মহালয়া (পিতৃযজ্ঞ নিত্যকর্ম বছরে একদিনের জন্য নয়)

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

আমাদের ধর্ম-কর্ম মূলতঃ দুইভাগে বিভক্তঃ হব্য আর কব্য৷ দেবতার পূজা-আর্চা হব্য আর পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ বা তর্পন হলো কব্য৷ মহালয়া এই কব্য পর্যায়ভুক্ত৷ কারণ এই বিশেষ দিনটিতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পন করার রীতি আছে৷ সংস্কার অনুযায়ী ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে আশ্বিনের অমাবস্যা পর্যন্ত প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষের আত্মনারা মর্ত্যে আগমন করেন প্রিয়জনদের মায়ার টানে৷ মহালয়ার দিনটিতেই সেই সব আত্মাদের উপস্থিতি ঘটে বলে মানুষের বিশ্বাস৷ ঐ দিনই তর্পণাদির দ্বারা তাঁদের পরিতুষ্ট করা হয়৷ মহালয়া হচ্ছে মহ (আনন্দ) ময় আলয়৷ পিতৃপুরুষের আগমনে সেদিন গৃহ আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ মহালয়া মূলতঃ পিতৃপুরুষেরই পূজা৷

স্নানান্তে নদীতে (বহমান হলে ভালো হয়) কোমর-জলে দাঁড়িয়ে করাঞ্জলিতে জল ধারণ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয়৷ তারপর করধৃত জল নদীতে ফেলতে হয়৷ নদীর অভাবে পুকুরেও এই কাজ করা যায়৷ পিতৃশ্রাদ্ধ সমাপনান্তে পিতৃপুরুষকে দীপ দেখানোর রীতি আছে৷ প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পর সবাইতো আর আলোকিত দেবলোকে স্থান পায় না৷ অধিকাংশ আত্মাই কিন্তু অন্ধকারময় যমলোকে বাস করেন৷ সেই-হেতু হিন্দুদের দক্ষিণদিকে পা রেখে শোওয়া নিষিদ্ধ৷ অন্ধকারময় যমলোক থেকে পিতৃপুরুষদের আগমন সহজসাধ্য করার জন্যই দীপ জ্বেলে দেওয়ার প্রথা আছে৷ প্রাচীনকালে তর্পনান্তে এক খণ্ড কাঠের ওপর জ্বলন্ত কয়লার টুকরো বসিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো৷

ইদানিংকালের পণ্ডিতদের মতে, এই আগুন জ্বালার ব্যাপারটা আদতে প্রেতাত্মাদের প্রতি মানুষের সহজাত ভয় থেকেই উৎপত্তি৷ আগুন জ্বেলে ভূত তাড়ানোর রেওয়াজ আদিমকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে৷ তর্পনাদির দ্বারা তুষ্ট করে প্রেতাত্মাদের ফের প্রেতলোকে প্রত্যাবর্ত্তনের নির্দেশ দানই বোধহয় আগুন জ্বালানোর উদ্দেশ্য৷

প্রসঙ্গতঃ আনন্দমার্গ প্রেতাত্মাজনিত কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না৷ তবে আনন্দমার্গেও মহালয়ার মতো কোন বিশেষ দিনে নয়, নিত্যকর্ম হিসাবে মনীষী ও পূর্বপুরুষগণকে স্মরণ করা অর্থাৎ পিতৃযজ্ঞ পালন করার নিয়ম আছে৷ এ বিষয়ে সবিশেষ জানতে হলে ‘আনন্দমার্গে চর্যাচর্য (তৃতীয়খণ্ড)-এর ‘স্নানবিধি ও পিতৃযজ্ঞ অধ্যায়টি পাঠ করতে হবে৷ সেখানে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---‘‘স্নানান্তে গা মোছার আগেই যে কোন জ্যোতিষ্মান বস্তুর দিকে তাকিয়ে বিধি মত মুদ্রায় নিম্নলিখিত মন্ত্রটি উচ্চারণ করবে---  ‘‘পিতৃপুরুষ্যেভ্যো নমঃ ঋষিদেবোভ্যো নমঃ৷

             ব্রহ্মর্পণং ব্রহ্মহবিব্রহ্মাগ্ণেই ব্রহ্মণাহুতম্‌৷

             ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা৷৷

মন্ত্রার্থ ঃ পিতৃপুরুষগণকে প্রণাম, ঋষি ও দেবগণকে প্রণাম (যাঁরা নূতন জিনিস আবিষ্কার করে) মানব সমাজের প্রগতির পথ প্রশস্ত করেছেন তাঁরাই ঋষি৷ অর্পণরূপ ক্রিয়া ব্রহ্ম যা অর্পিত হচ্ছে তা ব্রহ্ম, যাতে অর্পিত হচ্ছে তা ব্রহ্ম, যে অর্পণ করছে সে ব্রহ্ম, ব্রহ্মের কর্ম সমাপন করে সে ব্রহ্মত্বেই লীন হবে৷’’ ‘‘পরপর তিনবার মন্ত্র উচ্চারণ করবে ও তার সঙ্গে  মুদ্রা করবে৷ এইভাবে মনীষী ও পূর্বপুরুষগণকে স্মরণ করার নাম পিতৃযজ্ঞ৷ নিত্যকর্ম হিসাবে পিতার জীবিতাবস্থাতেও  করা চলবে৷’’ মনে রাখতে হবে এই পিতৃযজ্ঞ আনন্দমার্গের একটি নিত্যকর্ম৷ শুধুমাত্র বছরের বিশেষ দিন মহালয়াতেই এই পিতৃযজ্ঞ শেষ হয় না৷

সংশোধন ঃ গত সপ্তাহের প্রভাতীতে প্রকাশিত অ্যান্টনী ফিরিঙ্গীর দুর্গা প্রতিমা লেখাটির লেখক ভূলবশতঃ পথিক বর ছাপা হয়েছে, এই লেখাটির প্রকৃত লেখক হলেন প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত