পৃথিবীর সব দেশেই, এমনকি সব শহরেই কিছু
সংখ্যক খুশামুদে ও উন্নত মানের অনারারী
মুসাহিব আছে৷ মাইনে পাওয়া মুসাহিবদের চেয়েও অনারারী মুসাহিবেরা আরও ক্ষেশী মুসাহিক্ষী করে থাকে৷ একটা গল্প বলি শোনো–
সে আজ প্রায় ৪০–৪৫ বছর আগেকার কথা৷ আমাদের শহরে একজন নামজাদা ডাক্তার ছিলেন৷ ধরো, তাঁর নাম অরুণ বাঁড়ুজ্জে৷ ডাঃ বাঁড়ুজ্জের যেমন ছিল হাত–যশ, তেমনি ছিল পসার৷ রোজগার করতেন দু’হাতে, দান–ধ্যানও করতেন দু’হাতে৷ এই অমায়িক পরোপকারী মানুষটির দরজা থেকে কোনো অভাবী মানুষকেই কখনও নিরাশ হয়ে ফিরতে হত না৷ স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁকে ঘিরে তৈরী হয়েছিল একটি খুশামুদে–চক্র৷ তিনি পসন্দ না করলেও এই খুশামুদেদের মধ্যেও কয়েকজন বেশ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও দক্ষ মুসাহিব ছিলেন৷
ডাঃ বাঁড়ুজ্জে ছিলেন খুবই মাতৃভক্ত৷ শিশুপুত্রকে নিয়ে বিধবা হয়ে তাঁর মা কায়ক্লেশে পুত্রকে মানুষ করে তুলেছিলেন৷ একথা ডাঃ বাঁড়ুজ্জে সবাইকে বলতেন৷
ডাঃ বাঁড়ুজ্জের মায়ের বাড়াবাড়ি অসুখ৷ ডাক্তারেরা জবাব দিয়ে গেছেন৷ তাঁরা বলেছেন–রোগিণী বড় জোর আর দিন দু’য়েক বাঁচতে পারেন৷ ডাঃ বাঁড়ুজ্জে সেবা–যত্নের কোনো ত্রুটি করছেন না৷
কাগে–কোকিলে মুসাহিবদের কানে খবরটা তুলে দিলে৷ তারা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়তে দৌড়তে ডাঃ বাঁড়ুজ্জের বাড়ী ঘিরে ভীড় জমাতে লাগল৷ কেউ বললে–মাসীমা এমন ভাবে আমাদের ফেলে চলে যাবেন এ আমরা স্বপ্ণেও ভাবিনি৷ কেউ বললে–মাসীমা আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন এ যে দুর্বিষহ৷ ডাঃ বাঁড়ুজ্জে আস্তে আস্তে বললেন–আমার মা’কে আগে মরতে দিন৷ কেউ বা কোমরে গামছা বেঁধে, হাতে বাঁশ–কাটারি–দড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়ে বললে–মাসীমা ছিলেন সত্যিই পুণ্যশ্লোকা৷ এরকম মহীয়সী মহিলার কথা আমরা কোনো বইয়েই পড়িনি, আর কখনও কারো মুখেও শুনিনি৷ ডাঃ বাঁড়ুজ্জে আবার আস্তে আস্তে বললেন–আমার মা’কে আগে মরতে দিন৷ যেসব মুসাহিব একটু পেছিয়ে পড়েছিল অর্থাৎ একটু বিলম্বে খবর পেয়েছিল তারা তাদের আফশোষ পুরো করে নিতে কসুর করলে না৷ কেউ বললে– মাসীমা যেমন ছিলেন তাতে তাঁর গতি শিবলোকেই হবে৷ কেউ কেউ উৎসাহের আধিক্যে বলে ফেললে–গত মাসের ৪০টা দিনই আমি তাঁকে একাদশী করতে দেখেছি৷ কেউ বা বললে–তাঁর গতি অবশ্যই বৈকুণ্ঠে৷ শিবলোকে গিয়ে তিনি হবিষ্যি খেতে যাবেন কোন্ দুঃখে বৈকুণ্ঠে গিয়ে পোলাও–কালিয়া খাবেন৷ কেউ বা বললে–একজন জ্যোতিষী আমাকে বলেছিলেন, মাসীমার জন্যে গোলোকধামে একটা স্থান নির্দিষ্ট করে রাখা আছে৷
ডাঃ বাঁড়ুজ্জে আর সহ্য করতে পারছিলেন না৷ তিনি বললেন–আপনারা কথাবার্ত্তা বলুন, আমি এক্ষুনি আসছি৷ মুসাহিবদের দল হাঁ হাঁ করে উঠে বললে–সে কী কথা সে কী কথা আপনি কোথায় যাবেন যাবার জন্যে তো আমরা তৈরী হয়েই এসেছি৷ ডাক্তারবাবু ওদের কবল থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে বললেন–আপনারা কথাবার্ত্তা বলুন, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি৷ মুসাহিবের দল সমস্বরে বলে উঠল–সে কী কথা সে কী কথা আপনার এখন মাতৃদায়– মাতৃশোক৷ আপনি কোথায় যাবেন বাথরুমে যেতে হয় আমরা যাব, আমরা যাচ্ছি৷
ডাঃ বাঁড়ুজ্জে হতাশ হয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন৷ তখন তাঁর আর করবার কিছুই রইল না৷