মন্দির মসজিদ প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ণ কিছু কথা

লেখক
এইচ.এন.মাহাত

প্রত্যেকদিন সংবাদপত্র খুললেই আমরা একটি সংবাদ দেখে দেশভাগের পূর্ব স্মৃতি অনুভব করে  আতঙ্কিত হই৷ কুতুবমিনার থেকে বাবরী মসজিদ সহ প্রায় সকল মসজিদ নাকি হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে তৈরী হয়েছে মুসলিম আমলে৷ তাই সকল ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে৷ খুব ভালো কথা! তবে একই ধরণের  দাবি বৌদ্ধ ও জৈন পন্থীরা তুলতে পারে মন্দিরগুলির ক্ষেত্রেও৷  কারণ ভারতের বহু বড় বড় মন্দির তৈরি হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন মন্দির ভেঙে৷

ভারতের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন দিকপাল হিন্দুবাদী নেতাদের  কাছে বিবেকবান মানুষের প্রশ্ণ ভারতের যেসব হিন্দু মন্দিরগুলি তৈরী হয়েছিল বুদ্ধের প্যাগোডা অথবা জৈন মন্দির ভেঙে তার ঐতিহাসিক সত্যতা জানার জন্য নৃতাত্ত্বিকবিদদের দিয়ে অনুসন্ধান চালাবেন কি? আজ যদি মসজিদ ভেঙে মন্দির কে স্বস্থানে ফিরিয়ে আনতে হয় কেন তবে বুদ্ধের প্যাগোডা বা জৈন মন্দিরগুলিকে স্বস্থানে আনা হবে না? আরও একটা প্রশ্ণ প্রতিবেশি কোন দেশে এরপ্রভাবে যখনই সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির ভাঙে তখন ভারতীয় হিন্দু প্রেমীদের সেই মন্দিরের প্রতি দরদ থাকে কি?

আসলে তৎকালীন আমলে মন্দিরগুলি সেটা বুদ্ধ বা জৈন মন্দির হোক তাহা ছিলো মানুষকে  সংবেদনশীল ও মানবতার মন্ত্রপাঠ বা অধ্যায় করার জন্য৷ সেখানে  কোন বিভেদ মূলক চর্র্চ হোত না৷ কেননা তৎকালীন আমলে  মানুষের কোন অর্থনৈতিক বা মানসিক সমস্যা আজকের মত প্রবল  ছিলো না৷ তৎসহ বিষাক্ত ধর্মীয় মতবাদের আবহাওয়া জনমানসকে  আজকের  মত ক্ষত বিক্ষত করেনি৷ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কোন খামতি চোখে না পড়ার ফলে মানুষ কয়েক শত বছর  ধরে বেদ, গীতা, মহাভারত থেকে মানবতার কল্যাণকর মন্ত্রপাঠ করে ছিলেন৷ মনের সুখে মানব কল্যাণের  জন্য গড়ে তুলেছিলেন মানবসমাজের এক কল্যাণমূলক নবদিগন্ত৷ পরবর্তীকালে মুনি-ঋষিরা শ্লোকের উপর টিপ্পনী বা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তৈরী করেছিলেন বেদান্ত, পুরাণ, উপনিষদ ইত্যাদি, তখন সেই অদেখা ঈশ্বরতত্ত্বকে কেন্দ্র করে লিখিত বা অলিখিত কর্মকাণ্ডের ভালোমন্দ বিচার করার সময় ছিলো না৷ এছাড়াও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের  সূর্য ও নক্ষত্রমণ্ডলকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুনিঋষিরা তিথি দিনক্ষণের উপর বিরাট সম্ভার মানব সমাজকে উৎকর্ষ করেছিলেন৷ আজকের আধুনিক বিজ্ঞান সেই শ্লোককে ভিত্তি করে নতুন নতুন আবিষ্কারের কথা বলছে এর ভিত্তি হলো ভারতীয় মুনিঋষিরাই৷ কথা স্বীকার করেছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মনি ভৌমিক যিনি বর্তমানে আমেরিকাবাসী৷

আজকের  বিজ্ঞান তথাকথিত আকাশ ছোঁয়া উন্নত হলেও মানুষের মহানুভবতা, নৈতিকতা, সহনশীলতা যেন হিংস্র পশুকেও হার মানিয়ে দেয়, তেমনি মানুষ  পুরুস ও নারীদের মধ্যেকার  সুক্ষ্ম আধ্যাত্মিক উন্নতির মানসিকতা না থাকায় প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক ও মানসিক চারিত্রিক স্খলন ঘটছে৷ মানুষের চারিত্রিক দ্বিচারিতায় বিশ্বাস যোগ্যতা হারিয়ে মানুষ অমানুষে পরিণত হয়েছে৷

মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের দার্শনিক দৃষ্টিতে বর্তমান পরিস্থিতে মন্দির, মসজিদ, চার্চ পেগোডা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোস্থাস্তিকভাবে সাময়িক  ঈশ্বর প্রাপ্তির স্থান ভেবে নিলেও খুদ্র মানসিক শান্তির  নীড় ছাড়া আর কিছুই নয়৷ মানুষ মুক্তি ও মোক্ষের অন্বেষণে সমগ্র বিশ্ব পরিভ্রমণ করলেও শেষ বয়সে হতাসাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া কিছুই পায়নি৷ পরিণতিতে মানসিক ভাবে তৈরী হয়েছে ডগমা বা ভাবজড়তা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের জায়গা৷ এই অন্ধবিশ্বাসেই মানুষের মনে তৈরী  হয়েছে মতভেদ উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ, জাতিগতভাবে জাতপাত৷ ধর্মীয় মতভেদের দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট মানুষ আজ একে অপরের শত্রু৷ তবে ধর্মীয় মতভেদের প্রধানরা এক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অন্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের আপনজন না ভেবে তাদের  প্রতি বিষ ছড়িয়ে মানবসমাজকে  কলুষিত করছে৷ যেখানে মানুষের প্রতি  মানুষের কোন দায়বদ্ধতা নেই সেখান থেকেই ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক , অর্থনৈতিক শোষণ৷ মহান দার্শনিক শ্রীসরকার আরো বলেছেন কোন প্রতিষ্ঠানকে ধবংস না করে সেগুলোকে মানুষের  মূল্যবোধের কাজে ব্যবহার করা৷  সেখানে সকলের মানুষের জন্য তৈরী হোক অন্তনিহিত আধ্যাত্মিক সাধনার পীঠস্থান৷ মানুষ মানুষ ভাই ভাই, সকল মানুষের ধর্ম এক অর্থাৎ মানবতার  ও মানুষের অস্তিত্বের জয়গান৷ সেখানে থাকবে না কোন নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, জাতপাত, ধর্মীয় মতবাদের অক্টোপাশের বেড়াজাল৷ আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান৷ এটাই হোক মানব সমাজকে বাঁচানোর আমাদের একমাত্র পথ৷ মানুষকে বাঁচালে পৃথিবীর সকল প্রাণীন ও অপ্রাণীন সত্তা বাঁচবে৷ তবেই সৃষ্টি হবে নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক আদর্শ মানবসমাজ৷