(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এই সু-উচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছলে মানুষ সমগ্র সৃষ্টির মাঝে (জীবজগতের মাঝে) স্রষ্টা ব্রহ্মকেই দর্শন করে থাকেন৷ স্বামী বিবেকানন্দ তাই তো মন্তব্য করেছেন:
‘‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’’
তখন তার ক্ষুদ্র মানবপ্রেম বিশ্বাপ্রেমে রূপায়িত হয়ে যায়৷ ধর্মসাধনা মানবজীবনকে সংকীর্ণ স্বার্থগন্ডির সীমানাকে অতিক্রম করিয়ে তাঁকে অসীমে প্রতিষ্ঠিত করে৷ জীবের মধ্যেই প্রসুপ্ত শিবত্বকে জাগ্রত করে৷ সার্থক হয়ে ওঠে তার মনুষ্যজীবন৷ তাই মানুষের শরীর বা অবয়ব থাকলেই তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না... মনের বিকাশ না হলে সে কখনোই মানুষ পদবাচ্য নয় অর্র্থৎ তার আচরণ মানুষের মতো হয় না, তার চিন্তা আচরণ হয় পশুর মতো ৷ তখন সে সমাজে গণ্য হয় মনুষ্যরূপধারী পশু অথবা দানব৷ আবার বিকাশের ধারায় তার আচরণ উত্তরণের দিকে গেলে তিনিই আবার সমাজে কখনো দেবতা কখনো বা সাৰাৎ ব্রহ্মরূপেই পরিগণিত হন৷ দস্যু রত্নাকরের নাম আমরা সকলেই জানি৷ লুঠ, দাঙ্গা, হত্যা, প্রভৃতি ঘৃন্য অপকর্মের জন্য তিনি কুখ্যাত দানবরূপে মনুষ্য সমাজে পরিচিত ছিলেন৷ পরবর্তীকালে সাধনার দ্বারা তাঁর মনের বিকাশ ঘটেছিল৷ মন থেকে হিংস্র পাশবিক ভাবনা সরে গিয়ে তিনি হতে পেরেছিলেন দেবতুল্য ঋষি বাল্মীকি৷ একই রকম আনন্দমার্গের ইতিহাসেও আমরা লক্ষ্য করেছি কেমন করে কুখ্যাত দস্যু কালীচরণ দিব্যপুরুষ আনন্দমূর্ত্তিজীর পথনির্দেশনায় সুষ্ঠু ধর্মসাধনার মাধ্যমে মনের পরিবর্তন (বিকাশ) ঘটিয়ে ঋষি কালীকানন্দ অবধূত হতে পেরেছিলেন৷ ব্রহ্ম সাধনা হল সত্যিকারের ‘পরশমণি’---যার ছোঁয়ায় মানব মন হয়ে ওঠে সুবিকশিত৷ তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরম ব্রহ্মের কাছে প্রার্থনা করেছেন---
‘‘অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে৷’’
মানব ধর্মের অঙ্গ :
মানব ধর্ম চারটি প্রধান অঙ্গের ওপর আধারিত বিস্তার, রস,সেবা ও তদস্থিতি৷ এশর শেষ অঙ্গটি হ’ল লক্ষ্য অর্র্থৎ ব্রহ্মস্বরূপে স্থিতিলাভ করা৷
১. বিস্তার সাধনা ঃ- মানুষ মাত্রেই চায় নিজেকে বিকশিত করতে ... বিস্তৃত করতে৷ এই ‘বিস্তার’ বলতে তার মনের বিস্তারকে (expansion) বোঝায়৷ যে মনোবৈজ্ঞানিক অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ মনকে বিস্তৃত করতে পারে তাকেই বিস্তার সাধনা বলে৷ স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন বিস্তারই জীবন---‘Expansion is life’ মনোবিদ্দের মতে জাগতিক বাসনা কামনায় আচ্ছন্ন ‘মন’ হয় সর্বদাই বহির্মুখী ‘মন’ বা সদাই অস্থির ও চাপযুক্ত এই অবস্থায় মনের পরিধি হয় খুবই ছোট৷ এই মনে সর্বদাই অস্থিরতা কাজ করে৷ অন্যদিকে জাগতিক ভোগে অতৃপ্ত মন যখন অসীম ব্রহ্মের ভাবনায় ডুব দেয়, তখনই সে মন ক্রমশ হয়ে ওঠে ‘অন্তর্মুখী’৷ মন অন্তর্মুখী হতে থাকলে গ্রন্থি নি:সৃত হরমোনের সন্তুলন হয়ে স্থির ও চাপমুক্ত হয়৷ এই অবস্থায় মনের পরিধিও প্রসারিত হতে থাকে৷ অন্তর্মুখী ‘মন’ সাধনার মাধ্যমে ব্রহ্মমুখী হতে হতে ‘ব্রহ্মে’ই স্থিত হয়ে গেলে মনের পরিধি বেড়ে গিয়ে পূর্ণ বিস্তার ঘটে৷ মনের পূর্ণ বিস্তারই মনের সম্পূর্ণ বিকশিত অবস্থা৷ এই অবস্থায় জগতের সবাই তার কাছে আপন হয়ে যায়৷ কেউ তার কাছে পর থাকে না৷ অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে মনে হয়৷ তখন অপরের কল্যাণ চিন্তায় মন ছুটে চলে:
‘‘সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরে তরে৷’’
মনের প্রধান তিনটি অংশ (Three parts of mind)
১) চিত্ততত্ত্ব (রূপ ধারণ করে মনের যে অংশ)
২) অহং তত্ত্ব (আমি দেখি, করি ইত্যাদি কর্তৃত্ব করে মনের যে অংশ )
৩) মহৎতত্ত্ব (আমি আছি এই অস্তিত্ববোধের ভাবনা ভাবে মনের যে অংশ)
‘মন’ আমাদের সকল কাজের ‘আসল কর্তা, ‘মন’ নির্দেশ না দিলে ইন্দ্রিয় তথা দেহ কাজ করে না৷ যেমন মন যদি অন্য কোন গভীর চিন্তায় ব্যস্ত থাকে তখন চোখের সামনে থাকা কোন কিছুকেই দেখতে পাই না কিংবা পিছু থেকে কারো ডাকও শুণতে পাই না আসলে কেন এমন হয়? বাইরের জগৎ থেকে অনুভূতি ( ‘রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ---পঞ্চতান্মাসিক অনুভূতি) প্রথমে আমাদের ইন্দ্রিয়ে এসে পৌঁছায়৷ সেখান থেকে তা স্নায়ুর মাধ্যম মস্তিষ্কে ও পরে মনে পৌঁছায়৷ মনে পৌঁছানো মাত্রেই মনের চিত্ততত্ত্ব সেই অনুভূতির ‘রূপ’ গ্রহণ করে নেয়৷ মনের অপর অংশ ‘অহংতত্ত্ব সেটা দেখলে উক্ত অনুভূতিটির সম্পর্কে ইচ্ছা অনিচ্ছা মনে তৈরী হয়৷ মন তখন তদনুযায়ী নির্দেশ বা বার্র্ত পাঠায় দেহের ইন্দ্রিয়গুলিকে৷ ইন্দ্রিয়গুলি মনের নির্দেশ অনুযায়ী তৎপর হয়৷ উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কেউ হয়তো সমুদ্রকে দেখছে৷ আসলে সমুদ্র কে দেখছে কে? উত্তর হবে ‘মন’ (‘চক্ষু’ ইন্দ্রিয় নয়)৷ কীভাবে? সমুদ্রের সৌন্দর্য্য (‘রূপ তন্মাত্র) চোখের রেটিনাতে এলে তা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছূে গেলে চিত্ততত্ত্ব ‘সমুদ্রের রূপ’ ধারণ করে নেয়৷ এরপর ওই সমুদ্রের রূপকে দেখছে মনের যে অংশ, সেটি মনের অহংতত্ত্ব (আমি আছি---এই বোধ)৷ এরপর ‘আমি আছি’ অর্র্থৎ অস্তিত্ববোধ আছে বলেই সকল কাজ সম্পন্ন হচ্ছে৷ অর্থাৎ মনের এই আমি আছি বোধকেই বলে মনের মহৎতত্ত্ব (অস্তিত্ববোধ---‘I exist’—this feeling)৷
‘সঞ্চর ধারায়’ মানব মন বন্ধন যুক্ত বা সগুনত্ব লাভ করে চৈতন্যসত্তার ওপর সত্ত্বগুণের প্রভাবে ‘মহৎতত্ত্ব’ তৈরী হয়৷ রজোগুনের প্রভাবে তা অহংতত্ত্বে পরিণত হয়৷ শেষে তমোগুণের প্রভাবে তা চিত্ততত্ত্বে (কর্মফল) এ পরিণত হয়৷
প্রতিমসঞ্চর ধারায় মানবমন বন্ধনমুক্ত হয় বা নির্গুণতত্ত্ব লাভ করে৷ মনের চিত্ততত্ত্বের ওপর থেকে তমোগুণের প্রভাব কেটে গেলে, তা (চিত্ততত্ত্ব) বুদ্ধি intellect) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ আবার সত্ত্বগুণের প্রভাবে ‘অহংতত্ত্ব’-এর পরিধির চেয়ে ‘মহৎতত্ত্ব’ বেড়ে গেলে ‘বোধি’ intuision)’-র বিকাশ ঘটে৷ এই বোধির সাহায্যে মানবমন সত্ত্বগুণের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভূমামনে সমাহিত হলে তাকে ‘সবিকল্প সমাধি’ বলে৷ আর পরিশেষে মন যখন ভূমাচৈতন্যে সমাহিত হয়ে যায় তাকে নির্বিকল্প সমাধি বলা হয়৷ এই নির্বিকল্প সমাধিই মানব মনের চরম বিকাশ প্রাপ্ত অবস্থা৷ মন এখানে প্রতিষ্ঠিত হলেই , জীবন, মৃত্যু, যন্ত্রণা, কর্মফলের প্রভৃতি সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে সে চিরমুক্ত হয়৷ এটাই আনন্দ তথা শান্তির প্রকৃত ধাম৷
যে ভূমাচৈতন্য (নির্গুণ ব্রহ্ম) থেকে প্রকৃতির সঞ্চর ধারায় একদিন সে এই পৃথিবীতে এসেছিল ও বহু খন্ড জীবনে আবদ্ধ হয়েছিল, প্রকৃতির প্রতিসঞ্চর ধারায় সেই সকল প্রকার বন্ধন ছিন্ন করে বিশুদ্ধ মন পুনরায় সেই ভূমাচৈতন্যে সমাহিত হয়ে যায় ৷ অবসান হয় তার সুদীর্ঘ পথ চলা৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments