পূর্ব প্রকাশিতের পর,
রেসে রেসে লড়াই, তারপর মিলন, মিলনের পর একতা, একতা দিল যুথবদ্ধতা ও সময় সেই যূথবদ্ধতায় আলন স্বাতন্ত্র্য বোধ ও আত্মসচেতনতা, সৃষ্টি হল বিশেষ বিশেষ জীবনধর্মের জাতিসত্তা তথা জনগোষ্ঠী৷ আর এইসব কিছুই ঘটেছে সংশ্লিষ্ট নোতুন প্রজন্মের জনগোষ্ঠীর বাসভূমি রূপ বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলকে ঘিরেই৷ অর্থাৎ মানব সমাজে সঙ্করায়নে তথা কোন মানব গোষ্ঠীর পরিপূর্ণ রূপ পেতে দাম্পত্য সম্পর্কের সঙ্গে প্রকৃতি তথা নির্দিষ্ট ও বিশেষ বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের বিরাট ভূমিকা আছে---এসব ইতিমধ্যে বলাও হয়েছে৷ এই ভূমিকার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে সাংবেদনিক উত্তরাধিকার৷ মানে স্থানীয় (বিশিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের) ভাষা - সাহিত্য - ঐতিহাসিক-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সাধারণপ্রথা-সংস্কৃতি- অর্থনৈতিক জীবন ধারা ইত্যাদির জারিত-মথিত একটা সামবায়িক অবস্থা৷ দ্বিতীয়তঃ এক একটা ভৌগোলিক অঞ্চলে মানুষের ওপরে, মানুষ ছাড়া অন্য জীবে - গাছপালায় -জীবনধারায় -বায়ুমন্ডলে-জলবায়ু ইত্যাদিতে যে স্বাতন্ত্র্য, বিশেষত্ব, অভিনবত্ব দেখা যায় তার পিছনে কাজ করে বিশিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের সঙ্গে সূর্যের কৌনিক অবস্থান ও তার ফলে সূর্যরশ্মির পতন কোণের প্রভাব জনিত তাপীয় ফল ও সূর্য ও পৃথিবীর অভিকর্ষজ মহাকর্ষজ বল, সেই সঙ্গে অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ ও নক্ষত্রের আকর্ষণ বল৷ তাই অঞ্চল ভেদে মানবগোষ্ঠীর চেহারায়, আচার আচরনে, অভ্যাসে, খাদ্যে-পোশাকে প্রভৃতিতে আলাদা ভাবটা সহজেই বোঝা যায়৷ ফলে জনসমুদ্রের মাঝ থেকে খুব সহজেই বাঙালীকে চিনে নেওয়া যায়৷ অর্থাৎ মহামানব সমুদ্রের বুকে বাঙালী একটা স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী৷ আর বাসভূমি অর্থে ‘স্থান’---সাফিক্স্ যোগে বাঙালীর বাসস্থান হচ্ছে বাঙালীস্থান’৷
তিন---মহাসমুদ্রে যেভাবে বিভিন্ন নদী তাদের আপন পরিচয় হারিয়ে ফেলে তেমনি মানুষ তার প্রাথামিক নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ‘রেস’কে হারিয়ে ফেলেছে একালের অঞ্চলে অঞ্চলে নবীন জনবিন্যাসে৷ নৃতত্ববিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন এথ্নিক গ্রুপ বা জনগোষ্ঠী৷ এঁদের স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যকে বলছেন এথ্নিসিটি বা জাতিসত্তা৷ এই বিচারে বিশ্বে প্রধান ২৫৪টি, ভারতে ৪৪টি জাতিসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ রেসের স্থান নিল এথ্নিসিটি বা ‘জাতিসত্তা’ ---(নরগোষ্ঠী জনগোষ্ঠী)৷ একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে৷ এইসব জনগোষ্ঠীগুলোর বাসভূমির বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জনগোষ্ঠীগুলোর নামকরণও হয়েছে, যদিও এখন ভূমির নামেই পরিচয়ের চেয়ে ভাষার পরিচয়েই জাতির পরিচয় হয়ে থাকে৷ যেমন দেশে বিদেশে বাঙলার এককালে পরিচয় হয়েছিল গৌড় নামে৷ বাঙলায় সে সময় নানা ধরণের গুড় পাওয়া যেত নানা দেশে রপ্তানিও হোত, এর থেকে দেশটার নাম হয়ে গেল ‘গৌড়৷ গৌড়ের অপর নাম ছিল বঙ্গ৷ বঙ্গ মানে ধাতুজাত পদার্থ, ধাতু বিশেষ টিন বা রাঙতা, অপর মানে ‘বাঙলা’৷ আবার ‘বং’ আধ্যাত্মিকতার বীজমন্ত্র৷ আর ‘গ’---হচ্ছে চলা৷ অর্থাৎ যে দেশ আধ্যাত্মিকতাকে সঙ্গে করে নিয়ে পথ চলে--- সেই দেশ হল ‘বঙ্গ’৷ মাটির পরিচয় গৌড়বঙ্গের অধিবাসীদেরই বলা হয় বাঙালী৷
জগতে যবে থেকে জাতিসত্তা---এথ্নিসিটি দানা বাঁধতে শুরু করে তখন থেকে কেন তার আগে থেকেই অনেক কিছুই পালটে চলেছে৷ লোকসংখ্যা বাড়ছে৷ সংকরায়নে ও মিলনে জনগোষ্ঠীর পরিধি বাড়ছে৷ এই সঙ্গে ঠাঁই পেতে ও নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা অভাব মেটাতে বাসযোগ্য বাসভূমির এলাকাও বাড়ছে৷ আবার ক্ষমতালোভী, মুনাফা খোর, সম্পদলোভীরা ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজ এলাকার পরিধি বাড়িয়েছে, অন্য জনগোষ্ঠীর এলাকায় নানান ধরণের আধিপত্য বিস্তার করেছে৷ সময়ের সঙ্গে নূ্যনতম প্রয়োজন (একেবারে যা না পেলে বাঁচাই যায় না) ও চাহিদার ধারনা পাল্টেছে৷ আদিম মানুষের পশুর মত---পেট ভরা আর একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই এক সময় চলে যেত৷ তারপর প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে ও লজ্জার হাত থাকে বাঁচাতে পরিধান না হলে চলেই না৷ জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে ও জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলতে শিক্ষা না হ’লে চলবে না৷ শরীর থাকলেই অসুখ-বিসুখও থাকবে৷ তাই ওষুধপত্রও চাই৷ একে একে নিত্যপ্রয়োজনীয় নূ্যনতম প্রয়োজনের ক্ষেত্রটা বাড়তে বাড়তে একটা মানদণ্ডে পৌঁছে গেল৷ অর্থাৎ যা না থাকলে, বা না পেলে ধরায় টিকে থাকা বেঁচে থাকা যাবে না৷ সেই নূ্যনতম প্রয়োজন জনিত চাহিদা ও অভাবগুলো স্থায়ীভাবে সমাজে সর্বজনীন ও সর্বকালীন রূপ প্রকাশ হয়ে পড়ল৷ ভিতরে বাইরে জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের মনেরও বুদ্ধির বিকাশে সমাজে এসেছে ও আসছে বিলাস দ্রব্য ও অতিরিক্ত সুখ-সুবিধার আকাঙ্ক্ষা৷ বদলে যাচ্ছে জীবনশৈলী৷ কিন্তু বাস্তব জগতে বেঁচে থাকতে, টিকে থাকতে ও জগৎ ও জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে কিছু না কিছুর অভাব বোধ হয়েছে, এবং তা পূরণের জন্যে চাহিদারও সৃষ্টি হয়েছে৷ এ চাহিদা কখনো সীমিত, প্রয়োজন মতো, কখনো বা তা সীমাহীন৷ কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে ---পৃথিবীটাতো আর সীমাহীন নয়, তাই মানুষের অভাব পূরণের সম্পদও অফুরন্ত নয়৷ সীমিত সম্পদ দিয়েই মানুষেক সীমাহীন চাহিদার মোকাবিলা করতে হয়৷ আদিতে থাকা-খাওয়া-পরা হলেই চলে যেত৷ কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ নানা আবিষ্কার ও নানা ভোগ্য দ্রব্যের উদ্ভাবনের ফলে মানুষের জীবনযাপনের ধরণ-ধারণ পাল্টেছে, চাহিদারও পরিধি বেড়েছে৷ তাই অবস্থা সামাল দিতে একে ঘিরে হয়েছে শাস্ত্রের উদ্ভব৷ (মানে---অভাব পূরণের জন্যে পদ্ধতি প্রকরণ-নিয়মকানুন-নীতিনির্ধারণ সম্বলিত বিষয়৷ সংসৃকতে একে কথায় বলে শাস্ত্র---শাসনাৎ তারয়েৎ যস্তু স শাস্ত্রঃ পরিকীর্তিতঃ)৷ তাই শাস্ত্রটির নাম অর্থশাস্ত্র বা অর্থনীতি যার আধার সংশ্লিষ্ট অধিবাসীদের স্বাভাবিক বাসভূমি বা ভৌগোলিক অঞ্চল তথা এক একটা স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ (যার মানে এমন ভৌগোলিক অঞ্চল যেখানে কোন কিছুর জন্যেই কখনো অন্যের ওপর বা অন্য অঞ্চলের ওপর নির্ভর করতে হয় না, বহিরাগতদের খবরদারিও থাকে না৷ যেখানেই অন্যের ওপর নির্ভরতা, বাইরের হস্তক্ষেপ সেখানেই শোষণ-বঞ্চনা অবদমন-পীড়ন-এর দরজা হাট করে খোলা)৷ আদতে সমস্ত পৃথিবীটাই সৌরজগতের বুকে একটা অখণ্ড স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হলেও বিশ্বের জনগোষ্ঠীগুলোর প্রকৃতিগতভাবে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক এলাকাগুলোর প্রতিটি তার সঞ্চারী ও গাঠনিক প্রাথমিক একক৷ এই কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বা নূ্যনতম প্রয়োজনের দ্রব্যের, বিলাস দ্রব্যের, সাধারণ বা সবের্বাচ্চ সুখ সুবিধার অভাব মেটাবার জন্যে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর বা জাতিসত্তার জন্য, বাইরের হস্তক্ষেপ মুক্ত শোষণমুক্ত স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকাটা অত্যন্ত জরুরী৷ এই অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মনে একই ধরণের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও চাহিদা তৈরী করে, এক ধরণের একতা বোধও আনে৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments