‘ক্রথ্’ ধাতুর অর্থ হ’ল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কাউকে হত্যা করা৷ দেবোদ্দেশ্যে বা ধর্মের নামে পশুহত্যা এই পর্যায়ে পড়ে৷ ক্রথ্ + অচ্ = ক্রথ৷ ‘ক্রথ’ মানে যাকে হত্যা করা হচ্ছে৷ ক্রথ্ ল্যুট্ = ক্রথন মানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হত্যা করা, ধর্মের নামে হত্যা করা, অথবা যাকে হত্যা করা হচ্ছে৷ কেউ যদি ভাবে ধর্মের নামে পশু–হত্যা করলে উভয় পক্ষেরই লাভ অর্থাৎ মানুষের লাভ দুটোঃ তার লোল জিহ্বা পাবে নিরীহ পশুর মাংস আর অর্জন করবে পুণ্য আর ওই নিরীহ হতভাগ্য পশু, যে জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিল মানুষ নামে জীবকে বিশ্বাস করে, সে পাবে পশুজীবন থেকে মুক্তি–এ ধরনের জিনিসগুলি ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া কিছুই নয়৷ সম্ভবতঃ মানুষ জাতের ইতিহাসে এই ধরনের স্বার্থপরতা ও ধর্মের নামে অধর্ম নির্মোকের প্রথম বিরোধিতা করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ৷ সেই যে গল্প আছে না–
এজন পরম শাক্ত প্রতি বছর ঘটা করে কালীপূজা করতেন৷ হঠাৎ দেখা গেল পঞ্চাশ বছর বয়সে তার ভীমরতি ধরেছে৷ লোকে শুধোলে–হ্যাঁগো, এতদিন ধ’রে নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করে এলে আর এই পঞ্চাশ বছর পরে এমনকি ভীমরতি ধরল যে পুজোটিই বন্ধ ক’রে দিলে?
সে বললে–হ্যাঁ ভাই, কী আর করব৷ গত বছর অবধিও দু’চারটে দাঁত ছিল, এবছর একটা দাঁতও আস্ত নেই৷ অথচ বলি তো দিতেই হবে৷ কী করি বল৷ বলি না দিলে তো পুজোয় খুঁত হয়ে যাবে৷ তাই পুজোটিই বন্ধ করে দিলুম৷
দেবোদ্দেশ্যে কোন স্বার্থপূর্ত্তির পরে কোন বিশেষ ধরনের বলি দেওয়াকে ‘ক্রথ’ ধাতুর আওতায় আনা যায়, অর্থাৎ হে জগজ্জননী, হে বিশ্বমাতা, তুমি আমার ছেলেটাকে পরীক্ষায় পাস করিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে দাও মা৷ মেয়ের বিয়ের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে মরছি৷ বিনা পণে একটি সৎপাত্র জুটিয়ে দাও মা, তোমাকে জোড়া পাঁঠা বলি দেব৷ এই পাঁঠা বলিও ‘ক্রথ’ ধাতুর অন্তর্ভূক্ত৷ দেবতার সঙ্গে এটি একটি দেনা–পাওনার –স্বার্থ বিনিময়ের খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়৷
‘‘জগৎ যে মায়ের ছেলে
তার কি আছে পর–ভাবনা৷
তুমি তৃপ্ত করতে চাও মায়েরে,
হত্যা করে ছাগলছানা৷৷’’
এ ব্যাপারে আবার অনেক মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে পাটোয়ারী বুদ্ধির খেলাতেও নেবে পড়ে৷
একবার শুণেছিলুম একজন অতিভক্ত মায়ের কাছে মানত করেছিল তার ছেলেটার একটা চাকরি জুটলে আর মেয়েটা পাত্রস্থ হলে সে মায়ের মন্দিরে জোড়াপাঁঠা চড়াবে৷ যথাকালে মায়ের দওলতেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক ছেলেটার একটা হিল্লে হ’ল, মেয়েটার মাথাতেও বিয়ের জল পড়ল৷ একবার তাকে নাকি স্বপ্ণে মা এসে বললেন–হ্যাঁরে, তোর কাজ করে দিলুম, জোড়াপাঁঠা চড়াচ্ছিস না কেন আমি আর কতকাল আলোচাল–মটরদানার সঙ্গে কাঁচকলা–ঘি–সন্ধব নুনের হবিষ্যি চালিয়ে যাব?
অতিভক্ত বললে–এই দেখ মা, বেমালুম ভুলে গেছলুম৷ সাতশ’ কাজে ব্যস্ত থাকি তো তা আমার আর কী দোষ৷ আমার সাতশ’ কাজে ব্যস্ত করে তুমিই তো রেখেছ৷ তা যাই হোক, পাঁঠার আজকাল আগুন–ছোঁয়া বাজার দর৷ আমার গ্যাঁট খসালেও অত টাকা নাববে না৷ তাই হাতীবাগান বাজার থেকে রোব্বারের হাটে তোমার জন্যে একজোড়া গোলাপায়রা এনে চড়িয়ে দোব৷
দিন গেল, মাস গেল৷ আবার ছ’মাস কেটে গেল৷ আবার নাকি মা এসে বলেছিলেন–হ্যাঁরে জোড়া পাঁঠা তো দিলি না, জোড়া পায়রারও তো মুখ দেখতে পেলুম না৷ তা তুই করছিস টা কী
সে বললে–দেখ মা, হাতীবাগান বাজারে গিয়ে পছন্দসই পায়রা পেলুম না৷ কোনটার ঠ্যাঙ ভাঙা, কোনটার ন্যাজ ছেঁড়া, ওই সব খঁুতের জিনিস দিয়ে তো আর তোমার সামনে বলি দেওয়া যায় না৷ আমাকে তো মা’র মন যুগিয়ে চলতে হবে৷ তাই ভাবলুম তোমার জন্যে এক জোড়া আখ বা একজোড়া ছাঁচি কুমড়ো বলি দোব৷
মা নাকি তাকে বলেছিলেন–যা করবার তাড়াতাড়ি সেরে ফেল৷ তোর জন্যে আমি তো আর আলাদা এ্যাক্কাউণ্ঢ (হিসেবপত্র.....খেরো খাতায়) রাখতে পারব না৷
আবার ছ’মাস কেটে গেল৷ আবার নাকি মা এসে তাকে বললেন–হ্যাঁরে আখও দিলি না, ছাঁচি কুমড়োও দিলি না৷ ভেবেছিলুম শীতের দিনে একটু আখ চিবিয়ে খাব, ছাঁচি কুমড়ো দিয়ে নারকোল–কুমড়ি রাঁধব৷ তুই কী রে কী ধরনের কুপুত্তুর তুই৷
অতিভক্ত বললে–আমার আর কী দোষ বল৷ আমি ভাল আখ ও ছাঁচি কুমড়োর খোঁজে অনেকের ক্ষেতেই ঢুঁ মেরেছি৷ ভাল আখ আর ছাঁচি কুমড়োর ক্ষেতে সর্বত্রই কড়া পাহারা বসানো হয়েছে৷ তোমার জন্যে যে দু–চারটে তুলে আনব তার জো নেই৷ তার চেয়ে ভাবছি তোমার নামে এক জোড়া গঙ্গা ফড়িং বলি দোব৷
মা নাকি তাতে বিরক্ত হয়ে চলে গেছলেন৷ বলেছিলেন–তুই আমার কাছে পাটোয়ারী বুদ্ধি খাটাচ্ছিস, তোকে দেখে নোব ব্যাটাচ্ছেলে৷
আরও ছ’মাস চলে গেল৷ অতিভক্ত একজোড়া গঙ্গা ফড়িংও বলি দিলে না৷ এবার নাকি মা এলেন রণরঙ্গিণী মূর্ত্তি নিয়ে বললেন–আজই একটা হেস্তনেস্ত করব, আজই একটা এসপার ওসপার হবে৷ বল তুই আমার জন্যে বলি দিবি কি দিবি না?
অতিভক্ত বললে–মা, তুমি তো সর্বত্রই আছ৷ তা আমাকে নিয়ে আর কেন লীলাখেলা করছ৷ তোমার মন্দির থেকে এক ঢিলের রাস্তাতেই তো গড়ের মাঠ৷ সকাল সন্ধ্যেতেই তো সেখানে ফড়িং ওড়ে যথেষ্ট পরিমাণে৷ বর্ষার ভিজে হাওয়ায় বড় বড় গঙ্গা–ফড়িং আসে৷ তুমি কোনদিন প্রাতর্ভ্রমণে বা সান্ধ্যভ্রমণে দু’চারটে বা দু–চার ডজন কেন, যত ডজন ইচ্ছে গঙ্গাফড়িং ধরো আর খেয়ো৷ আমাকে আর নিমিত্তের ভাগী কর কেন
হ্যাঁ বলছিলুম কি, এই অতিভক্ত যদি কোন একটা বলি সত্যিসত্যিই দিত তবে সে বলি ‘ক্রথ্’ ধাতুর আওতায় আসত৷ একথা বলাই বাহুল্য যে ধর্মের নামে এই ধরনের পাটোয়ারী বুদ্ধি মানুষ সমাজে যথেষ্ট ক্ষতি করেছে৷ বিশ্বের স্রষ্টী শক্তির, আদ্যাশক্তির নামে এই ‘ক্রথ্’ ধাতুর ব্যবহার নিশ্চয় কোন শুভ চিন্তার দ্যোতক নয়৷