‘ইহ’ মানে ‘এই জগতে’৷ মনে রাখা দরকার ‘অত্র’ আর ‘ইহ’ এক জিনিস নয়৷ ‘অত্র’ মানে এখানে–এই স্থানে আর ‘ইহ’ ব্যবহূত হয় অনেক ব্যাপকার্থে......‘এই লোকে’/‘এই জগতে’৷ ‘ইহ’‘ঠক্’ প্রত্যয় করে আমরা পাচ্ছি ‘ঐহিক’ শব্দটি৷ তার বিপরীত শব্দ হচ্ছে ‘পরত্র’ থেকে ‘পারত্রিক’ ‘ইহলৌকিক’–বিপরীত শব্দ ‘পারলৌকিক’৷ ‘ইহলোক’–বিপরীত শব্দ ‘পরলোক’৷ ‘ইহ তিষ্ঠ’ না বলে ‘অত্র তিষ্ঠ’ বলা বেশী সঙ্গত হবে৷ ‘ইহ তিষ্ঠ’ মানে ‘এই জগতে থাকো’৷ আর ‘অত্র তিষ্ঠ’ মানে ‘এইখানটিতে থাকো’৷ সুপ্রাচীনকাল থেকেই ‘ইহ’ শব্দটি অব্যয় রূপে ব্যবহূত হয়ে এসেছে৷
ইহলোক আর পরলোকের মধ্যে অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত থেকে যায় এক সূক্ষ্ম স্বর্ণরেখা৷
সে অনেক দিন হয়ে গেল৷ তখন দিল্লীতে নিজের বাড়ী ছিল না৷ থাকতুম কখনো হোটেলে, কখনো ভাড়া বাড়ীতে৷ সেবার হোটেলেই ছিলুম৷ সান্ধ্য–ভ্রমণ সেরে হোটেলে ফিরলুম রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটায়৷ বাথরুমে গিয়ে বেসিনে হাত–মুখ ধুচ্ছি, হঠাৎ পেছন দিক থেকে শুনলুম আগেকার সুপরিচিত মিষ্টি আওয়াজ–‘কেমন আছো?’ ভাবলুম–এ কী এ যে আমার ছোটবেলাকার অতিপরিচিত দুলু পালিতের আওয়াজ দুলু একাধারে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও৷ দুলুর বাড়ী ছিল মগরার কাছে......অভিজাত পরিবারের ছেলে৷ দুলু পালিত, ব্রজগোপাল সান্ন্যাল ও আমার মধ্যে ছিল নিবিড় বন্ধুত্ব৷ দুলু পালিত ও ব্রজ সান্ন্যাল ছিল অত্যন্ত রূপবান৷ ওদের মনের সৌন্দর্য ছিল আরও বেশী৷ পরোপকার ছিল তাদের সহজাত সংস্কার৷ কিন্তু এখানে এই হোটেলের বাথরুমে সেই দুলুর আওয়াজ কোত্থেকে এল কী করেই বা এল আমি স্বপ্ণও দেখছি না, সুস্থ শরীরে, সুস্থ মস্তিষ্কে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত–মুখ ধুচ্ছি–এ তো শোনার ভুল হতে পারে না, ভাবার ভুলও হতে পারে না
দুলু এবার একটু অভিমানের সঙ্গে বললে–‘‘তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো? আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?’’
হ্যাঁ, বলে রাখি, দুলু আমায় বড্ড বেশী ভালবাসত৷ সে আমাকে ছোটবেলায় কয়েকবারই বলেছিল–যেমন কৃষ্ণলীলার সুদামা–কৃষ্ণের সম্বন্ধ তেমনই আমাদের সম্বন্ধ৷ সুদামা কৃষ্ণকে বড্ড ভালবাসত৷ কৃষ্ণও সুদামাকে খুব ভালবাসত৷ ও আমাকে বলত–‘‘দেখ, আমরা একে অন্যকে এত বেশী ভালবাসব যে কৃষ্ণ–সুদামাকেও হার মানিয়ে দোব৷’’
আমি বলেছিলুম–‘‘আমি তেমন পারব কিন্তু তুমি কি তেমন পারবে?’’
ও বলেছিল–‘‘নিশ্চয় পারব, দেখে নিও’’
আজ সেই দুলুর আওয়াজ পেলুম৷ আর সে অভিমানের সুরে বলছে–‘‘আমি তার দিকে তাকাচ্ছি না কেন’’
আওয়াজ আসছিল যেন আমার পেছনের দিক থেকে৷ পেছনের দিকে দেওয়ালে তাকিয়ে দেখি, দেওয়ালের গায়ে দুলু আলোকোজ্জ্বল পূর্ণাবয়বে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর আমার দিকে চেয়ে আনন্দে হাসছে৷ আমি তাকাতেই সে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠে বললে–‘‘কেমন আছো? তোমার জন্যে ক’দিন হ’ল আমার মনটা ছটফট করছিল৷ এখন তোমাকে কাছে পেয়ে বাঁচলুম৷’’
আমি বললুম–‘‘আমি বেশ ভালই আছি৷ এবার কলকাতায় গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করক্ষ৷’’
ও বললে–‘‘নিশ্চয়, নিশ্চয়৷’’ তারপর একটুখানি পরে বললে–‘‘আমাকে তোমার পছন্দমত কোনো কাজে লাগিয়ে নাও৷ এতে আমার সুক্ষিধে হবে এই যে, সব সময় তোমার কাছে থাকা যা্বে৷ যদি কখনো কাছে না–ও থাকা যায় অর্থাৎ কাজ নিয়ে বাইরে কোথাও যেতেও হয় তাহলেও মনে এই পরিতৃপ্তি থাকবে যে তোমার কাজ করতেই বাইরে যাচ্ছি৷’’
আমি বললুম–‘‘তেমনটিই হবে৷ আমি ক’দিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরছি৷’’
এমন সময় টেলিফোনের আহ্বান আসায় শোবার ঘরে চলে এলুম৷ ফোন ধরতেই ওদিক থেকে আওয়াজ এল–‘‘আমি ব্রজগোপাল সান্ন্যাল কলকাতা থেকে বলছি৷’’
ব্রজগোপাল আমার ছোটবেলাকার বন্ধু৷ ও ভালভাবেই জানত, দুলু পালিত আমাকে ছাড়া থাকতেই পারে না....কতকটা যেন ত্ব–এর পাশে হু–এর মত৷
আমি ব্রজকে বললুম–‘‘কী বলছো?’’
ব্রজ বললে–‘‘আমাদের ছোটবেলাকার বন্ধু দুলু পালিত ক’দিন ধরেই বড্ড বেশী অসুস্থ৷ আমি এখন ওর বাড়ী থেকেই ফোন করছি৷’’
আমি বললুম–‘‘কী হয়েছে?’’
ব্রজ বললে–‘‘কী হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না৷ নাড়ীর গতি স্বাভাবিক, কোনো রোগ–ভোগ নেই, জ্বর–জ্বালাও নেই৷ ডাক্তার বলছে, কোনো রোগই ধরা পড়ছে না’’৷
আমি বললুম–‘‘তবে কী হয়েছে?’’
ব্রজ বললে–‘‘ও কেবল শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর তোমার কথা বলছে৷ বলছে কতদিন দেখা হয়নি, আবার কবে দেখা হবে কে জানে পরিচিত কাউকে দেখলেই তাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছে, আর বলছে, কবে দেখা হবে কে জানে’’
আমি ব্রজকে জানালুম যে, সব কাজকর্ম ফেলে রেখে আমি কালকের প্লেনেই দিল্লী থেকে কলকাতা পৌঁছোচ্ছি৷ আর বিমান বন্দর থেকে সোজা ওর বাড়ীতেই যাব৷
ব্রজ আশ্বস্ত হয়ে ফোন ছেড়ে দিল৷ আমি আবার বাথরুমে গেলুম দেওয়ালের দুলুর সঙ্গে আরও কথা বলতে–সেই কোটপ্যান্টপরা আলোকোজ্জ্বল দুলু৷ বললুম–‘‘তারপরে বলো কী খবর৷ এখন তাহলে ভালই আছো৷’’
ও বললে–‘‘ভাল বলে ভাল, খুব ভাল৷ তোমাকে কাছে পেয়ে কত যে ভাল লাগছে কী বলব৷ মনে হচ্ছে এমন ভালর মধ্যে মরাও ভাল৷’’ সেই যে কবি বলেছেন না–
‘‘এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো
সে মরণ স্বর্গসমান৷’’
আমি বললুম–‘‘মরণের কথা–টথা বলবে না,
তাহলে আমি ভীষণ রেগে যাব৷ তোমাকে বকাঝকা করব৷ আমার মেজাজটা তো তুমি ভালভাবেই জানো৷’’
ও বললে–‘‘তোমাকে আমি রাগতে দোব না, মরণের কথা বলব না৷’’
আমি বাথরুম থেকে হাত–মুখ ধুয়ে ফিরছি৷ ঘড়িতে তখন ন’টার ঢং ঢং আওয়াজ শুনলুম৷ আর দুলুর দিকে তাকাতেই দেখি, দুলুর চিত্র শাদা দেওয়ালে মিশে গেল৷ আমার খাবার সময় হয়েছে দেখেই বোধ হয় ও চলে গেল৷
শোবার ঘরে এলুম৷ কয়েক মিনিট পরে কলকাতা থেকে ফোন এল৷ আবার সেই ব্রজগোপাল সান্ন্যালের কন্ঠস্বর৷ ও বললে–‘‘তোমাকে অত্যন্ত দুঃসংবাদ জানাচ্ছি, আমাদের দুলু এইমাত্র ঠিক ন’টার সময় আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে চলে গেল৷ বুঝলে, আমার সব কিছুই গোলমেলে ঠেকছে৷ বুঝতে পারছি না কোন্টা ইহলোক, কোন্টা পরলোক৷