বাংলাভাষায় শুধু ‘ণ’ (নঁ) নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার খুবই সীমিত তথা পরিমিত৷ জনসাধারণের মধ্যে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার কম থাকায় মানুষের থেকে ভূতের তফাৎ বোঝাবার জন্যে ভূতের মুখে বেশী চন্দ্রবিন্দুযুক্ত ভাষা ব্যবহার করা হয়৷ তফাৎ বোঝাবার জন্যে এত বেশী চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার করা হয় যা অস্বাভাবিক......যা ঠিক ফরাসী ভাষায় উল্টো৷ ফরাসী ভাষায় চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারে অতি প্রাবল্য৷
সেদিন কথা হচ্ছিল বাঁশবেড়ের বাঁকাচাঁদ বাঁড়ুজ্জের (‘ব্যানার্জী শব্দটা অশুদ্ধ৷ ‘বন্দোপাধ্যায় অথবা ‘বাঁড়ুজ্জে’ বলতে হবে৷) সঙ্গে৷ সে একবার কাঁসার বঁড়শি কেনবার জন্যে চাঁপদানি গেছল৷ রাস্তায় পড়ল পেল্লায় একটা মাঠ.......কাছেপিঠে কোন গাঁ–গঞ্জ নেই.....চারদিক খাঁ খাঁ করছে৷ সন্ধ্যে হয়ে আসছে৷ তার গায়ে কাঁটা দিল৷ তার পরে এল গোরুটির (গৌরহাটি) জঙ্গল৷ কয়েক পা এগিয়ে সে দেখলে একটি প্রকাণ্ড আঁব গাছ৷ সে দেখলে কাছেই গঙ্গা–সেখানে কুমীর আর জঙ্গলে রয়েছে কুঁদো বাঘ৷ তাই সে গাছটায় চড়ে উঠে পড়ল একেবারে মগডালে৷ ভয়ের কাঁপুনি তার তখনও থামেনি৷ এদিকে দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল৷ হঠাৎ দেখলে তার কয়েক পা নীচেই একটা মোটা ডালের ওপর বসে ময়দা মাখছে একজন মহিলা৷ মহিলা তাকে শুধোলে–‘‘তুমি কেঁ গোঁ, এঁই রাঁত বিঁরেতে মঁগডাঁলে উঠে বঁসেছ হাঁওয়া খেঁতে? আঁমাদের এঁখানে পাঁর্ক–টাঁর্ক নেঁই বঁটে কিঁন্তু বেঁড়াবার মঁত বড় বড় ভাঁগাড় তোঁ আঁছে৷ সেঁখানে হাঁওয়া খেঁতে গেঁলে নাঁ কেঁন গাঁ’’?
বাঁকাচাঁদ বললে–‘‘আমি হাওয়া খেতে বেরোইনি–যাচ্ছি চাঁপদানি’’৷
মহিলা জিজ্ঞেস করলে–‘‘তুঁমি কিঁ আঁবগাছটাঁকে চাঁপদানি ভেঁবেছ’’?
বাঁকাচাঁদ বললে–‘‘তা নয়, আমি গাছে উঠেছি কুঁদো বাঘের ভয়ে’’৷
মহিলা বললে–‘‘তাঁ বেঁশ, তাঁ বেঁশ৷ তাঁহলে তুঁমি আঁমার অঁতিথি৷ তোঁমার খাঁওয়া–দাঁওয়া হঁয়েছে? তোঁমার গঁলার আঁওয়াজ শুঁনেই মঁনে হঁচ্ছে তোঁমার জঁল তেঁষ্টা পেঁয়েছে’’৷
বাঁকাচাঁদ দেখলে মহিলার মাথায় টকটকে সিঁদুর. তাই সে তাকে দিদি না বলে বউদি বললে৷ সে বললে, –‘‘হ্যাঁ, বউদি, তেষ্টা পেয়েছে’’৷
মহিলা তখন তার লম্বা হাত বাড়িয়ে দিয়ে দু’ক্রোশ দুরের গঙ্গা থেকে এক ঘটি জল এনে তাঁকে দিয়ে বললে–‘নাও ঠাঁকুরপোঁ, খাঁও’’৷
বাঁকাচাঁদের তেষ্টা তখন মাথায় উঠেছে৷ তার মনে প্রশ্ণ জাগল এ মানুষ না পেত্নী৷ বাঁকাচাঁদ বললে–‘‘তুমি কে বউদি, তোমার পরিচয় দেবে’’?
মহিলা বললে–‘‘গঁভীর রাঁতে আঁমার পঁরিচয় জেঁনো নাঁ ঠাঁকুরপোঁ, তাঁতে তোঁমার সুঁবিধে হঁবে৷ সঁকাল বেলায় সূঁয্যি উঁঠলে তোঁমাকে আঁমার পঁরিচয় দিয়েঁ গাঁছের আড়াঁলে নুঁকিয়ে যাঁবো৷’’
বাঁকাচাঁদের হাত–পা থরথর করছে, বুক ধড়ফড় করছে৷ এ কোথায় এলুম রে বাবা’’
–‘‘বাঘের ভয়ে চড়লুম গাছে,
ভূত বলে পেলুম কাছে’’৷
মহিলা বললে–‘‘তাঁড়াতাঁড়ি হাঁত মুঁখ ধুঁয়ে নাঁও৷ বেঁশী কিঁছু রাঁধতে পাঁরিনি৷ কঁটা নুঁচি আঁর আঁলুর দঁম খেঁয়ে নাও৷ জাঁন তো আঁমাদের হুঁগলী জেঁলার আঁলু ডাঁকসাইটে৷ আঁমার বাঁপের বাঁড়ী, মাঁমার বাঁড়ী, শ্বঁশুর বাঁড়ী–তিঁনই হুঁগলী জেঁলায়’’৷
খেয়ে প্রাণটাকে একটু শীতল করে নিয়ে ভয় একটু কমিয়ে দিয়ে বাঁকাচাঁদ বললে–‘‘বউদি, ঘুম আসছে না, আমাকে একটা গল্প বল’’৷
বউদি বললে–‘‘আমার শ্বশুর বাড়ী এখান থেকে পশ্চিম দিকে বলারামবাটী গ্রামে, আমার বাপের বাড়ী বদ্যিবাটী (বৈদ্যবাটি), মামার বাড়ী শিবরামবাটী, পিসীর বাড়ী জনাই আর মাসীর বাড়ী ভাণ্ডারহাটী৷ আমার বিয়ে হয়েছিল তিন বছর বয়সে৷ বিয়ের সময় আমি আমার দিদিমার কোলে শুয়ে শুয়ে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছিলাম৷ বরের বয়স ছিল সাতাশি৷ সে ছিল কুলীন বামুন–কাব্য–ব্যাকরণ–সাংখ্৷ বিয়ের পরে এয়োরা যখন শাঁখ বাজাচ্ছিল সেই শাঁখের আবাজে আমার বরের বুক ধড়ফড় করে ওঠে৷ তাতেই সে হার্টফেল করে মারা যায়৷ আমি দিদিমার কোলে শুয়ে শুয়েই বিধবা হলুম৷ বামুনের মেয়ে, দু’বার তো বিয়ে হবে না৷ দিদিমা কেবল আমার গালে ঠাস করে চড় মেরে বললে–পোড়ারমুখী, তুই কেন বামুনের ঘরে জন্মেছিলি? তাইতে এমন বেঘোরে মরতে হচ্চে আমার ভাশুরদের বয়স তখন বিরানব্বই৷ দেওরেরা সবাই তখন ঘাটের ওপরে৷ তারা বলা বলি করছিল–এ পোড়ারমুখীটাকে যদি বাঁচতে দেওয়া হয় তা হলে সে সম্পত্তি তো ভোগদখল করবেই, বেচতে কিনতে পারুক না পারুক৷ তাই এ হতচ্ছাড়িকে স্বামীর সঙ্গে চিতায় পুড়িয়ে সতী* (*সাধাণতঃ সেই অন্ধকার যুগে নারীরা তিনটি অবস্থায় সহমরণের হাত থেকে রেহাই পেত–(১) যে নারী গর্ভবতী অবস্থায় থাকত, (২) যে নারীর দুগ্ধ পোষ্য শিশু থাকত, (৩) যে নারী স্বামীর মৃত্যুকালে নিজের পিত্রালয়ে থাকত ও পিতামাতা কন্যার প্রতি মমতাবশতঃ তাকে অনুমৃতা হতে দিতেন না৷ মহাভারত অনুযায়ী পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী মাদ্রী অনুমৃতা হয়েছিলেন৷ কুন্তী তাঁর নিজের তিনপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের সঙ্গে মাদ্রীর দুই পুত্র নকুল ও সহদেবেরও লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন৷ যে সকল জনগোষ্ঠীতে বিধবাবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল না সতীদাহ প্রথা তাদের মধ্যেই চলত৷) করে দেওয়া হোক৷ পোড়ামুখী স্বর্গে গিয়ে অনন্ত কাল মাছ–ভাত খাক্ গে৷ তারা আমার স্বামীর সঙ্গে আমাকেও পুড়িয়ে মারলে৷ আমি আগুনের জ্বালায় চীৎকার করে চিতা থেকে লাফিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলুম৷ ভাশুর–দেওররা আমাকে বাঁশে করে চেপে ধরে আগুনে পুড়িয়ে মারলে৷ আমার হাত–পাগুলো তারা আগেই বেঁধে দিয়েছিল৷ যেখানটায় আমাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল লোকে অনেকখানি সিঁদুর ঢেলে দিলে, বললে–সতীর স্থান৷ আহাহাহা কী পূণ্যিবতী মেয়ে ছিল গা তিন বছর বয়সে হাসতে হাসতে সতী হয়েছিল এখনও সেই জায়গাটায় গ্রামের মেয়েরা সিঁদুর ছুঁইয়ে সেই সিঁদুর সিঁথেয় পরে৷ বলে–আমিও যেন ওই রকম সতী হতে পারি৷ কিন্তু জান ঠাকুরপো, তারা কেউই স্বামী মরে গেলে আজকাল আর সতী হয় না৷ বরং স্বামীর পকেট থেকে চাবিগাছাটা বের করে নিজের আঁচলে বেঁধে ফেলে৷ তা ঠাকুর–পো, মুখ ফসকে তোমাকে প্রাণের কথা বলেই ফেললুম৷ সেই থেকে আমি পেত্নী হয়ে এই আঁবগাছটায় রয়েছি আর ঠিক করেছি কোন শিক্ষিত বিচারশীল ছেলেকে দেখলেই তাকে আমার দুঃখের কথা বলব৷ আর বলব, সমাজের যে মাতবক্ষর গুলো সমাজ রক্ষার নামে পৈশাচিকতা করে গেছে ও আজও করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে যেন আক্কেল জাগিয়ে দেওয়া হয়’’৷
পেত্নী–বউদির গল্প শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেল৷ বাঁকাচাঁদ গাছ থেকে নেবে পড়ল৷
সে বললে–‘‘পেত্নী–বউদি, তোমার নামটা কী জানতে পারি’’?
পেত্নী–বউদি বললে–‘‘আঁমি তোঁমার বউদি, এঁইটাই পঁরিচয়৷ নাঁম বঁলে আঁর কেঁলেঙ্কারী বাঁড়াব না’’৷
পেত্নী বাঁকাচাঁদকে শুধোলে–‘‘ঠাঁকুর–পো, বঁড়শি কি’নে ঘঁরে ফিরতে তোঁমার অ’নেক দেঁরী হঁয়ে যাঁবে৷ জঁলখাবার কিঁ খেঁয়ে যাঁবে?’’
বাঁকাচাঁদ বললে–‘‘কাল রাত্রে পেট ভরে খেয়েছি৷ এত ভোরে তো খিদে পায় নি৷ কী করে খাই বল’’
পেত্নী বললে–‘‘তঁবে তুঁমি এঁকটু বঁস৷ আঁমি এঁকটু জলখাঁবার তৈঁরী কঁরে টিফিঁন কেঁরিঁয়ারে ভঁরে দিঁচ্ছি, সঙ্গেঁ নিঁয়ে যাঁও৷ আঁর নিঁয়ে যাঁও সঁঙ্গে এঁক ফ্লাঁক্স দুঁধ৷ তেঁষ্টা পেঁলে খেঁও৷ জাঁন তোঁ এঁখানকার জঁল ঠিঁক ভাঁল নয়’’৷
বাঁকাচাঁদ বললে–‘‘বউদি, তোমাকে একটু প্রণাম করি দাঁড়াও’’৷ প্রণাম করতে গিয়ে সে বউদির পায়ের পাতা খুঁজে পাচ্ছে না৷ সে আরও দেখলে তার সামনের দিকে রয়েছে গোড়ালি’’৷
পেত্নী বললে–‘‘ঠাঁকুরপো, তুঁমি ভুঁলে গেঁলে আঁমি যেঁ পেঁত্নী৷ সঁতী হঁয়ে স্বঁর্গে যাঁইনি– অঁপঘাতে মঁরে পেঁত্নী হঁয়েছি৷ ঠাঁকুর–পোঁ, তুঁমি মাঁনুষ৷ তুঁমি পেঁত্নীকে প্রণাঁম কঁরতে যাঁবে কোঁন দুঁঃখে জাঁন তোঁ, ভূঁত–পেঁত্নীদের গোঁড়ালি থাঁকে সামঁনের দিঁকে৷ আঁর পাঁয়ের পাঁতা থাঁকে পেঁছন দিঁকে’’৷
‘‘তাদের সুমুখ দিকে গুড়মুড়ো* (*গুড় অর্থাৎ গোড় অর্থাৎ পা৷ মুড়ো অর্থাৎ মাথা অর্থাৎ পায়ের যা মাথা তাই গুড়মুড়ো৷ বর্ত্তমানে শহুরে বাংলায় আমরা ‘গোড়ালি’ শব্দই বেশী বলে থাকি) আর পেছন দিকে পা৷’’
পেত্নীকে প্রণাম করবার জন্যে বাঁকাচাঁদ তার পেছনের দিকে গেল৷ পেত্নী অনেক কাকুতিমিনতি করে বললে–‘‘ঠাঁকুরপো, তুঁমি শিঁক্ষিত ভঁদ্দরনোক৷ আঁমি আঁব গাঁছের পেঁত্নী৷ তুঁমি আঁমাকে পেঁন্নাম কঁরবে কেঁন? দোঁহাই ঠাঁকুরপো, দোঁহাই ঠাঁকুরপো, আঁমাকে পেঁন্নাম কঁরো নাঁ’’৷
বাঁকাচাঁদ কোন কথা না শুনে পেছন দিকে গিয়ে পেত্নী–বউদির পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বললে– ‘‘তোমাকে পেন্নাম করে আমার পৃথিবীতে আসা সার্থক হ’ল৷ আশীর্বাদ কর, তোমার কথাগুলো যেন আমার চিরকাল মনে থাকে’’৷
বাঁকাচাঁদ এই কথাগুলো আমাকে বলবার সময় অঝোরে কেঁদে ছিল৷