷ কিন্তু না–রাঁধা জলখাবারের জন্যে ছোট আকারের একপ্রকার পাত্র যাকে ছোট ধুচুনী বা পেত্তে বলা হয় বা বলা হত তা–ই ব্যবহার করা হত৷ রাঢ়ের পণ্ডিতেরা এই জন্যে ছোট আকারের ধুচুনী বা পেত্তের জন্যে সংস্কৃত ‘কৌশিকা’ শব্দ ব্যবহার করতেন৷
পাশ্চাত্ত্য প্রভাবে মানুষ বাঁশ–বেতের ভোজনপাত্রের ব্যবহার কমিয়ে ফেলেছিল৷ বাঙলায় যখন সাহেবরা আসেন তখন ভোজনপাত্র হিসেবে বাঁশ–বেতের আধার ব্যবহূত হত৷ পাশ্চাত্ত্য প্রভাবে বাঙালী যখন একটি ইঙ্গ–বঙ্গ সমাজ গড়ে তুলেছিল এই কলকাতা শহরেরই বিভিন্ন অংশে, ডিরোজিওর প্রতিপত্তি যখন তুঙ্গে সেইরকম সময়ের মানুষেরা সাধারণ বাঙালীর খাদ্যকে ‘খাবার’ তথা ভাল বাঙলায় ‘আহার’ বা ‘ভোজন’ বলত৷ সাহেবী খানাকে তারা ইচ্ছে করেই ‘খানা’ বলতে শুরু করে৷ বাংলা ভাষায় ‘খানা’ শব্দটি চলে আসছে ৭০০ বছর ধরে ঠিকই কিন্তু ইঙ্গ–বঙ্গ সমাজে ‘খানা’ শব্দটি ব্যবহূত হতে থাকে বিশেষ করে সাহেবী চালের খাবারের জন্যে......আরও বিশেষ করে ভোজ্যে শূকরমাংসের ব্যবহার থাকলে৷ সেই সময়কার একটি ছোট্ট গল্পের কথা মনে পড়ল৷
তোমরা নিশ্চয় অনেকেই জান হুগলী জেলার জনাই ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের একটি শ্লাঘার বস্তু৷ বেশ সুশিক্ষিত গ্রাম৷ সংস্কৃতের জ্ঞানের জন্যে রাঢ়–বাঙলায় এই জনাবতীপুর (জনাই) অনেকের কাছেই পরিচিত ছিল৷ বৌদ্ধযুগে ও বৌদ্ধোত্তর যুগে বাঙলায় এর প্রভাব দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ বৌদ্ধোত্তর যুগের শেষ চরণে জনাই–এরও প্রতিদ্বন্দ্বী জুটে গেল৷ যারা জুটল তারা হচ্ছে পণ্ডিত কায়স্থদের গ্রাম বাক্সা (বাকসারিকা), কৈকালা (কপিত্থকলিকা) ব্রাহ্মণ–গ্রাম ভাণ্ডারহাটী, সিঙ্গুর (সিংহপুর) প্রভৃতি৷ ইংরেজ আমলের মাঝামাঝি সময়ে এদের অনেকে রাক্ষসী ম্যালেরিয়ার আক্রমণে ধ্বংস হতে বসেছিল৷ এখন কেউ কেউ টাল সামলে নিয়েছে.....কেউ আর তা পারেনি৷ সে যুগে এদের সবাইকার মধ্যে চলেছিল একটা বন্ধুত্বপূর্ণ বৈদগ্ধ্য প্রতিযোগিতা৷ প্রাক্–পাঠানযুগের ঠিক পূর্ব চরণে ভাণ্ডারহাটী একটি নামজাদা পণ্ডিত–গ্রাম রূপে পরিচিত ছিল৷ ভাণ্ডারহাটীর তো বটেই, ভাণ্ডারহাটীর কাছাকাছি গ্রামের বসবাসকারী পণ্ডিতেরাও নিজেদের ভাণ্ডারহাটী গোষ্ঠীর মানুষ বলে পরিচয় দিতেন৷ ঠিক তেমনই ভাণ্ডারহাটী গোষ্ঠীর একজন স্বনামধন্য মানুষ ছিলেন বিদ্যাভূষণ বাচষ্পতি৷ বাচষ্পতি মশায় ছিলেন তীক্ষ্ণধী প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সম্পন্ন এক বিরাট পণ্ডিত৷ কাব্য, সাংখ্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি সবেতেই ছিল তাঁর সমান দখল৷ অথচ মানুষটি ছিলেন সদালাপি, নিরহঙ্কার৷ দেখে কে বুঝবে, তিনি অত বড় পণ্ডিত৷ কেউ তাঁকে শ্লেষ বর্ষণ করে কথা বললে, ঠোক্কর তুলে ঘা দিলে তিনি তাকে সেইভাবে প্রত্যুত্তর দিতেন না–দিতেন হাস্যরসিকতার মাধ্যমে, বৈদুষ্যমণ্ডিত ভাষায়৷
এহেন বিদ্যাভূষণ বাচষ্পতি মশায় কলকাতায় খুব কমই আসতেন৷ কলকাতার ইঙ্গ–বঙ্গ সমাজের সঙ্গে তিনি মানিয়ে চলতে পারতেন না৷ সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত মশায়রা চাইতেন তিনি কলকাতায় আসুন–তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন৷ কিন্তু বাচষ্পতি মশায়ের কলকাতার প্রতি এই অনীহা তাঁদের ব্যথিত করত৷
একবার তিনি কলকাতা এলেন৷ তাঁকে দেখেই ইঙ্গ–বঙ্গ সমাজ কিছুটা বিরক্ত হ’ল.......দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হ’ল কারণ বাচষ্পতি মশায় কারোর খাতির রেখে কথা বলতেন না৷ যদিও কথা বলতেন অত্যন্ত ভদ্রভাবে৷ সেবার কলকাতায় দু’চার দিন থেকে গেলেন৷ বাচষ্পতি মশায় এবার গ্রামে ফিরবেন৷ ইঙ্গ–বঙ্গ সমাজ প্রতিপদেই তাঁর উপস্থিতিতে পর্যুদস্ত হয়ে চলেছিল৷ তাঁরা ভাবলেন একবার অন্ততঃ বাচষ্পতি মশায়কে অপ্রতিভ করতে হবে–একটা অন্ততঃ ভাল রকমের ঠোক্কর দিতে হবে৷
ইঙ্গ–বঙ্গ সমাজের কয়েকজন তাগড়া তাগড়া মানুষ শূকর মাংসের খাদ্য খাচ্ছিলেন৷ তাঁরা ভাবলেন, এটাই তো মোক্ষম সুযোগ৷ তাঁরা বাচষ্পতি মশায়কে বললেন–‘‘আচ্ছা বাচষ্পতি মশায়, আপনি তো পাণ্ডিত্যের সমুদ্র–যেমন উদার তেমনই ব্যাপক৷ তাহলে আমাদের সঙ্গে বসে একবার খানা খেয়ে আমাদের কৃতার্থ করে দিয়ে যান৷’’ বাচষ্পতি মশায় এর উত্তরে একগাল হেসে বললেন, ‘‘দেখো, আমি একে হুগলী জেলার গ্রাম্য মানুষ–তার ওপর আবার গরীব৷ আমি তোমাদের ওই খানাটানা চোখেও দেখিনি কখনও........জানিও না, তাই খাই–ও না৷ আমরা গেঁয়ো ভূত৷ আমরা খানা–ডোবায় মলত্যাগই করতে যাই৷’’ বাচষ্পতি মশায় তাঁর স্বগ্রামে ফিরে গেলেন৷