মানুষের...খোঁজে....

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

 ইয়ূরোপীয় ঘরণার এই ‘জাতিরাষ্ট্র’ ব্যবস্থার মধ্যে ফলশ্রুতি হিসেবে দুটো আন্তঃশক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ যে কোন মূল্যে জাতিরাষ্ট্রের স্বার্থে---একদিকে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে গোষ্ঠীনির্মাণের প্রয়াস (কোয়্যালিশন), অন্যদিকে ক্ষেত্রীয় ও বাণিজ্যিক প্রাধান্যের লড়াই (কোয়্যালিশন ওয়ার) চলতে থাকে ---যা আধুনিক আন্তরাষ্ট্রিক ব্যবস্থা’ তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে মাত্রা দেয়৷ কয়েকটি দেশের কথা বাদ দিলে গোটা বিশ্বেই ইয়ূরোপীয় ধাঁচের জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার চল রয়েছে৷ তবে সমস্যা হচ্ছে---আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নেশন্‌ তথা জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে গড়ে ওঠার ফলে প্রতি মূহূর্তেই জাতিরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যায়৷ জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক দিকগুলোই এর জন্যে দায়ী৷ যেমন জাতীয়তাবাদের একটি বড় দোষ হচ্ছে নিজের নেশনের বা জাতিরাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধির  তীব্র বাসনা, আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকুলতা থেকে পররাষ্ট্র গ্রাস করা৷ বর্তমানে সাম্যবাদী চীন যা করছে, সোভিয়েতের আড়ালে রাশিয়া যা করেছে, ফ্রান্স বরাবরই একই উদ্দেশ্যেই ‘স্বাভাবিক সীমান্ত’-এর সম্প্রসারণের চেষ্টা করে গেছে, জার্র্মনরাও ঊনিশ শতকে সমগ্র মধ্য ইয়ূরোপের ওপরেই আধিপত্য দাবী করেছিল, একই ভাবে বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল, স্পেন পর্তুগাল কেউই মওকা ছাড়েনি৷

জাতীয়তাবাদের এই গলদের দিকে নজর গেলে কয়েকটা কথা সততই সামনে এসেই যায়৷ যেমন আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, একটি রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠীর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে চেতনা থেকে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় ও জাতীয়তাবাদ তৈরী করে জাতিসত্তা (ন্যাশ নালিজম্‌-ন্যাশনালিটি-জাতীয়তাবাদ-জাতিসত্তা)৷ কিন্তু, সোজাসুজি কথাটা শুনতে বেশ ভালই লাগে৷ কিন্তু বাস্তবটা ঠিক এর উল্টো৷ নৃবিজ্ঞানকে, সভ্যতার বিবর্তনের ধারা একেবারে ঠাণ্ডাঘরে পাঠিয়ে দেয়া হল৷ কেননা বাংলা ‘জাতি’ শব্দটি অনেক অর্থেই ব্যবহৃত হয়, যেমন একই বৈশিষ্ট্যের গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ বা নরগোষ্ঠী (রেস), ধর্মীয়-উপধর্মীয়-পেশা ভিত্তিক সম্প্রদায়, জীবের স্পেসিসের ধরন ইত্যাদি৷ আর সত্তা হচ্ছে---সৎ তা --- সৎ মানে  যা অস্তিত্বশীল, বিদ্যমান, নিত্য৷ ‘তা’ সাফিক্স বা প্রত্যয় যোগে গঠিত ‘সত্তা’ পরপদে বসে পূর্বপদের নিত্যতা বা বিদ্যমানতা বা অস্তিত্বের গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে৷ কাজেই ‘জাতিসত্তা’ বলতে বোঝায় জনগোষ্ঠীগত প্রাণধর্ম বা যা কোন জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও বিদ্যমানতাকে ধরে রাখে৷ নৃবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘এথ্‌নিসিটি’৷ তাই জাতিসত্তা স্বরূপে এথনিসিটি, বৈবহারিক রূপ ‘এথনিক্‌ গ্রুপ’, বাংলায় বলা যায় জনগোষ্ঠী৷ কাজেই জাতি বা নেশন আর জাতিসত্তা বা এথ্‌নিসিটি এক নয়, জাতীয়তাবাদ থেকে জাতিসত্তার উদ্ভব হয়নি৷ বরং জাতিসত্তা জাতীয়তাবাদ উদ্ভবের অন্যতম একটা নেপথ্য শক্তি৷ একটা নেশনের মধ্যে, জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতিসত্তা (এথনিক গ্রুপ) থাকতে পারে, এন্টিসেন্টিমেন্ট-বিরুদ্ধ ভাবাবেগ তাদেরকে  একটা নেশনে পরিণত করে৷ কিন্তু জাতিসত্তা একক, অনন্য৷ যেমন বর্তমান ভারত জাতিরাষ্ট্রে-নেশনে ৪৪টি ‘এথনিক্‌ গ্রুপ’ বা জনগোষ্ঠী আছে৷ একইভাবে বিশ্বে ২৫৪টি প্রধান এথ্‌নিক্‌ গ্রুপের পরিচয় পাওয়া যায় বলাবাহুল্য, আধুনিক সমাজ চেতনায় জাতীয়তা, জাতিসত্তা বা এথ্‌নিসিটির চর্চা একটা জায়গা করে নিয়েছে৷ ব্যাপারটা আসলে পৃথিবীর ও তার মানুষের একটা ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, আর মানব মনের বিকাশের ধারাও বটে৷ আনুমানিক ৪০০ কোটিবছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি৷ আনুমানিক দশ লক্ষ বছর আগে স্বতন্ত্র স্পেসিস্‌ হিসেবে পৃথিবীতে মানুষ এসেছে, আর পনের হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব৷ তবে মানুষের সভ্যতার সূত্রপাত ও পনের হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের আসা ও তার ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনে পৃথিবীতে ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে৷ আবার সময়ের  সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভূপৃষ্ঠে কোন স্থানের বা অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান প্রাকৃতিক নিয়মেই এনেছে - রূপান্তর -বৈচিত্র্য-স্বাতন্ত্র্য৷ নৃতত্ত্ববিজ্ঞান বলে---মানুষের পূর্ব পুরুষ এক৷ নৃতত্ত্ববিজ্ঞান জীবের বিবর্তনের ধারায় আসা মানুষের সেই পূর্বপুরুষের নাম দিয়েছে ‘অষ্ট্রালোপিথেসিন্‌’৷--- তবে সেটা বর্তমান মানুষের  চেহারার আভাস মাত্র৷ এটা দশ লক্ষ বছর আগেকার ঘটনা৷  তবে এই অষ্ট্রালোপিথেসিন্‌রাই যখন লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায় হোমোইরেকটাস থেকে হোমোস্যাপিয়েনস্‌ রূপে এলো তখন থেকেই মানুষের  বর্তমানের মত অনেকটা আদলটা পাওয়া গেল৷ অর্থাৎ এই হোমোস্যাপিয়ানস্‌রাই মানুষের প্রথম পূর্বপুরুষ৷ তবে সেটাও আনুমানিক পনের হাজার বছরের খুব বেশী আগের ঘটনা নয়৷

