পৃথিবীর বুকে অন্যান্য প্রজাতির জীবের মত মানুষও এক বিশেষ প্রজাতির (স্পেসিস্) জীব৷ এই মানুষের সভ্যতার কথা বলতে গেলে, ‘মানুষ’ ও ‘সভ্যতা’ ব্যাপারে কিছুটা ধারণা দরকার৷ কিন্তু সবার আগে একটা কথা, এই মানুষ নামক বিশেষ প্রজাতির জীবের নাম ‘মানুষ’ হল কেন? এটাও তো ভাববার কথা! এ বিষয়ে বহুল প্রচলিত সাধারণ ধারণাটা হচ্ছে---জীবকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষের মধ্যেই---সে যে মাত্রাতেই হোক না কেন ‘মান’ অর্থাৎ আত্মসচেতনতা-আত্মমর্যাদা বোধ ও হুঁশ অর্থাৎ বিচার প্রবণ মানসিকতা বা বিবেকবোধ আছে৷ তাই এই বিশিষ্ট জীব-প্রজাতির নাম হয়েছে মানুষ৷ বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ মিলে এলো (মান+ হুঁশ= মানুষ)জোড়কলম শব্দ মানুষ৷ আবার মানস-আত্মিক ভাবাত্মক ব্যঞ্জনায় বাংলা মানুষ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ মুণ্ডমাল শব্দ---Man’ এসেছে'm' for mind, 'n' for neat,'a' for associatio৷ তাই Man’ শব্দের মানে হলNeat association of mind) অর্থাৎ যে জীব-প্রজাতি বা ‘স্পেসিস’-এর মধ্যে মনের সব কটি গুণ বা উপাদান বা বৈশিষ্ট্য লগ্ণ হয়েছে সেই স্পেসিস্টাই মানুষ৷ দর্শন ও আধ্যাত্মবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘মন’ হচ্ছে ‘চিত্ত’,doer I) অহং,seer I) মহৎ operator I) ---এই তিনের সামবায়িক সমন্বয়িত অভিপ্রকাশ৷ মানুষ ছাড়া অন্যপ্রাণীর মধ্যে মনের ওই তিনের মধ্যে একটি বা দুটি গুণ বর্ত্তেছে, একমাত্র মানুষের মধ্যেই তিনটি গুনই রয়েছে৷ ইংরেজিতে এই মানুষকেই বলা হয়Man৷ পরিপূর্ণ-সামগ্রিক মনের জীব৷ তাই মানুষকে বলা হয় মননশীল জীব৷ মন কাজ করে মস্তিষ্কের মাধ্যমে ও ইন্দ্রিয়াবলীর সাহায্যে৷ মনের গুণ বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে বিশেষ দেহ আধার আদল (জীব মাত্রই মনের ঘটন অনুযায়ী শরীর পায়) যা আসলে একটা জৈববৈজ্ঞানিক যন্ত্র৷ এই যন্ত্রেই মানবমনের বাস, মন তো অতিন্দ্রিয় চেতন সত্তা, তাকে প্রত্যক্ষভাবে জানা বা বোঝা যায় না৷ মন এই জৈববৈজ্ঞানিক যন্ত্রের মাধ্যমেই নিজেকে প্রকট করে ও তার অস্তিত্ব---সক্রিয়তা জানান দেয়৷ দেখা , শোনা, বলাদি কোন ক্রিয়া-কর্মই মনের সক্রিয় উপস্থিতি ভিন্ন সম্ভব হয় না৷ মানুষের দশ ইন্দ্রিয়--- (চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা জ্বিহা-ত্বক---পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, বাক-পাণি-পাদ-পায়ু উপস্থ---পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়৷ (অবশ্য কোন কোন ভারতীয় দর্শনে মনকে বলা হয়েছে ষষ্ঠ জ্ঞানেন্দ্রিয়, অর্থাৎ এই বিচারে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা দাঁড়াল এগার৷ আর মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চিত্ত--- এইচারটি বলা হচ্ছে অন্তরিন্দ্রিয়)৷ এরা সবাই মনেরই বসে চলে, মন ছাড়া এরা এক পা-ও চলে না৷ এর মানে দাঁড়াল মানুষের অন্তঃকর্ম ও বহিঃকর্মের মূলে আছে মনের সক্রিয়তা৷ বিজ্ঞান বলে---প্রতিটি প্রাণীন সত্তা--- যা দশ ইন্দ্রিয়, সর্বাধুনিক উন্নতমানের যন্ত্রে কল্পনাতেও ধরা যায় না এমন সত্তাও দেহাধার পায় তার মনের বিকাশ-স্তর অনুযায়ী৷ তার মানে মনের স্থিতিস্থাপকতা (ইল্যাস্টিসিটি) আছে, মনকুণ্ডয়ন,---মনের তো সংকোচন-প্রসারণশীল৷ আবার মন তো একটা অতীন্দ্রিয় চেতন সত্তা, এর প্রকাশ ঘটে জৈব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আচরণগত অভিপ্রকাশে, ক্রিয়াশীলতায়৷ অর্থাৎ মানুষের সংরচনাগত পরিচয়ের পাশাপাশি একটা অভিপ্রকাশগত পরিচয়ও আছে---যা না থাকলে দেহাধারে মানুষ হলেও ‘কোন মানুষ’ আত্মিক পরিচয়ে মানুষ হিসেবে গণ্য হয় না৷ বলা হয় ---নররূপী পশু, মানুষ মত, কিন্তু মানুষ নয়! লক্ষ্যনীয়, জীব মাত্রই রয়েছে জীববৃত্তি৷ মানুষ যেহেতু জীব সেইহেতু তারও অন্যান্য পশুর রয়েছে জীববৃত্তি (খাওয়া, ঘুমানোৃ বংশবৃদ্ধি করা ইত্যাদি), কিন্তু তার বিশেষত্ব বুদ্ধিবৃত্তিতে বিবেকের উপস্থিতিতে৷ এ তো মানুষের ভিতরের পরিচয় বহন করে৷ আর এখানেই মানুষের সঙ্গে পশুর মৌলিক পার্থক্য৷ পশু চলে সহজাত বৃত্তি তাড়িত হয়ে, আর মানুষ চলে বিচারপ্রবণ তথা বিবেক সম্পৃক্ত বুদ্ধিচালিত হয়ে বুদ্ধি-বিবেক না থাকলে দেহটা মানুষের হলেও ভিতরটা পশুরই৷ তাইতো সমাজে মানুষ হয়ে ওঠার লড়াইটা লাগু হয়ে আছে৷ আশীর্বাদ করা ---তোরা মানুষের মত মানুষ হ, ‘‘আবার তোরা মানুষ হ’’৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments