সে অনেকদিন আগেকার কথা৷ স্র্যামপুরের পাঁচু দাস অভাবে পড়ে কিরিস্তান হয়েছিল৷ সেবার বাঙলায় ধান ভাল হয়নি৷ বেশ অভাব–নটন চলছিল৷ পাঁচু দাস গীর্জেয় (এটি একটি আইবেরিয়ান শব্দ) গিয়ে পাদরী (এটিও একটি আইবেরিয়ান শব্দ) সাহেবের কাছে কিছু ভিক্ষে চেয়েছিল৷ পাদরী সাহেব তাকে আদর–যত্ন করে পেট ভরে খাইয়ে দিয়েছিলেন আর স্র্যামপুর শহরবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে পাঁচুর জাত গেছে৷
গোড়ার দিকে পাঁচু বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে সে গীর্জেয় গিয়ে ভাত–ডাল খেয়েছিল ঠিকই কিন্তু জল খায়নি৷ তাই তার জাত যায়নি৷ কিন্তু পণ্ডিতেরা তা মানতে রাজী হলেন না৷ তাঁরা বললেন–ভাত–ডালের সঙ্গে তো জল থাকেই৷ সুতরাং পাঁচু জলও খেয়েছে, তার জাতও গেছে৷ আর তাই তাকে সমাজে রাখা যায় না৷
যথাকালে গীর্জেয় ঘটা করে পাঁচুকে নাম দেওয়া হল এরিক্ এডওয়ার্ড পাঁচু ডায়াস৷ সমাজ থেকে যখন তাকে তাড়িয়েই দেওয়া হয়েছে তখন পাঁচু আর কী করে৷ সে খিরিস্তান হল৷ ‘এরিক এডওয়ার্ড’ শব্দ দু’টো রয়ে গেল পোষাকী নাম হিসেবে৷ আটপৌরে নাম হিসেবে ‘পাঁচু ডায়াস’–ই চলতে থাকল৷ পাঁচুর সাধ্বী স্ত্রী আহ্লাদী দাসীও ক্রিস্তান হল৷ পাদরী সাহেব তাকে নূতন নাম দিলেন মার্গারেট আহ্লাদী ডায়াস৷ আহ্লাদীর নামটা পসন্দ হল বটে, কিন্তু উচ্চারণ করতে তার প্রাণান্তকর অবস্থা৷ তাই কেউ নাম শুধোলে সে আহ্লাদী দাসীই বলত৷
শ্রীরামপুরের নাম তখন ফ্রেডারিক টাউন৷ শহরটিতে কিছুদিনের জন্যে দিনেমারদের কুঠি ছিল৷ ডেনমার্কের রাজা ফ্রেডারিকের নামে স্থানটির নামকরণ হয়েছিল৷ এই শহরের মাধ্যমে কিছু কিছু ডেনিস শব্দ বাংলা ভাষায় ঢোকবার সুযোগ পেয়েছিল৷ ‘পাঁড়’, ‘ফোঁটা’ প্রভৃতি শব্দগুলো এইভাবেই বাংলায় এসেছে৷ শব্দ দু’টোর কোনোটাই বিশুদ্ধ ডেনিস নয়৷ তবে পশ্চিম ইয়ূরোপের কয়েকটি দেশেই এদের প্রচলন রয়েছে৷ আর দিনেমারদের মুখে মুখেই এগুলো বাঙলায় ছড়িয়েছিল৷
কিছুদিন আগে ডেনমার্কে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলুম যে তাঁরা তাঁদের অনেক পুরোনো শব্দ ত্যাগ করে গত ২০০ বছরে প্রচুর পরিমাণে ইংরেজী শব্দ গ্রহণ করেছেন৷ আমি আর তাঁদের মুখে ‘পাঁড়’ ও ‘ফোঁটা’ শব্দ শুণতে পাইনি৷ হয়তো বা গ্রামাঞ্চলে এখনও কিছু কিছু চলে৷ ‘ভ্রাতৃদ্বিতীয়া’–কে বাঙলায় যে ‘ভাই–ফোঁটা’ বলে সেই ‘ভাই–ফোঁটা’ শব্দটিও খুক্ষ বেশী দিনের নয়৷ কারণ ইয়ূরোপীয়েরা এদেশে আসবার আগে ‘ফোটা’ (‘ফোঁটা’–র খাঁটি দেশজ বাংলা হচ্ছে ‘টোপা’ (‘টোপা কুল’ স্মর্তব্য)৷ ওড়িষ্যায় আজও এই ‘টোপা’ শব্দটি চলছে৷ গ্রাম–বাঙলায় কিছু কিছু চলে৷ শিশিরবিন্দুকে এখনও ওড়িশায় বলা হয় ‘কাকর–টোপা’৷) শব্দটি নিশ্চয় ছিল না৷ পাঁড় মাতাল (পাকা মাতাল), পাঁড় পেয়ারা (পেয়ারা’ শব্দটি এসেছে আইবেরিয়ান ‘পিয়ারো’ শব্দ থেকে৷ এর কোনো সাবেকী সংস্কৃত প্রতিশব্দ নেই৷ ‘পেয়ারা’ থেকে গৃহীত সংস্কৃত হয়েছে ‘পেরুকম্ বীজ–পুরকম বা’৷) (পাকা পেয়ারা) প্রভৃতি শব্দগুলিও নিশ্চয় ছিল না৷ এখনও বাঙলার নিকটবর্ত্তী রাজ্যগুলিতে এই শব্দগুলি ঢোকেনি৷ ভ্রাতৃ–দ্বিতীয়াকে উত্তর ভারতে ‘ভাই–ফোঁটা’ না বলে বলা হয় ‘ভাই–দুজ’৷
ফ্রেডারিক টাউনের নাম বদলে তার সাবেকী নাম স্র্যামপুর (শ্রীরামপুর) ফিরে এল ইংরেজদের দখলে আসার পর৷ তবে লোকের মুখে মুখে ফ্রেডারিক টাউন নামটা চলেছিল তার পরেও আরো কিছুকাল ধরে৷
এই স্র্যামপুরের পাঁড় মাতাল ছিল দুলাল মুখুজ্জে* (*‘মুখার্জী,’ ‘ব্যানার্জী’, ‘চ্যাটার্জী’ শব্দগুলি ছিল পাদরী সাহেবদের তৈরী৷ হয় তাঁরা ‘মুখুজ্জে’, ‘বাঁড়ুজ্জে’, ‘চাটুজ্জে’ উচ্চারণগুলি করতে পারতেন না অথবা খ্রিস্তান হওয়ার প্রমাণ স্বরূপ ওই পদবীগুলিকে তাঁরা কিঞ্চিৎ বিকৃত করে দিয়েছিলেন৷ গাঙ্গুলী ও ঘোষালেরা এই বিকৃতির হাত থেকে বেঁচে গেছলেন কারণ সংখ্যায় তাঁরা খুব কম ছিলেন৷)৷ তার তখন তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে৷ তবু বয়সের তুলনায় তার জ্ঞানগম্যি–হুঁশ–আক্ক্ কিছুই হয়নি৷ একদিন সে মদ খেয়ে নালীতে পড়ে রয়েছে৷ এমন সময় সেখানকার পাদরী সাহেব তাকে সেই অবস্থায় দেখতে পেয়ে তুলে গীর্জেয় নিয়ে গেলেন৷ তারপর তাকে পেট ভরে পাঁউরুটি–চপ–কাটলে খাইয়ে দিলেন৷ দুলাল মুখুজ্জে তো এটাই চাইছিল৷ কিন্তু ফ্যাসাদ বাধালেন পাদরী সাহেব নিজেই৷ তিনি ঢোল সহরৎ জানিয়ে দিলেন দুলাল মুখুজ্জে নিষিদ্ধ খাদ্য খেয়েছে ও আরো খাবার জন্যে বায়না ধরেছে৷ পণ্ডিতদের সভা বসল৷ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হল যে এহেন যবন ভাবাপন্ন দুলাল মুখুজ্জেকে আর সমাজে রাখা যায় না৷
দুলাল সমাজচ্যুত হল৷
যথাকালে যথাবিহিত পদ্ধতিতে দুলালের নূতন নাম হল এডমন্ড দুলাল মুখার্জ্জী৷ দুলালের শ্বশুর কিন্তু বেঁকে বসলেন৷ তিনি তাঁর মেয়েকে কৃশ্চান জামাইয়ের সঙ্গে ঘর করতে দিতে নারাজ৷ এডমন্ড দুলাল বউকে আনতে গেলে শ্বশুরমশায় তাকে নাদনা–পেটা করে তাড়িয়ে দিলেন৷ একঘর ছেলেমেয়ে নিয়ে দুলালের বউ বাপের বাড়ীতেই থেকে গেল৷
পাদরী সাহেবের হল এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া৷ দুলালের জন্যে একটি বউ খুঁজতে তিনি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ দুলাল প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে, সে যখন মাদার মেইরীর (এই থেকে বাঙলায় ‘মাইরী’ শব্দটি এসেছে৷) শরণে এসেছে, তখন তার দৌলতেই তার একটা বউও জুটে যাবে৷
এদিকে এরিক এডয়ার্ড পাঁচু ডায়াসের ধর্মপত্নী আহ্লাদী দাসী দু’বেলা পাঁচুর সঙ্গে ঝগড়া করে চলেছে৷ বলছে–মেয়ে সোমত্ত হয়েছে, বিয়ে দেবে না গা? তুমি কেমন মানুষ এইভাবে যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকো তাহলে আমি মেয়েকে নিয়ে ঘরকে চলে যাব৷ সেখানে গয়না বেচে পুরোনো নিয়মে মেয়ের বিয়ে দোব৷
পাঁচুও মহা ফ্যাসাদে পড়ল৷ আহ্লাদী বললে, মেয়ে এখন ডাগর হয়েছে৷ আর কি ওকে ঘরে রাখা যায় পাঁচ পেরিয়ে এবার ছ’য়ে পড়েছে৷ লোকে যে গালে চূণকালি দেবে আমার গলায় যে ইলীশ মাছের কাঁটা বিঁধে রয়েছে৷
পাঁচু পাদরী সাহেবের দ্বারস্থ হল৷ পাদরী সাহেব হাতে স্বর্গ পেলেন৷ তিনি তো এটাই চাইছিলেন৷ তিনি বললেন–পাট্রো টো হাটেই রহিয়াছে৷ এডমন্ড ডুলাল খুব ভালো পাট্রো আছে৷
পাঁজিপুঁথি দেখে শুভদিনে শুভক্ষণে শাঁখ বাজিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে সিঁথেয় (শব্দটি ‘সীমন্ত’ থেকে এসেছে৷ যথাবিধি বিচারে শব্দটি হওয়া উচিত ‘সীমান্ত’৷ কিন্তু ভুল শব্দ ‘সীমন্ত’ আজও অক্ষত রয়েছে৷ মহিলাদের আজও ‘সীমন্তিনী বলা হয়৷) সিঁদুর ঢেলে পাঁচুর মেয়ের সঙ্গে এডমন্ড দুলাল মুখার্জীর বিয়ে হয়ে গেল৷ সাত পাক ঘোরা, এয়োদের নিয়ম–কানুন, স্ত্রী–আচার, দেশাচার সব কিছুই যথাবিধি হল৷ কেবল পুরুত মশায়ের বদলে বসলেন পাদরী সাহেব৷
বিয়ের ঝক্কি–ঝামেলা শেষ হয়ে যাবার পরে পাঁচু আহ্লাদীকে ডেকে বললে–দেখলি আহ্লাদী, তুই তো উল্টোপাল্টা কথা বলছিলি৷ আজ তুইই ভেবে দেখ, ভাগ্যিস খ্রিশ্চান হয়েছিলি, তাই তো অমন টুকটুকে বামুন জামাই পেলি৷ আগেকার সমাজে থাকলে এমনটি কি ভাবতে পারতিস মানছি, জামাই একটু–আধটু পান করে৷ তা অমন পান তো আমাদের পাদরী সাহেবও করে৷ আর পাড়ার ভট্চাজ্ মশায় তো কালী পুজোর রাত্রে কারণবারির নামে বোতলের পর বোতল রঙ টেনে যায়৷ আর যদি কেউ বলে জামাইয়ের গাল তোবড়া তাহলেও দেখ ও তো আর এমন কিছু বুড়ো হাবড়া ঘাটের মড়া নয়৷ তাছাড়া গাল একটু তোবড়া হলেও একেবারে টোল খাওয়া নয়৷ আর পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের সঙ্গে পাঁচ বছর বয়সের কনের বিয়ে এমন কিছু বেমানান নয়৷ কুলীন বামুনের ঘরে তো পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে নব্বই বছর বয়সের ঘাটের মড়ারও অন্তর্জলির সময় মালাবদল হয়ে যায়৷ বিয়ের পাঁচ মিনিট পরেই কনে হয়তো বিধবা হয়৷ তাতে আর হয়েছে কি....আইবুড়ো নাম তো খণ্ডানো গেল......কৌলীন্য তো বাঁচল.....গাঞি হারিয়ে চক্কোত্তি তো আর হতে হল না৷ তা যাই হোক্, জামাইয়ের জন্যে এখন ভাল করে ক্রিস্মাস কেক তৈরী কর৷
আহ্লাদী জিজ্ঞেস করলে–সে আবার কী জিনিস গা?
এরিক এডওয়ার্ড পাঁচু ডায়াস বললে–আরে গুড়পিঠে....গুড়পিঠে....গুড়পিঠে....জানিস না? এই পিঠেকেই সাহেবরা কেক বলে৷
মার্গারেট আহ্লাদী দাসী তখন আহ্লাদে আটখানা৷ গুড়পিঠে তৈরী করতে সে ভালই জানে৷