তোমরা অনেকেই আসকে পিঠে খেয়েছ (বাঙলায় কোথাও কোথাও সরাপিঠে বা চিতুই পিঠেও বলা হয়৷ তবে কলকাতায় আমরা আসকে পিঠেই বলি)৷ আসকে পিঠেতে থাকে অনেক ছিদ্র৷ তোমরা সেই ছড়াটা নিশ্চয়ই জানো–
‘‘ঘুঘু তো দেখেছ জাদু ফাঁদ তো দেখনি৷
আসকে খেয়েছ জাদু ফোঁড় তো গোণনি৷’’
তোমরা সংস্কৃত ভাষায় হয়তো সেই মূর্খ ব্রাহ্মণপুত্ত্রের গল্প পড়েছ৷ সে গুরুগৃহ থেকে অনেক শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিল৷ জ্ঞানে বৈদুষ্যে তার জুড়ি মেলা ভার, কিন্তু তার বৈয়বহারিক ৰুদ্ধি বলে কোনো জিনিস ছিল না৷ সে যখন গুরুগৃহ থেকে স্বগৃহে ফিরছে তখন পথে সে একজনের অতিথি হয়েছিল৷ তারা তাকে আসকে পিঠে খেতে দিয়েছিল৷ সে কখনও আসকে পিঠে দেখেনি৷ সে সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্র খুলে আসকে পিঠের পরিচিতি জানবার চেষ্টা করলে, কিন্তু কিছুতেই কোনো হদিশ পেলে না৷ তবে এক জায়গায় সে পেলে ঃ
‘‘ছিদ্রেষ্বনর্থাঃ ৰহুনি ভবন্তি৷’’
এর আসল মানে হচ্ছে কোনো কিছুতেই যদি সামান্য একটু ছিদ্র বা খুঁত থেকে যায় তবে পরে সেই ছিদ্রটুকুকে কেন্দ্র করে বিরাট ৰড় অনর্থ ঘটে যেতে পারে৷ এ যেন সেই গত মহাযুদ্ধের সময় দামোদরের ৰাঁধ ভেঙ্গে বন্যার ব্যাপার৷ ৰাঁধেতে একটি ইঁদুরের গর্ত ছিল৷ সেই ছোট্ট গর্ত থেকে জল চুঁইয়ে বাইরে আসতে আসতে ৰাঁধ ভেঙ্গে বিরাট বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল৷ তা সে যাই হোক্, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ভাবলে এই যে ছিদ্রযুক্ত খাদ্যবস্তু এর থেকে নিশ্চয়ই ৰড় রকমের অনর্থ ঘটবে৷ তাই সে আসকে পিঠে ফেলে রেখে চোঁ দৌড়........চোঁ দৌড়.......বাপ্রে বাপ্৷ জেনে শুনে অনর্থ ঘটাতে আছে
* * *
তার সঙ্গে আর একজন যে সাথী ছিল, তার অবস্থাও ছিল তেমনি৷ তিনি নদীর ধারে বসে আকাশের তারা গুণছিলেন আর ভাবছিলেন, রাত্রে এখন কোথায় যাই৷ এমন সময় দেখলেন, নদীর ধারে একটি গাধা৷ তিনি তখন শাস্ত্র খুলে ওই জীবটির পরিচিতি জানার চেষ্টা করলেন৷ পরিচয় ঠিক পেলেন না বটে, তবে একটা জায়গায় দেখলেন, লেখা আছে–
‘‘রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি সঃ ৰান্ধবঃ৷৷’’
উনি ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন গাধাটার কাছেই রয়েছে শ্মশান৷ সে যখন শ্মশানে উপস্থিত রয়েছে তখন সে নিশ্চয়ই ৰান্ধব৷ তখন তিনি গাধার কাছে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে আদরের সঙ্গে বললেন–ৰন্ধু হে আমার জন্যে একটি আস্তানা করে দাও৷ গাধা ভয়ে হাত–পা ছুঁড়ে চীৎকার শুরু করে দিলে৷ গাধার চীৎকার শুনে গাধার মালিক রজক লাঠি নিয়ে তেড়ে এল ও মূর্খ পণ্ডিতের ওপর লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করলে৷ মূর্খ পণ্ডিত তখন দাদারে দাদা........পালারে পালা.........ন্যাজ তুলে পালা৷
* * *
ওদেরই আর একজন সঙ্গী ছিল৷ তিনি আর এক বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন৷ গৃহস্বামী তাঁকে সেমাইয়ের পায়েস খেতে দিয়েছিলেন৷ পণ্ডিত–তনয় জীবনে কখনও সেমাই দেখেননি৷ শুধু আলো–চাল আর কাঁচকলা সেদ্ধ খেয়ে খেয়ে দিন কেটেছে৷ সেমাই দেখে তিনি পুঁথি খুলে ভাবতে লাগলেন এটা আবার কী জিনিস৷ সেমাই দেখতে লম্বা সুতোর মত৷ তাই সংস্কৃত নাম ‘সূত্রিকা’৷ পণ্ডিতের এটা জানা ছিল না৷ তবে তিনি একটা জায়গায় একটা সূত্র পেলেন–‘‘দীর্ঘসূত্রী বিনশ্যতি’’৷ ‘দীর্ঘসূত্র’ মানে procrastination (মানে, হচ্ছে–হবে.......আচ্ছা, আজ হবে না, কাল হবে.........কাল হবে না, পরশু হবে.........এই ধরনের মনোভাব)৷ ‘দীর্ঘসূত্রী বিনশ্যতি’–এর আসল মানে হল, যে মানুষ হচ্ছে......হবে করে দিন কাটায় তার বিনাশ অনিবার্য৷ মূর্খ পণ্ডিত ভাবলে এই সেমাই তো ৰেশ লম্বা লম্বা সুতো৷ সুতরাং এগুলো নিশ্চয়ই দীর্ঘসূত্র, আর যখন ‘দীর্ঘসূত্রী বিনশ্যতি’ বলা হয়েছে তখন এগুলি খেলে নিশ্চয়ই মরে যাব৷ গৃহস্বামী আমাকে মারবার জন্যেই এগুলি খেতে দিয়েছেন৷ সে তখন পালারে পালা বলে পালাল৷
* * *
ওই ৰন্ধুদের আর একজন ৰন্ধু ছিল৷ সে কোথায় যাবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিল না৷ তাকিয়ে দেখলে তার সামনে দিয়ে আর একজন লোক যাচ্ছে৷ সে খোঁজ নিয়ে জানলে লোকটি একজন ‘কুসীদজীবী’ অর্থাৎ ‘মহাজন’৷ সংস্কৃতে ‘মহাজন’ বলতে যেমন মহৎ লোককে ৰোঝায় তেমনি কুসীদজীবীকেও ৰোঝায়, পয়সাওয়ালা লোককেও ৰোঝায়, আবার খুচরো ব্যবসায়ীরা পাইকারী ব্যবসায়ীদেরও মহাজন বলে থাকে৷ মূর্খ পণ্ডিত শাস্ত্র খুলে দেখলে, শাস্ত্রে লেখা আছে–‘‘মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থা’’৷ অর্থাৎ মহাজন যে পথে গেছেন সেইটাই প্রকৃষ্ট পথ, বাকীদেরও সেই পথ অনুসরণ করা উচিত৷ সুতরাং সে ওই মহাজনের পেছনে পেছনে চলতে শুরু করলে৷ মহাজন লোকটি বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখলে, একটা লোক তাকে অনুসরণ করছে৷ তখন তার মনে হল লোকটা ৰুঝি চোর–ডাকাত৷ তাই সে মূর্খ পণ্ডিতকে ধরে উত্তম–মধ্যম দিয়ে দিলে৷ মূর্খ পণ্ডিতের তখন অবস্থা–‘‘পালানোই জীবনের সারসত্য’’৷ পণ্ডিতপুঙ্গব তখন শাস্ত্র ভুলে গেয়ে চলেছে–দাদারে দাদা........পালারে পালা...........ন্যাজ তুলে পালা৷
পালাব না তো কি, তোর ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকব