মহিলা মহল

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সত্তাগত সমতায় পুরুষের মতই নারীর মধ্যেও প্রভুত সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে৷ নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিক ও দেহসংরচনাগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য সমমৈত্রীভিত্তিক সহযোগিতাকেই (কো-অর্‌ডিনেটেড্‌ কো-অপারেশন) প্রশস্ত করে৷ কিন্তু বাস্তবটা ভিন্ন সেখানে প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কসুলভ সহযোগিতা (সাব-অর্‌ডিনেটেড্‌ কো-অপারেশন) চলে আসছে মহাভারতের যুগের পর থেকে৷ এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের  যুগে এবং এরই প্রভাবে পরেও৷

শুধু বাঙলা বা ভারতে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই নারীদের ওপর শোষণের মর্মান্তিক চিত্র৷ মানুষ হিসাবে সমাজে নারীর অবস্থা আর নারী হিসাবে সমাজে নারীত্বের চিত্রটা কী? মানুষ হিসাবে নারীকে মর্যাদা দেওয়া তো দূরের  কথা, দেখেছে--- চিতা বা কবরে যাওয়া পর্যন্ত বিনা পয়সার ঝি, আর সন্তান উৎপাদন-লালন-পালনের যন্ত্র মাত্র৷ মেয়েদের মন বলে কিছু নেই, দম-দেয়া কলের পুতুল যন্ত্র তো -ভাল লাগা, মন্দ লাগা বলেও কিছু নেই৷ আবার নারীত্বের পরিচয়ে? সে যেন একতাল জড়পিণ্ড, পোঁটলা! বিয়ের আগে ‘কন্যাদায়গ্রস্ত’ বাপের ঘাড়ের অবাঞ্ছিত বোঝা,  বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির ক্রীতদাসী-বাড়তি বোঝা,শেষ বয়সে-বুড়ী বয়সে  সন্তানদের গলারকাঁটা৷ যে বাড়িতে মেয়েটা জন্মাল, লালিত-পালিত হল, বড় হল---সে বাড়িটা তার নিজের বাড়ি নয় বিবাহযোগ্য হলেই সে পর হয়ে গেল, বাবা-দাদা-ভাই-কাকা-জ্যেঠা-মামা ওই পরভৃতাকে তার নিজের বাড়িতে--- অর্থাৎ শ্বশুর বাড়ীতে ফেলতে না-পারলে খাওয়া দাওয়া রাতের ঘুম চলে গেল৷ দাদা-ভাই এর বিয়ে হয়ে গেলে বাপের-সংসার বাড়ি আর বাড়ির মেয়েটার নয়, ভাইবৌ-বৌদিদের ৷ অর্থাৎ-বাপ-মা মরে গেলে মেয়েটাকে দেখবে কে? বউ থেকে মা হওয়াতেই নারী জীবনের সার্থকতা! সাধের বাপ-মা’র বাড়িটা হয়ে যাবে পরের ঘর৷ তাই পরিবারের কাছে কন্যা দায় বড় দায়৷ অদ্ভুত সামাজিক নিয়মে মেয়ে জন্মানোর  চেয়ে বড় বিড়ম্বনা বোধ হয় আর নেই৷ বাপের বাড়িতে বাপ-ভাই-দাদাদের অধীনে, শ্বশুর বাড়ীতে স্বামীর অধীনে, শেষ বয়সে সন্তানের  অধীনে৷ মেয়েমানুষ জীবন--- সংসারের গারদের যাবজ্জীবন বন্দিনী৷ বিয়ে না হলে বৃথাই মেয়েদের জীবন টিকে থাকা, বেঁচে থাকাই দায়৷ তাই পুরুষ শাসিত সমাজে অর্থ উপার্জন করে আতত্মনির্ভর হলেও বিয়েতেই যেন মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তথা জীবনের নিরাপত্তা বলয় ঠিক হয়ে যায়৷ কেননা প্রশ্ণ সেখানেও শেষ বয়সে দেখবে কে? অবশ্য এ বিষয়টা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই নয়, ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই৷ তাই ছেলে ভাল রোজগার করে, বিয়ের বয়স হয়েছে অথচ বিয়েতে অনীহা বাপ মা’র আক্ষেপ --- ছেলেটার একটা বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে নিশ্চিন্তে মরতে পারতাম৷ নইলে সংসারটা ধরে রাখবে কে, ওকে দেখবেই বা কে?৷ এ ব্যাপারে নীতি বাক্যের মত একটা কথা চালু আছে’’ এ ব্যাচেলর্‌ লিভস্‌ লাইক এ কিং, বাট্‌ ডাইজ লাইকে ডগ্‌’’৷ এই জন্যেই তো সামাজিক বন্ধন, সবাইকে  নিয়ে এক সঙ্গে চলার প্রেষণা, আর পারস্পরিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার৷ সংসার বা পরিবারের মধ্যমণিই (নিউক্লিয়াস) তো নারী৷ তবে একে ছাড়া অন্যে অসম্পূর্ণ৷ সমাজ সংরচনা উভয়ের  ভূমিকাই সমান গুরুত্বপূর্ণ৷

সর্বক্ষণের জন্যে মানুষের, জগতের সেবায় নিবেদিত প্রাণ না-হলে সমাজ স্বৈরী-স্বৈরীণী জীবনকে স্বীকৃতি দেয়নি, কেননা এ হল এক ধরণের পলায়ন মনোবৃত্তি৷ উড়ো পাখি ধান খেয়ে যাবে, দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবে না তা তো হয়না৷ মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই ত্রুটি থেকে বেরিয়ে আসতেই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব, সৃষ্টি হয়েছে বিবাহ পদ্ধতির৷ দৈহিক-মানিক শুচিতায় উদ্ভাসিত, আত্মিকতায় উদ্বর্তিত নারী পুরুষের পবিত্র বন্ধনে সমাজ পাবে ক্রমোন্নত প্রজন্ম, আর তাদের বৈয়ষ্টিক মধুর সম্পর্কের রসায়নে সমাজের অগ্রগতির রথটা চলবে গড় গড়িয়ে৷ এই জন্যে না প্রায় সাত হাজার পূর্বে মহাকৌল সদাশিব নারী ও পুরুষের  দু’হাতকে হৃদয়ে অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে দিলেন, রচনা করলেন সমাজ শাস্ত্র, যোগালেন জগৎ ও জীবনের সামঞ্জস্য বিধান করতে করতে  পূর্ণতার পথে  চলার জীবনের নানা স্তরের রসদ৷ নারী পুরুষের মিলন সূত্রটার উদ্ভব ছিল সমমৈত্রীভিত্তিক সহযোগিতার ওপর ভর করে (কো-অরডিনেটেড, কো-অপারেশন)৷ মেয়েদের  দাবিয়ে রাখতে পরবর্তীকালে ধান্দাবাজদের চক্রান্তে তা দাঁড়িয়েছে প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কসুলভ সহযোগিতা ৷ কিন্তু ফলটা কী হল? কবি-ঋষির দৃষ্টিতে’’ যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে৷’’ অর্থাৎ নারীকে অশিক্ষিত-মুর্খ করে রেখে, দাবিয়ে দলিত করে রাখার ফল ভাল হয়নি, পদে পদে  সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে৷ নারী সমাজের মা, ভূমিকা তার একাধারে জননী, জায়া, ভগিনী ও বন্ধুর৷ সন্তানের চরিত্র ঘটনে নারীর ভূমিকাই অগ্রগণ্য৷ আবার পুরুসের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল হয়ে উঠার পেছনে নারীর প্রেরণা-প্রেষণা মহামূর্খ ছাড়া অস্বীকার করে কে? সারা পৃথিবী জুড়েই নারীর কল্যাণী-চালিকা-শক্তির প্রভাবে অগুনতি নজির ছিড়িয়ে আছে৷ জগতে যারা কীর্তি রেখে গেছেন, তাদের প্রায় সকলেরই পিছনে কোন না কোন মহীয়সী নারীর ভূমিকা আছে৷ নারীর অন্তর্নিহিত কিছু ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও পুরুষ নারীর কাছে বহুলাংশেই ঋনী৷ অথচ কী অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার! আজও  সমাজে সেই নারীর স্থান প্রায় দাসীর মত, ক্রীতদাসীর মত৷ পুরুষতন্ত্র নারীর এই অসহায়তার-দুর্বলতার চরম সুযোগ নিয়েছে৷ (ক্রমশঃ)