মানব ইতিহাসে শিবের অবদান

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

ঐতিহাসিক শিব

শিব প্রকৃতপক্ষে কাল্পনিক দেবতা নয়৷ আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর পূর্বে হিমালয় অঞ্চলে (কৈলাস) এই মহামানব শিব জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ ধর্ম, নৃত্য-গীত, চিকিৎসা, সমাজব্যবস্থা---তৎকালীন সমাজের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে শিব মানুষকে যথাার্থ পথ প্রদর্শন করে মানব সমাজের আদি গুরু রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন৷

আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে শিবের অবদান

শিবই আধ্যাত্মিক সাধনা বিজ্ঞান ও তন্ত্র শাস্ত্রের রচয়িতা৷ বেদ মূলত তাত্ত্বিক৷ এর ৯৫ শতাংশ তত্ত্ব৷ এতে বৈবহারিক সাধনা পদ্ধতি অতি সামান্য৷, বলা চলে পাঁচ শতাংশ মাত্র৷ তাও বেশীরভাগ কেবল প্রার্থনামূলক৷

কিন্তু কি করে মানুষ ব্রহ্ম উপলব্ধি করবে, যপ ধ্যানের মাধ্যমে মনকে একাগ্র করা, একাগ্রিকৃত মনকে পরম তত্ত্ব অর্থাৎ পরমপুরুষের দিকে পরিচালিত করা, অনুমনকে ভূমামনে বা ভূমা চৈতন্যে ডুবিয়ে দেওয়া এসবের পদ্ধতি রয়েছে শিব প্রবর্ত্তিত তন্ত্র শাস্ত্রে৷ কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্ব, নবচক্র সাধনা, কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে ঊধের্ব তুলে পরমাত্মার (পরম শিব)-এর সঙ্গে মিলন ঘটানো এ সবই রয়েছে তন্ত্রে৷ তন্ত্রে প্রায় ৯৫ শতাংশই বৈবহারিক Practical) আর ৫ শতাংশ তাত্ত্বিক theory)৷ তন্ত্রের মূলত দুই বিভাগ৷ আগম ও নিগম৷ মানুষ কেমন করে সাধনা করবে, সাধনার পথে চলতে গেলে মনে যে সমস্ত প্রশ্ণ জাগে সাধককে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এইগুলি নিয়ে হ’ল আগম৷ আর এ  সমস্ত প্রশ্ণের উত্তর পাই নিগম শাস্ত্রে৷

শিবপত্নী পার্বতীর প্রশ্ণ ও শিবের ওই সমস্ত সুচিন্তিত প্রশ্ণের উত্তর --- এই নিয়েই রচিত হয়েছে যথাক্রমে তন্ত্রের নিগম ও আগম অংশ৷

তন্ত্রের আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য এতে জাতি-বর্ণ প্রথা মানা হয়নি৷ সমস্ত মানুষেরই এক জাতি, এক গোত্র৷ তাই বলা হয়েছে আত্মগোত্রং পরিত্যাজ্য শিবগোত্রং প্রবেশতু৷ শিব ভক্তের আর অন্য কোন গোত্র থাকবে না, সবাই শিব গোত্রের হয়ে যাবে৷ তেমনই তাদের পৃথক কোন জাতি-বর্ণেরও পরিচয় থাকবে না, সবাই এক হয়ে যাবে৷

নৃত্য-গীত

নৃত্য ও গীতের ক্ষেত্রেও শিবের অবদান বিশেষ ভাবে স্মরণীয়৷ শিব তাণ্ডব নৃত্যের প্রবর্ত্তন করেছিলেন যা মূলত ছন্দপ্রধান৷ এটি সমস্ত শরীরের বিশেষ করে মস্তিষ্কের উৎকৃষ্ট ব্যায়ামও৷ আর শিবপত্নী পার্বতী সমাজকে উপহার দিয়েছেন মুদ্রা প্রধান ললিত নৃত্য৷ ‘তাণ্ডবে’র ‘তা’ ও ‘ললিতে’র ‘ল’---এই দু’ইয়ে মিলে হয়েছে ‘তাল’৷ সঙ্গীত শাস্ত্রের সুরসপ্তক অর্থাৎ সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সা---এই নিয়েই তৈরী হয়েছে সঙ্গীতের সুর মাধুর্য৷ নৃত্য, বাদ্য ও গীত এই তিনে নিয়ে সম্পূর্ণ সঙ্গীত শাস্ত্র৷  শিব তার প্রবর্ত্তিত সঙ্গীত শাস্ত্র তার শিষ্য ভরতমুনিকে শেখান ও তার মাধ্যমেই সমাজে প্রচারের ব্যবস্থা করেন৷

চিকিৎসা শাস্ত্র

চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক শিব৷ বিভিন্ন গাছ গাছড়ার শিকর, পাতা, কাণ্ড বা বাকল থেকে ঔষধ প্রস্তুত করে রোগ নিরাময়ের পথ দেখান তিনি৷ তাঁর এই শাস্ত্রের নাম ছিল বৈদ্যক শাস্ত্র৷ তাই যারা এই বৈদ্যক শাস্ত্রের চর্চা করতেন তাঁদের বলা হয় বৈদ্য৷ আর শিবকে বলা হয় বৈদ্যনাথ৷ উল্লেখযোগ্য যে বৈদ্যক শাস্ত্রের শল্যকরণ Surgery) ও শব ব্যবচ্ছেদেরও ব্যবস্থা ছিল৷

বিবাহ বিধি

শিবই প্রথমে সমাজে বিধিসম্মত বিবাহ প্রথা চালু করেন৷ শিবের আগে বিধিবদ্ধ বিবাহ প্রথা ছিল না৷ স্বৈরীরা (পুরুষেরা) সন্তানের কোন রকম দায়িত্ব নিত না৷ ফলে সন্তানের ভরণ-পোষণ লালন-পালনের শৈশবকালীন দায়িত্ব সম্পূর্র্ণ মাতাকে বহন করতে হ’ত৷ একা মাতার পক্ষে সকল দায়িত্ব নির্বাহ করা সম্ভব হত না৷ তাই অনেক শিশু অল্পবয়সেই মারা যেত৷ যারা বেঁচে থাকত মাতৃস্তন্য খেকে বঞ্চিত হওয়ার পরে তারা অকুল পাথারে পড়ত৷ মাতা অপর নবজাত শিশুর দিকেই সাধারণত নজর দিত৷ শিব বিবাহ প্রথা চালু করে পুরুষ নাারীকে বিশেষ দায়িত্বের বন্ধনে বাঁধলেন৷ যাতে সংসার মধুময় হয়৷ আর এই ব্যবস্থা চালু করে শিবই প্রথম দায়িত্ব নিয়ে বিবাহ করলেন৷ এককথায় বলতে গেলে সেই অন্ধকারময় যুগে শিব মানব সভ্যতার হাতে খড়ি দিয়েছিলেন৷

আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ

শিব প্রবর্ত্তিত তন্ত্র শাস্ত্রে মানব জীবনের  আদর্শ সম্পর্কে বলা হয়েছে আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ---অর্থ্যাৎ মানব জীবনের লক্ষ্য হ’ল আত্মমোক্ষ অর্থাৎ ঈশ্বর লাভ ও জগতের কল্যাণ সাধন অর্থাৎ প্রতি মানুষ অন্তর্জগতে যে আধ্যাত্মিক সাধনা করে মোক্ষ লাভের প্রয়াসী হবে, সঙ্গে সঙ্গে জনসেবাও করে যাবে৷

এককথায়য শিব সেই অন্ধকারময় যুগে---যে যুগে ঠিক সভ্যতার বিকাশ হয়নি তখন আদি গুরুর ভূমিকা নিয়ে মানব সভ্যতার হাতে খড়ি দিয়েছিলেন৷

তথ্যসূত্র ঃ শিব সম্পর্কে এই সব যুগান্তকারী তথ্য আমরা পাই আনন্দমার্গ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী রচিত ‘নমঃ শিবায় শান্তায়’, ‘তন্ত্রই সাধনা সাধনাই তন্ত্র’, ‘আনন্দবচনামৃতম্’, ‘অভিমত’ প্রভৃতি গ্রন্থাবলীতে৷

‘নমঃ শিবায় শান্তায়’ গ্রন্থে শিবের অবদান, ঐতিহাসিকতা ও তাঁর সম্পর্কে নানান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে৷

‘তন্ত্র ও আর্য ভারতীয় সভ্যতা’ নিবন্ধে তিনি শিব সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন---

‘শিবের শিক্ষা পার্থিব মোহে ভারতবাসী যখন ভুলতে বসেছিল, তখন শিবেরই মত আর এক মহাপুরুষ সকলকে তা স্মরণ করিয়ে দেন---তিনি শ্রীকৃষ৷ শ্রীকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ কি শিব শ্রেষ্ঠ---এই প্রশ্ণ ওঠে না কারণ ব্রহ্মজ্ঞ সকলই এক, সবাই ব্রহ্ম৷ শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন পৃথিবীর (ভারতের তো বটেই) শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও আদর্শ রাজনীতিজ্ঞ৷ আর শিব ছিলেন পৃথিবীর সমাজগুরু---সমাজপিতা-সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের জিনিস৷ শিব সবাইকার পিতা৷ চাঁদমামা যেমন সবাইকার মামা তেমনই আর্য অনার্য সবাইকারই ‘বাবা’৷

শিবের সংসার গোটা ত্রিভূবন৷ তাঁর মর্যাদা কোন দেশ বা বিদেশে সীমিত নয়৷ তবু ভারতের সভ্যতা, ভারতের সমাজ বা তথাকথিত ভারতীয় জাতির যদি কোনও জনক খুঁজতেই হয় তবে একথা জোর করে বলব, বিশ্ব জাতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় জাতির জনক father of the Indian Nation) হবার যোগ্যতা কেবল শিবেরই আছে৷ পাঁচ হাজার বৎসরের বেশী পুরানো এই তথাকথিত ভারতীয় জাতটার পিতা হবার যোগ্যতা কেবল এই বুড়ো শিবেরই আছে আর কারো নেই৷