নৃবিজ্ঞানের পাতা ওলটালে দেখা যায় পৃথিবীতে আদিম মানুষের আবির্ভাব হয় গুটিকয়েক নির্দিষ্ট অঞ্চলে৷ কেননা তখনো হিমযুগের শেষ স্তরে পৃথিবীর সব জায়গা মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি৷ যত দূর জানা যায়---আগে পরে যাই হোক না কেন আল্পস-ককেশাসের পাদদেশ ইয়ূরালের পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চল,গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-দক্ষিণ পাড়, ইয়াংসিকিয়াং ও সিকিয়াং নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল হচ্ছে মানুষের পূর্বপুরুষদের (হোমোসেপিয়ানসদের) আবির্ভাব ক্ষেত্র৷ তবে গণ্ডোয়ানা ল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চলেই বিশেষ করে আদি-বাঙলার রাঢ় অঞ্চলে মানুষের প্রথম আবির্ভাব বলে ধারণাটা ক্রমশঃ দৃঢ় হচ্ছে,---যদিও এখনও অনেক বিজ্ঞানীই আফ্রিকা মহাদেশকেই সেই স্থান দিয়ে চলেছেন৷ তবে উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে যে মানুষের ও তার সভ্যতার বিবর্তন ধারার তিনটি স্তরের অর্থাৎ আদি প্রস্তর, মধ্য প্রস্তর ও নব্য প্রস্তর যুগ---এই তিন যুগের নিদর্শনই একমাত্র রাঢ় অঞ্চলে পাওয়া গেছে, অন্যত্র একটি বা দুটির বেশী নয়৷ যাই হোক, ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশগত কারণেই সময়ের ব্যবধানে অঞ্চলের গোষ্ঠী ভেদে তাঁরা রক্ত (রক্তের উষ্ণতা), নাকের গঠন, চোখ, ত্বক বা গায়ের রঙ, দৈর্ঘ্য ও চুল--- এই ছয়টি অঙ্গের পার্থক্যে নৃবিজ্ঞানের বিচারে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আবির্ভূত মানুষের পূর্ব পুরুষেরা স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য পায়৷ নৃবিজ্ঞান একে এক কথায় নাম দিয়েছে ‘রেস’ (জাতি)৷ রেস-জাতি হ’ল বিশ্বে বিভিন্ন দেহসংরচনার পার্থক্য নিয়ে গড়া মানুষ৷ পৃথিবীতে আর্য, অষ্ট্রিক, নিগ্রো ও মঙ্গোলীয়--- মুখ্যতঃ এই চারিটি রেসের উদ্ভব হয়েছে---অবশ্য রেস্‌গুলোর মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীও আছে৷ যেমন আর্য,---আর্যদের তিনটি শাখা রয়েছে---নর্ডিক (নর্ডিক কথাটার অর্থ হচ্ছে, ‘উত্তর’, লাতিন ‘নর্ড’ কথাটা থেকে নর্ডিক শব্দটা এসেছে), আলপাইন ও ভূমধ্যসাগরীয়৷ এই আর্যদের আদি বাসস্থান ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যাঞ্চলে--- ককেশীয় পর্বতমালার সন্নিহিত এলাকায়৷

এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল---মানুষের পর্বতমালার রেস্‌ গঠনে মুখ্য ভূমিকা নেয় তার বসবাসের ভৌগোলিক অবস্থান ও তার প্রাকৃতিক পরিবেশ৷ আর তাকে যোগ্য সঙ্গ দেয় বিশেষ পরিবেশে যূথবদ্ধ জীবন ও জীবনযাপনের ধরন৷ তবে পুরোটাই ভৌমিক ও বাইরের৷