লিপিমালার প্রথম অক্ষর ‘অ’-এর ইতিকথা

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

আমরা সকলেই জানি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগে ১২টি স্বরবর্ণের মধ্যে প্রথমেই ‘অ’ বর্ণটি স্থান পেয়েছে৷ শুধুমাত্র বাংলা ভাষায়  ‘অ’ স্বরবর্ণটি প্রথম স্থান পেয়েছে, তা নয়, এই ‘অ’ অক্ষরটি বিশ্বের অধিকাংশ লিপিমালারই প্রথম অক্ষর হচ্ছে ‘অ’৷ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব লিপিমালাতেই প্রথম অক্ষর ‘অ’, ব্রাহ্মী, সারদা, নাগরী, ডোগরী, টেকরি, চুরুবালি মোড়ি, কোটাবালি মোড়ি, গুজরাটি, মারাঠি, লণ্ডেই, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, কন্নর, ওড়িয়া, বাংলা, থাই, বর্মী (মগী ভাষা সমেত) সব ভাষাতেই প্রথম অক্ষর ‘অ’৷ অন্যদিকে লাতিন সেমিতীয়, গ্রীক প্রভৃতি ভাষাগুলিতেও তাই৷ ভারতীয় লিপিগুলিতে প্রথম অক্ষরের উচ্চারণ যেমন ‘অ’, তেমনি ইংরেজীতে অ(A), ফরাসীতে ‘আ’৷ এই ‘অ’ কেন সমস্ত বর্ণমালার স্বরবর্ণগুলির মধ্যে ‘অ’ কে প্রথম স্থানে রাখা হ’ল তা জানতে হলে অতীত পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনার বিষয় জানতে হবে৷ সুপ্রাচীন অতীতে অর্থাৎ আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে যখন পৃথিবীর বুকে প্রথম জীবের আবির্ভাব হয়েছিল, তখন তারা সবাই ছিল বোবা৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে, অতীতের কোনও জীবের কণ্ঠের ভাষা অর্থাৎ আবাজ ছিল না৷ ভাষাহীন বা বোবা ছিল৷ মউমাছি, পিপীলিকা, ডঁইপোকা  জীবেরা এক ধরণের আবাজ করত৷ কিন্তু এই আবাজ তাদের কণ্ঠ নিঃসৃত আবাজ নয়৷ হাওয়া কেটে ওড়ার আবাজ৷ ঝিঁ ঝিঁ পোকার যে আবাজ শুনি সেটাও তাদের কণ্ঠ নিঃসৃত ভাষা বা আবাজ নয়৷ এদের যে আবাজ শুণতে পাই, তা তারা স্নায়ুর সাহায্যে এক ধরণের স্পন্দন(vibration) তৈরী করে৷ তারপর ক্রমশঃ এই বোবা বা মূকের জগৎ হ’তে মুখরতার জগতে এসেছে৷ নীরব পৃথিবীর এইভাবে একদিন জন্তুর মুখে শব্দ ফুটে উঠেছিল৷ সেই সু-প্রাচীন  অতীতে একটি জন্তুর নাম ছিল অষ্ট্রালোপেথিসিন্৷ তারা ছিল উভচর৷ এই উভচর জীব অষ্ট্রালোপেথিসিন্ ডাঙ্গায় বেশীক্ষণ থাকতে পারত না৷ তখনও এই শ্রেণীর জীবের উন্নত শ্বাসযন্ত্র তৈরী হয়নি৷ তাই তারা জলেও বেশীক্ষণ থাকতে পারত না৷ ডাঙ্গায় বেশীক্ষণ থাকলে এরা কষ্ট বোধ করলে জলে নেবে পড়ত, আর অনেকক্ষণ পর্যন্ত জলে ডুবে থাকত৷ তারপর জল থেকে মাথাটা তুলে একটা ‘আঃ’ শব্দ করত৷ সম্ভবতঃ এটাই হ’ল ধরিত্রীর বুকে ধবনি তরঙ্গের প্রথম অনুরণ৷ ব্যাঞ্জন ধবনির চেয়ে স্বরধবনির উচ্চারণ সহজ৷ আবার স্বরবর্ণগুলির মধ্যে ‘অ’ অক্ষরটির উচ্চারণ সবচেয়ে সহজ৷ এই ‘অ’ অক্ষরটিরই দীর্ঘায়িত উচ্চারণ হ’ল ‘আ’, অর্থাৎ দু’টো ‘অ’-কে পাশাপাশি রেখে উচ্চারণ করলে হয়---‘আ’৷ এই জন্যে ‘আ’, কোনও বর্ণমালার স্বতন্ত্র অক্ষর হিসাবে ধরা হয় না৷ অর্থাৎ ‘আ’-এর কোনও স্বতন্ত্র রূপ নেই৷ ‘আ’-এর অস্তিত্ব ‘অ’-এর ওপর নির্ভরশীল৷ তাহলে ‘আ’ হচ্ছে আমাদের আকার দেওয়া অ-এরই নাম৷ যেহেতু এই অ-ধবনিটি জীবের কণ্ঠে প্রথম উদ্গীত হয়েছিল, তাই এই অক্ষরটি সকল বর্ণমালার প্রথমেই স্থান দেওয়া হয়েছে৷ এই ‘অ’-ধবনিটি হ’ল বিশ্বসৃষ্টির আদি বীজ, আদি ধবনি৷ বর্ণমালার প্রথম অক্ষরই তাই ‘অ’

(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘ব্যাকরণ বিজ্ঞান’ অনুসারে লিখিত)