যে সকল অন্তর্নিহিত দুর্বলতা মানুষের ক্ষতিসাধন করে সেগুলিকে রিপু বলা হয়৷ আর জীবের এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা রিপুর সুযোগ নিয়ে বাইরে থেকে যে বন্ধন এসে জেঁকে বসে’ মানুষকে জড়িয়ে ধরে ........ আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে ...... জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে বসে সেগুলিকে বলা হয় পাশ৷ রিপু ছয়টি – কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য্য৷ আর এই রিপুগুলি থাকার ফলে যে পাশগুলি (পাশ মানে বন্ধনরজ্জু) মানুষকে বন্ধন করে তারা হ’ল সংখ্যায় আট৷
‘‘ঘৃণা–শঙ্কা–ভয়ং–লজ্
জুগুপ্সা চেতি পঞ্চমী
কুলং–শীলঞ্চ–মানঞ্চ্
অষ্টপাশাঃ প্রকীর্ত্তিতাঃ’’৷৷
এই ঘৃণা–শঙ্কা–ভয়–লজ্জ্ (গোপন রাখবার ইচ্ছা বা কপটতা – ড়ম্ভহ্মপ্সন্তুব্জন্ব্দ্ ), কুলাভিমান, মানাভিমান ও গুণাভিমান এই আটটি হচ্ছে পাশ৷ এই ঘৃণা পাশের বীজমন্ত্র হচ্ছে ‘প’৷ একটি পাশ যে কেবল একটি রিপুতেই সন্নিবদ্ধ হয় তা নয়, একটি পাশের পেছনে একাধিক রিপুগত ত্রুটি থাকতে পারে৷ তবে ঘৃণা–ভয় পাশ দু’টি অন্যান্য রিপু–আশ্রিত হলেও এরা মুখ্যতঃ মোহ রিপুর পরিপোষকতা পায়৷ যেমন ধর, কারও মধ্যে পানাসক্তি রয়েছে৷ আকর্ষণ যেখানে জড়াভিমুখী, মনের গতি সেখানে নিম্নঢালুতে৷ গতি যেখানে নিম্নঢালু ক্রিয়া সেখানে ‘পত্ (পততি)৷ আসক্তির ফলে হয় পতন৷ আর গতি যেখানে ঊর্ধ্বঢালুতে তাকে বলে অনুরক্তি ও অনুরক্তির চরম অবস্থার নামই ভক্তি৷ এর জন্যে সংস্কৃতে ধাতু হ’ল ‘উর্ধ্ব গম্’ (ঊর্ধ্ব গচ্ছতি)৷ যার মধ্যে পানাসক্তিরূপী মোহগত দুর্বলতা রয়েছে সে সহজেই ঘৃণা ও ভয়ের দ্বারা বদ্ধ হয়৷ কেবল পানাসক্তিই নয়, যে কোন প্রকারের মোহ রিপু মানুষকে অন্যের কাছে ঘৃণিত ও অন্যকে তার কাছে ভয়ের বস্তু করে তোলে৷ সে যুক্তিতর্ক বর্জিতভাবেই মোহ আলেয়ার পেছনে ছুটে যায়৷ এই মোহ বৃত্তি সম্বন্ধে একটি গল্প মনে পড়ল৷
মোমিনপুরে থাকত আমার জানা–চেনা, কী যেন নামটা ... বোধ হয় মণ্ডামোহন মুখুজ্জে৷ মণ্ডামোহনকে কেউ বলত হাড়কেপ্পন, কেউ বলত দৃষ্টিকেপ্পন, কেউ বলত
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে জল গলে না, কেউ বলত একটা পয়সা খসালেই ওর একটা পাঁজর খসে যায়, কেউ বলত ওয়ান পাইস ফাদার–মাদার, কেউ বলত এক পয়সা প্যাঁজ–ফুলুরী, কেউ বা রসিকতা করে বলত প্যাঁজ–পয়জার৷ আধুনিক ছেলেরা বলত, উপুড়হস্ত নো–নট–নেবার৷ কথাগুলো শুনে ও বেশ তৃপ্তি অনুভব করত৷
সেবার বেগুনের হয়েছিল অতি–উৎপাদন ৷ বিজ্ঞানসম্মত অর্থনৈতিক কাঠামো যে দেশে নেই সেদেশে অতি উৎপাদনকারীদের মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয়৷ বেগুনের অতিরিক্ত ফলনে সেবার বাঙলার চাষীদের মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয়েছিল৷ নদীয়া জেলার হরিণঘাটা থানায় বেগো গাঁয়ে গিয়ে দেখি চাষীরা কাটারিতে বেগুন টুকরো টুকরো করে গোরুর জাব খাবার ডাবায় নুন মাখিয়ে ঢেলে দিচ্ছে৷ গোরু মুখ দিতে গিয়ে যেই দেখছে বেগুন অমনি নাক সিঁটকে মুখ ঘুরিয়ে বলছে – হুঁ ... বেগুন.... হাম্বা হাম্বা৷ ডাবার আর একটা কোণ ঘেঁসে যেই আবার মুখ রাখতে যাচ্ছে সেখানেও ওই একই কাহিনী৷ আবার সে ভুরু কঁুচকে মুখ বেঁকিয়ে বলছে – উঁ...... আবার বেগুন ...... হাম্বা হাম্বা৷ চাষীরা দেখলে – গোরু জাব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, এবার দুধ বন্ধ হয়ে যাবে৷ তাই তারা গোরুকে বেগুন দেওয়া বন্ধ করে দিলে৷
বীরভূমের রামনগরের চাষীরা বনেদী বেগুনচাষী৷ ওখানে গিয়ে শুনলুম, ওরা গাছ থেকে বেগুন তোলা ছেড়েই দিয়েছে৷ ওরা আমাকে বললে, ‘‘বাবু, বেগুনগুলো গাছেই পচুক৷ ওতে বরং গাছের সার হবে’’৷ পাঁজিপাড়া যাবার সময় পাইনি৷ তাই ওখানকার ডাকসাইটে বেগুনের কী দশা হয়েছিল বলতে পারছি না৷ আমাদের শহরে সে সময় পসুরী হিসেবে পাইকারী বাজারে কেনাবেচা হত৷ ৫ সেরে হত ১ পসুরী, আর ৮ পসুরীতে হত ১ মণ৷ তবে সেরের হিসেব সব জেলায় এক রকম ছিল না৷ প্রমাণ পরিমাপের সের বলতে বোঝাত ৮০ তোলাকে৷ কিন্তু আমাদের মুঙ্গেরে চলত ৮৪ তোলা৷ আবার পাশের জেলা ভাগলপুরে কোথাও কোথাও ১০০, ১০১, ১০৩ তোলা চলত৷ কোথাও বা ১০৫ তোলায় ১ সের৷ ৬০ তোলার সেরকে কাঁচি হিসেব বলা হত৷ তাই সে যাই হোক, সেবার অতি–উৎপাদনের সময় আমাদের শহরে বেগুনের ফ্যালা–ছড়া৷ মণ্ডামোহনের বাড়ীতে তিন মাস ধরে কেবল ভাত আর বেগুন–পোড়া চলত৷ পাড়ার মেয়েরা মণ্ডামোহনের স্ত্রী শ্রীমতী মিথ্যাময়ী দেবীকে জিজ্ঞেস করত ... ‘‘হ্যাঁ গা মর্কটের মা, (মণ্ডামোহনের ছেলেটির নাম ছিল মর্কট মোহন মুখুজ্জে৷ সে লটারির টিকিট বেচত আর টিউশানি করত৷ জলখাবার ছাত্রের বাড়ীতেই পাওয়া যেত – তবে ছুটির দিনে হরিমটর চিবিয়ে থাকাই পছন্দ করত)৷ আজ কী রাঁধলে গা?’ সে বলত, ‘আজ সেই ভোর থেকে দুপুর বারটা অবধি একটানা হেঁসেলে থাকায় ঘাড়–পিঠ টনটন করছে’৷ লোকেরা শুধোলে, ‘তা অতক্ষণ ধরে কী রাঁধলে গা?’ সে বললে, প্রথম পাতের জন্যে রাঁধলুম নিম–বেগুন তারপর বেগুন বোঁটার চচ্চরি, ... তারপর বেগুনের কোপ্তা .... তারপরে বেগুনের কোর্মা ... তারপরে আদা বাটা দিয়ে বেগুনের ঝাল....সর্ষে বাটা দিয়ে বেগুনের ঝাল আর শেষ পাতে এখো গুড় দিয়ে বেগুন বীচির পায়েস৷ বেগুন–পোস্ত করব ভেবেছিলুম৷ উনুনে আঁচ না থাকায় আর করা গেল না৷ বেগুনপোড়া–টোড়া হেঁসেলের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে দিই না৷ ওইসব গরীবদের জন্যেই থাকুক৷’