দ্যোতমানা শক্তির বৈবহারিক অভিব্যক্তি তোমরা ব্যষ্টিগত জীবনে হয়তো অনেক বারই দেখে থাকবে৷ এ সম্বন্ধে দু’একটা ছোট ছোট গল্প শোনাচ্ছি, মিলিয়ে দেখ৷
একজন জাঁদরেল১ কর্ষক২ ছিল৷ তার নাম শ্রীমান দন্তবিকাশ ন্যাজসর্বস্ব৷ (এটি পদবী)৷ শ্রীমান দন্তবিকাশ শ্বশুরালয়ে গেছেন৷ সেখানে যত্ন–আত্তির (‘আত্তি’ শব্দটা আত্মীয়তা থেকে এসেছে) কোন কসুর ছিল না৷ দন্তবিকাশের শ্বশ্রূ–ঠাকুরাণী৩ তাঁর জন্যে ষোড়শ উপাচারে জামাইভোগের ব্যবস্থা করেছেন৷ তারই সঙ্গে পাতের একটি কোণে রেখে দিয়েছেন ছাঁকা তেলে ভাজা দু’একটি গরমাগরম গুড়া পিঠে–বলা যেতে পারে একেবারে খোলা থেকে নোলা৷ জামাই বাবাজী অর্থাৎ শ্রীমান দন্তবিকাশ একটি গুড়পিঠে খেয়েই একেবারে তুরীয় স্তরে পৌঁছে গেল৷ দ্বিতীয়টির সময় তার আর বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছে না৷ আমতা আমতা করে সে শুধোলে–মা ঠাকরুণ, আর দু’একটা এই জিনিসটা হবে? মা ঠাকরুণ বললেন–দু’একটা কেন বাবা, এক্ষুনি তোমার জন্যে দু’চার ডজন এনে দিচ্ছি৷ দন্তবিকাশ সেগুলি গলাধঃকরণ করে যথাবিহিত সম্মানপুরসর শ্বাশুড়ীকে শুধোলে–‘মা ঠাকরুণ, এর নাম কী? শ্বশ্রূ ঠাকুরাণী বললেন–সংস্কৃতে একে বলি ‘মধুপিষ্টকী’, বাংলায় গুড়পিঠে৷
শ্রীদন্তবিকাশ স্ব–গ্রাম অভিমুখে রওনা হল৷ শ্রীদন্তবিকাশের তেমন অক্ষরজ্ঞান ছিল না৷ তাই ‘গুড়পিঠে’ শব্দটা লিখে রাখা সম্ভব ছিল না৷ সে পথ চলছে মার্চিং–এর রীতিতে৷ তবে লেফ্ট রাইট না বলে বলছে গুড়–পিঠে...গুড়–পিঠে...গুড়–পিঠে.....গুড়–পিঠে৷
শ্রীমান দন্তবিকাশের কথা বলতে গিয়ে আমার একটা পুরোনো দিনের ছবি মনে পড়ছে৷ সেটা ১৯৪৩ সাল .... ইংরেজ আমল...... আমি তখন একজন সামরিক শিক্ষার্থী৷ আমাদের যাঁরা প্যারেড শেখাতেন তাঁরা ছিলেন স্ক্টিশ্ হাইল্যাণ্ডার.... খুবই দক্ষ সৈনিক৷ তাঁদের সব কিছুই ভাল ছিল৷ তবে তাঁদের উচ্চারণ ভারতবাসীর কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য ছিল৷ আমরাও তাঁদের দেখাদেখি (অর্থাৎ শোনাশুনি) কম্যাণ্ড করবার সময় বলতুম, ‘ইল্লেফৎ–আইৎ, ‘ইল্লেফ্ৎ–আইৎ’৷ সামরিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমনও কিছু ছিলেন যাঁরা লেখাপড়া কিছুই জানতেন না৷ ‘ইল্লেফৎ আইৎ’ তাঁদের কাছে ছিল একেবারেই দুর্বোধ্য৷ তাঁদের জন্যে বিশেষ ধরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ তাঁদের বাঁ পায়ে বেঁধে দেওয়া হ’ত কিছুটা খড় ও ডান পায়ে বেঁধে দেওয়া হ’ত কিছুটা বিচালিও (ঘাস জাতীয় বৃহদাকার উদ্ভিদ যা মুখ্যতঃ পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ বিচালির দড়িও হয়)৷ তাঁদের ‘ইল্লেফৎ–আইৎ’–এর পরিবর্ত্তে বলানো হ’ত খড়–বিচালি....খড়–বিচালি....খড়–বিচালি৷ তাঁরা যখন ‘‘খড়–বিচালি’’–তে অভ্যস্ত হয়ে যেতেন তখন খড়–বিচালির–আইৎ পরিবর্ত্তে তাঁদের শেখানো হ’ত ‘ইল্লেফ্ৎ–ইল্লেফ্ৎ–আইৎ’৷
শ্রীমান দন্তবিকাশ স্ব–গ্রামের দিকে এগিয়ে চলছে ছন্দের তালে তালে–গুড়পিঠে....গুড়পিঠে....গুড়পিঠে....গুড়পিঠে৷
সামনে একটা প্রকাণ্ড নালা৷
দন্তবিকাশ বাবাজীবন তখন মারে–জোয়ান–হেঁইয়ো বলে এক লাফে নালার ওপারে পৌঁছালো৷ কিন্তু একি গুড়পিঠে যে তার স্মৃতিপট থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছে৷ তখনও দন্তবিকাশ মার্চিং–এর রীতিতে এগিয়ে চলেছে৷ নোতুন বোল হয়েছে–কী যে খেলুম....কী যে খেলুম....কী যে খেলুম....কী যে খেলুম৷
বাড়ীতে পৌঁছে দন্তবিকাশ তার মাকে বললে–সেই যে শ্বশুর বাড়ীতে ‘কী যে খেয়ে এলুম’ তা–ই তৈরী করে দাও৷ তার মা বললে–কী খেয়ে এলি বল্, তবে না তৈরী করে দোব৷ দন্তবিকাশ বার বার বলে চলল–সেই যে কী যে খেলুম.....সেই যে কী যে খেলুম.....সেই যে কী যে খেলুম৷
তার মা কিছুতেই তার বক্তব্য বুঝতে পারে না৷ তখন দন্তবিকাশ তার মায়ের ওপর জোর হম্বিতম্বি শুরু করে দিলে৷ পাড়াপড়শীরা ছুটে এল৷ দন্তবিকাশের মা উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললেন–পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন৷ মূর্খের অশেষ জ্বালা মূর্খ ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল৷ জ্ঞানীরা সেইজন্যে বলে থাকেন–
‘‘অজাত–মৃত–মূর্খাণাং বরমাদৌ না চান্তিমঃ৷
সকৃত দুঃখকরাবাদ্যাবন্তিম্ পদে পদে৷৷’’
পাড়ার লোকে দন্তবিকাশের মাকে শুধোলে–‘‘এটা কী শোলোক বল্লে গা, ওর মানে কী?’’ দন্তবিকাশের মা বললে, ওতে বলা হয়েছে যার ছেলে জন্মায়নি তার একটাই দুঃখ৷ সে লোকের কাছে কেঁদে বলে, আমার ছেলে–পিলে নেই গো৷ যার ছেলে হয়ে মরে গেছে, তারও একটাই দুঃখ৷ সেও শিরে করাঘাত করে বলে, ছেলেটা ম’রে গেল গো, মা বলে ডাকতে কেউ রইল না৷ কিন্তু যার ছেলে আছে অথচ সে ছেলে মূর্খ–তার প্রতি পদে মূর্খ ছেলেকে নিয়ে নিজের তো জ্বালা–যন্ত্রণা আছেই, পাড়া–পড়শীরাও এব্লা এ বলে তোমার ছেলে এই করেছে, ওব্লা ও বলে তোমার ছেলে ওই করেছে৷ শুনে শুনে কান ঝালাপালা, প্রাণ পালাপালা৷ তাই জ্ঞানীরা বলেন–ছেলে না থাকা অথবা ছেলে মরে যাওয়া বরং ভাল কারণ ওই দু’টো ক্ষেত্রে দুঃখ থাকে একটাই কিন্তু মূর্খ ছেলের বেঁচে থাকা একেবারে ভাল নয়৷ কারণ সেক্ষেত্রে প্রতি পদেই দুঃখ ভোগ করতে হয়৷ তা আমার এই দাঁত বের করা দন্তবিকাশ মূর্খ বলেই আমার কী দুর্গতি হচ্ছে তোমরা তো দেখছো৷ আমার দুঃখ দেখে বনের শেয়ালও কাঁদে, ডোবার মশাও ডুকরে কেঁদে ওঠে৷ দেখ দেখি তোমরা –পিঠটা আমার কীরকম ফুলিয়ে দিয়েছে–পিঠটা ফুলে গুড়পিঠের মত হয়ে গেছে৷ দন্তবিকাশ সোল্লাসে বলে উঠল–ওই জিনিস.....ওই জিনিস.......ওই জিনিস৷ আগে বললেই তো হত৷