মধুর বহুমুখী গুণাগুণ সম্পর্কে অধিকাংশ লোকে অবগত নন৷ সাধারণ মানুষ ভেবে থাকেন কিছু রোগ আরোগ্যেই এর প্রয়োগ হয়ে থাকে মাত্র৷ কিন্তু মধু যে একটি উত্তম আহার্য্য ও পানীয় সে বিষয়ে সবাই জ্ঞাত নন৷ আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে মধুর গুণাগুণ জানতে পেরে পাশ্চাত্ত্য দেশের বহু লোক মধুর উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে বিশেষ সচেষ্ট হয়েছেন৷ অনেকে সেই দেশগুলিতে এখন গুড় চিনির ব্যবহার কমিয়ে মধুর ব্যবহার করতেও শুরু করেছেন৷ ভারতবর্ষের যোগী ও মুনি ঋষিরা অবশ্য প্রাচীন কাল থেকেই এর গুণাগুণ সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে অবগত ছিলেন৷
যাঁরা যোগ সাধনা করেন তাঁদের পক্ষে এ যুগে খাদ্যাখাদ্য বিচার ও নির্বাচন একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷ যোগ সাধকরা যে ধরণের খাদ্য পেতে চান তা সচরাচর বাজারে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়৷ যোগীরা এমন ধরণের সহজ পাচ্য ও লঘু ধরণের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে চান যেগুলি অল্প সময়ে ও সহজে
হজম হয়ে যাবে৷ পেট হালকা ঠাণ্ডা রাখবে আর শরীরে যথেষ্ট বলও পাওয়া যাবে৷ এ ধরণের মানসিকতার বশবর্ত্তী হয়েই প্রাচীনকালের যোগী ও তান্ত্রিকরা ফল মূল, গো–দুগ্ধ ও মধু ইত্যাদি আহার্য্য ও পানীয় গ্রহণে বেশী ইচ্ছুক থাকতেন৷ যোগ সাধকদের পক্ষে মধুএক উপাদেয় আর আদর্শ আহার্য্য পানীয় বলে গণ্য হয়৷
মধুর বিভিন্ন নাম
ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে তিনটি শাখাতেই (আয়ূর্বেদ, যৌগিক ও প্রাকৃত) মধুর কম বেশী প্রয়োগ রয়েছে৷ মধুর ওপরে গভীরভাবে গবেষণা করে আয়ূর্বেদ শাস্ত্র মধুকে বিভিন্ন নামে আখ্যাত করেছে৷ যেমন–মধু, মাক্ষিক, মাধবীক, ক্ষৌদ্র, সারধ্য প্রভৃতি৷ এগুলি সবই মধুর পর্যায়ে পড়ে কিন্তু তাদের স্বাদ, বর্ণ ও উপাদানগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়৷
আধুনিক বিজ্ঞানে আর যৌগিক চিকিৎসায় মধুর ব্যবহার সম্পর্কে যে সব বিজ্ঞানসম্মত ও পরীক্ষাগত ফলাফল পাওয়া গেছে সেগুলি এ প্রবন্ধে ব্যবহার করার পূর্বে আয়ূর্বেদ শাস্ত্রে মধুর গুণাগুণ সম্পর্কে যে সব কথা বলা হয়েছে সেগুলি পরবর্তী সংখ্যায় বলা হবে৷
‘অভিনব নির্ঘণ্ঢ’ পুস্তকের ২৬১ পৃষ্ঠার এক শ্লোকে মধুর গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে৷ শ্লোকটি নিম্নরূপ ঃ–
মধুমাক্ষী কমাধ্বীক ক্ষৌদ্রসারধামীরিতম্৷
মক্ষিকা করটি বরটীভৃক্ষঙ্গক বাং তপুষ্পরস্ঠেভবম্৷৷
মধু শীতং লগুস্বাদুরুক্ষং গ্রাহিবিলেখণম্৷
চক্ষুষ্যং দীপনং স্বর্যংব্রণশোধনরো৷৷
সৌকুার্যকরং সূক্ষ্মং পরং শ্রোতো বিশোধনমম্৷
কমায়ানুরসং লতাদিপ্রসাদজনকং পরম৷৷
বর্ণংমেধাকরং বৃষ্যং বিশদং রোচনং হরেৎ৷
কুষ্ঠার্শঃ পাসপিত্তাস্রফমেহ ক্লমকৃমলীন্৷৷
মেদস্তৃষ্ণাবমিশ্বাস হিক্কাতিসারবিডুগ্রহ৷
দাহক্ষতক্ষয়াং স্তুত্তুযোগ বাহ্যল্প বাতলম্৷৷
উক্তশ্লোকটিতে সুন্দরভাবে মধুর প্রকার ভেদও বর্ণনা করেছেন৷ মধু, মাক্ষিক, মাধ্বিক, ক্ষেদ্র, সারধ্য প্রভৃতি নানা ধরণের মধুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে৷ মধুর দ্রব্যগত গুণ ও মানব শরীরে তার প্রয়োগগত উপকারিতা বর্ণনা করে উক্তশ্লোকে আরও বলা হয়েছেঃ–
মধু শীতলকারী, হাল্কা, স্বাদপূর্ণ, রুক্ষ, সহজপাচ্য (গ্রাহী) লেখন চোখের পক্ষে হিতকারী, ক্ষুধা, বর্ধক (দীপন),শ্বরশোধক মুখের ব্রণ নির্মূলক, ত্বকের উজ্জলতা বর্ধক, শরীরের সৌন্দর্য বর্ধক, সুখপ্রদানকারী, (আহ্লাদ কর্ত্তা), অত্যন্ত প্রসন্ন প্রদানকারী, মস্তিষ্কের কর্মশক্তি বর্ধক (মেধা), বৃষা বিষদ ও রোচক গুণ সম্পন্ন৷ মধুতে কুষ্ঠ, বর্মন,শ্বাসকষ্ট, হিক্কা আর অতিসার প্রভৃতি রোগ ভাল হয়৷ এছাড়া কাশি, রক্তপিত্ত, কফ, প্রমেহ, কৃমি, ক্লম, মেদরোগ, তৃষ্ণাবৃত্তির প্রাবল্য যক্ষ্মা প্রভৃতি ব্যাধিতেও–মধুর ব্যবহার খুবই ফলপ্রদ৷ মধুকে সংসৃক্ত ভাষায় বৈদ্যরা ‘যোগবাহী’ শব্দের একটি অর্থ আছে৷ যদি কোন পদার্থ (মধু) অন্য এক বা একাধিক পদার্থের সাথে মিশ্রিত হয়ে মিশ্রিত পদার্থের গুণ বর্ধন করে আর উক্ত দ্রব্যটির সমান নিজেরও গুণের পরিচয় দেয় তবে তাকে বলা হয় যোগবাহী দ্রব্য৷ মধুকে তাই যোগবাহী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে৷ প্রবন্ধের পরিণত স্তরে এ ব্যাপারে আলোচনা করে দেখানো হয়েছে যে মধু কী কী দ্রব্য, ফল বা গুল্মের সাথে মিশ্রিত হয়ে কোন্ কোন্ ব্যাধিকে দূর করতে সক্ষম হয়৷
সাধারণ মানুষ জানে না যে মধুর মধ্যে কত ধরণের আর কী পরিমাণ খাদ্য মূল্য সঞ্চিত হয়ে আছে৷ বিজ্ঞানীরা বলেন মানব শরীরের পক্ষে অত্যাবশ্যক ৮০প্রকারের প্রয়োজনীয় মৌল উপাদান মধুর মধ্যে পাওয়া যায়৷ গবেষণাগারের পরীক্ষাতে যে সব জিনিস মধুর ভেতর থেকে নিষ্কাষণ করে বের করা সম্ভব হয়েছে সেগুলির বিবরণ দেওয়া হ’ল৷
নানা প্রকারের এনজাইম মধুতে রয়েছে৷ যেমন–নবারটেস, ক্যাটলেস, পেরেকসডেস, ডিয়াসটেস, শরীর রক্ষায় এসব এনজাইমের ভূমিকা যথেষ্ট৷ ডাক্তারবাবুরা বলেন, এই উপাদানটি ছাড়া মানুষের শরীরে অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ অল্প পরিশ্রমেই কাহিল হয়ে পড়ে৷ পাচন ক্রিয়াতে এনজাইমের প্রয়োজন হয়৷ তাই মধু খেলে শরীরের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ যেমন কর্মশক্তি ফিরে পায় আবার পাকস্থলীর খাদ্য হজমের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়৷
মধুতে বিজ্ঞানীরা খঁুজে পেয়েছেন আরও অনেক উপাদান৷ ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ, ক্লোরিণ, ফসফরাস ও আয়োডিন৷ এমনকি কোন কোন মধুর মধ্যে রেডিয়ামও পাওয়া গেছে৷ পলিফ্লাওয়ার ও আরও কিছু ফলের রস থেকে উৎপাদিত মধুতে এ্যালুমিনিয়াম, বোরণ, ক্লোরিণ, কপার, লেড, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, লিথিয়াম, ওসমিয়াম, সিলিকন, টিন, জিঙ্ক, টিটানিয়াম ধাতব দ্রব্যের সন্ধান পেয়েছেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ই এস প্রোবোবস্কি৷ এ সব খনিজ পদার্থ স্নায়ুমণ্ডলীকে সুস্থ রাখতে, রক্ত সঞ্চালনে শরীরের টিসুগুলির পুষ্টিসাধনে আর এনজাইম বাইটামিন–হর্মোনের মধ্যে মিশ্র রাসায়নিক সমন্বয় সাধনে বিশেষ সাহায্য করে৷
এছাড়াও মধুতে পাওয়া গেছে অনেক ধরণের অর্গানিক এ্যাসিড৷ এতে আছে ম্যালিক, সাইট্রিক, টারটারিক আর অক্সালিক এ্যাসিড৷
মধুতে ক্যালরির পরিমাণ খুব বেশী রয়েছে৷
১ লিটার দুধে আছে ৬২০ ক্যালরি
১ লিটার টানা দুধে আছে ৩১০ ক্যালরি
১ কিলোগ্রাম রুটিতে আছে ২০৪০ ক্যালরি
১ কিলোগ্রাম ব্যাঙের ছাতায় আছে ২৭০ ক্যালরি
১ কিলোগ্রাম আপেলে আছে ৪০০ ক্যালরি
১ কিলোগ্রাম কমলা নেবুতে আছে ২৩০ ক্যালরি
১ কিলোগ্রাম মধুতে আছে ৩১৫০ থেকে ৩৩৫০ ক্যালরি
শরীরের উত্তাপ রক্ষায় , কর্ম ক্ষমতাকে অটুট রাখতে আমাদের ক্যালরির দরকার হয়৷ চিনি থেকে আমরা যে ক্যালরি পাই তাতে শরীরের পুষ্টি সাধনে যতটা সুবিধা হয় তার চেয়ে ২০ গুণ বেশী ফলদায়ক হয় মধু থেকে আহুত ক্যালরির দ্বারা, কারণ মধুর এই উপাদানটির সাথে আরও বহু প্রকারের পুষ্টিকর জিনিস শরীরে প্রবেশ করতে পারে৷
মধুতে বাইটামিনও আছে নানা ধরণের৷ বাইটামিনের অভাবে আমাদের শরীর বেরিবেরি, রিকেট, স্কার্বি প্রভৃতি জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে৷ মধু খেলে অনেক ধরনের বাইটামিনও শরীরে ঢুকতে পারে, বি–১, বি–২, বি–৩, বি–৫, বি–৬, বি. ই আর কে বাইটামিনের সন্ধানও মধুতে পাওয়া গেছে৷ এক কিলোগ্রাম মধুতে নিম্নহারে বাইটামিন পাওয়া গেছে৷
বাইটামিন বি–২–১.৫ মিলিগ্রাম৷
বাইটামিন বি–১–০.১ মিলিগ্রাম৷
বাইটামিন বি–৬–৫.০ মিলিগ্রাম৷
বাইটামিন সি–৫.৪ মিলিগ্রাম৷
মধুর ব্যবহার তাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে এত ব্যাপক ও বহুমুখী৷ এত বেশী খাদ্য মূল্য আর প্রতিষেধক ক্ষমতা এর মধ্যে রয়েছে যে, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এমনকি বর্ত্তমানের বৈজ্ঞানিক যুগেও মধুর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে৷ কিন্তু সমাজের সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে উদাসীন অথবা অনাগ্রহী৷ নানা ধরণের চিকিৎসায় মধুর ব্যবহার আর তার আশু উপকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসকরা যে সব অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাও পাঠকদের জানা দরকার৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments