বিশ্বের পরিস্থিতি যে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে পেরিফেরিয়াল চেঞ্জ বা ছোটখাট পরিবর্তনে আর চলবে না, মানুষ চাইছে সর্বব্যাপক এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন৷ মানুষ চাইছে নোতুন আদর্শ, নোতুন জীবনবোধ বা মূল্যবোধ, নোতুন তত্ত্ব, মানুষের দুঃখ–দুদর্শার সত্যিকারের অবসান ঘটাতে পারবে এমন নোতুন অর্থনীতি৷ কী সেই নবতর অর্থনীতি? এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাউটের অর্থনীতির কথা সামনে আসছে৷
প্রাউটের অর্থনীতিকে কী বিশেষ নামে অভিহিত করব? অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমানে একচ্ছত্র রাজত্ব করছে যে বাজার অর্থনীতি বা মুক্ত বাজার অর্থনীতি – প্রাউট কি তারই অনুসারী না তার থেকে সর্বাংশে পৃথক? পৃথক হলে কী অর্থে পৃথক? এমনিতে প্রাউটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনেকগুলিই অভিনবত্ব বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ যেমন, সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ইত্যাদি৷ কিন্তু এই সবকিছুই শেষপর্যন্ত যে সফলভাবে রূপায়িত হবে তার প্রয়োগভৌমিক তথা বৈবহারিক (practical) চাবিকাঠিটি কী? এই অর্থে বলতে পারি ক্রয়ক্ষমতাই সেই চাবিকাঠি৷ তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় প্রাউটের অর্থনীতি হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতামূলক বা ক্রয়ক্ষমতার অর্থনীতি৷
আজ পৃথিবী জুড়ে চলছে পুঁজিবাদের অর্থনীতি, সেখানে অর্থের মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারে৷ বাজারের অসম প্রতিযোগিতায় যে টিকে থাকতে পারে সেই হয় যথেচ্ছ বিত্ত ও সম্পদের অধিকারী৷
বাজার অর্থনীতির দাপটে দারিদ্র্য, অসাম্য ও বেকারত্ব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি৷ বাজার অর্থনীতির সমর্থকদের বক্তব্য হচ্ছে তা হোক, কেননা সেই সঙ্গে আয়ও তো বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে, গ্রোথ অর্থাৎ বৃদ্ধি বাড়ছে৷ আমাদের প্রশ্ণ, বৃদ্ধি যদি হয়েই থাকে আর পৃথিবীর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ যদি তার অংশভোগী না হয় তবে সেই বৃদ্ধির প্রয়োজনটা কী? পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির সর্বাধুনিক রূপ বিশ্বায়ণ (globalisation)৷ আরও ভয়ংকর পুঁজিবাদ–যেন–তেন–প্রকারেণ দেশে দেশে বাজারকে সম্প্রসারিত করা৷ পুঁজিবাদের এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা থেকে মুক্তি পেতে সকলেই যখন পরিত্রাণ খুঁজছেন, সেই পরিস্থিতিতে এবার আমরা দেখি প্রাউটের অর্থনীতিতে কী সমাধান আছে৷
আমি অর্থ চাই এইজন্যে যে এই অর্থ ব্যবহার করে অন্যের কাছ থেকে – যার অর্থের প্রয়োজন আছে – আমার প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা (goods and services) পাব বা কিনে নোব৷ অন্যেও সেই অর্থ ব্যবহার করে একই কাজ করবে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পণ্যদ্রব্য ও সেবা যা আমি অর্থের বিনিময়ে আহরণ করছি, অর্থনীতির ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত সেটাই আসল কথা৷ সেটাই অর্থের প্রকৃত মূল্য অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা (practical)৷ উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক ২০০০ সালে আমার দৈনিক আয় ছিল ১০০ টাকা৷ এখন দৈনিক আয় ২০০ টাকা৷ আমি ২০০০ সালে ১০০ টাকা বাজারে নিয়ে গিয়ে যে পরিমাণ ভোগ্য দ্রব্য ক্রয় করতে পারতুম, বর্তমানে ২০০ টাকা দিয়ে যদি তার থেকে কম দ্রব্য ক্রয় করতে পারি তাহলে বুঝতে হবে আমার ক্রয়ক্ষমতা অবশ্যই কমেছে৷ তাই টাকার পরিমাণটা বড় কথা নয়, ক্রয়ক্ষমতাই বিচার্য৷ মানুষের এই ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চয়ই বাড়াতে হবে, অনবরত বাড়িয়ে চলতে হবে৷ তাতেই প্রতিটি মানুষের সত্যিকারের স্বাচ্ছন্দ, শ্রীবৃদ্ধি৷ তাই প্রাউটের মতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই ক্রয়ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে, পুনরাবর্তিত হবে৷ অর্থাৎ কোন দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বা প্রগতির মানদণ্ড তথা সূচক হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা – ক্রয়ক্ষমতা সূচক (purchasing power index) ৷ মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতির পরিচয় পাওয়া যায় মাথা পিছু আয় দেখে নয়, তার বাস্তবিক ক্রয়ক্ষমতা দেখে৷ তাই মাথাপিছু আয় সূচক (purchasing power index)৷ জি. ডি. পি সূচক, দারিদ্র্য সূচক – এসব নয়৷ এগুলি বিভ্রান্তিমূলক৷ তাই ক্রয়ক্ষমতাই প্রকৃত সূচক৷ আজ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ্রাও স্বীকার করছেন যে ক্রয়ক্ষমতা সূচক সম্পূর্ণ নোতুন কথা৷ শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ একথা বলেননি৷
প্রাউট প্রবক্তা শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার স্পষ্ট বলেছেন – ‘‘প্রতিটি ব্যষ্টির প্রগতিশীলভাবে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতেই প্রাউটের অর্থনীতির চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে৷ আজ বিশ্বের বহু অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতাকে অবহেলা করার জন্যেই তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে ও ঘনিয়ে আসছে দারুণ সংকট৷’’ তিনি আরও বলেছেন – ‘‘মানুষের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্যে সংশ্লিষ্ট দেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতার নিশ্চিততা লিখিতভাবে থাকবে৷ আর এই ক্রয়ক্ষমতাকে সংবিধানে এক মৌলিক মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷’’ শুধু নীতিগতভাবেই নয়৷ তিনি তাঁর অর্থনীতির বিস্তৃত আলোচনায় এই ক্রয়ক্ষমতা ক্রমবৃদ্ধির পথ ও পন্থার কথা নানাভাবে উল্লেখ করেছেন৷ এবার আমরা আসি সেই কথায়৷
কোন দেশের প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখা ও তার ক্রমবৃদ্ধি সম্ভব হবে মূলতঃ যে পাঁচটি ব্যবস্থার মাধ্যমে তা হচ্ছে নিম্নরূপ ঃ
প্রথমতঃ প্রত্যেক সক্ষম ব্যষ্টির জন্যে জীবিকার ব্যবস্থা থাকতে হবে৷ সেটা না থাকার জন্যেই সাধারণ মানুষ তাদের সর্বনিম্ন প্রয়োজনপূর্তি (অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থান) করতে পারে না৷ এইজন্যে প্রাউটের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতির রূপায়ণ অত্যন্ত জরুরী৷ এই নীতি অনুসারে একটি দেশের ১০০ শতাংশ মানুষের কর্মনিযুক্তি বাস্তবে সম্ভবপর৷ যেমন – কৃষিকাজে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের নিয়োজিত থাকা দরকার৷ এরপর কৃষিজ শিল্পে •agro-industries অর্থাৎ যে শিল্পের কাঁচামাল কৃষি থেকে আসে) ও কৃষি সহায়ক শিল্পে (agrico অর্থাৎ যে শিল্পের উৎপন্ন বস্তু কৃষিকাজে ব্যবহূত হয়) প্রতিটিতে ২০ শতাংশ করে মোট ৪০ শতাংশ মানুষ নিযুক্ত থাকবে৷ ১০ শতাংশ সাধারণ মানুষ ব্যবসা–বাণিজ্যে ও ১০ শতাংশ বুদ্ধিজীবী বা চাকুরীজীবী হিসেবে কাজ করবে৷ অকৃষি শিল্পে (যেমন ষ্টীল প্ল্যান্ট, গাড়ী শিল্প, যন্ত্রপাতি শিল্প, ধাতব শিল্প, তৈল শোধনাগার ইত্যাদি)–তে নিযুক্ত থাকবে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ৷ এর জন্যে কৃষিকাজ, কৃষিজ ও কৃষি–সহায়ক শিল্প থেকে কিছু শতাংশ করে কমিয়ে এই হার তৈরী করতে হবে৷ প্রাউটের মতে অন্ততঃ ৩০ শতাংশ মানুষ অকৃষি শিল্পে নিয়োজিত না থাকলে কোন দেশ শিল্পোন্নত হতে পারে না৷ অকৃষি শিল্পে একসঙ্গে অধিক সংখ্যক মানুষের কর্মনিযুক্তি হয়৷ এইভাবে কৃষি, সবরকমের শিল্প ও অন্যান্য অংশকে নিয়ে ও তাদের মধ্যে এক সুন্দর সামঞ্জস্য স্থাপন করে সমগ্র অর্থব্যবস্থাকে উৎপাদনমুখী, কর্মমুখী, ক্রয়ক্ষমতা ভিত্তিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক করার কথা শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের আগে আর কেউ বলেননি৷ বলা বা ভাবা সম্ভবও ছিল না – কেননা প্রায় সকলেই তো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লালিত–পালিত ও অনুগৃহিত৷ অথচ ইচ্ছা করলেই যে কোন সরকার এই নীতি অনুসরণ ও রূপায়ণ করতে পারে৷ বিশেষ করে কৃষিজ ও কৃষি–সহায়ক–কৃষিভ এই দুই শিল্পকে পৃথক স্থান দিয়ে ৪০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান প্রাউটের এক অভিনব পরিকল্পনা ৷ এই দুই শিল্পের (কুটির শিল্পও এর মধ্যেই পড়ে) বড় সুবিধা হচ্ছে এদের গ্রামেগঞ্জে, আধা শহরে, বড় শহরের কাছাকাছি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে গড়ে তোলা যায়৷ তাহলে মানুষ আর গ্রাম ছেড়ে শহর মুখো হবে না৷ তাই এই দুই শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর৷
কৃষিব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন করা আশু প্রয়োজন৷ প্রাউটের ভাষায় এর নাম কৃষিবিপ্লব৷ এর জন্যে একদিকে কৃষি সম্পর্কে এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সুসংবদ্ধ কৃষির •Integrated agriculture— প্রয়োগ করতে হবে, অন্যদিকে করতে হবে কৃষির আধুনিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ – যেমন ট্রাক্টর ইত্যাদির সাহায্যে নিবিড় চাষ, সহায়ক ফসল, বৎসরে তিন বা চার ফসলের চাষের ব্যবস্থা, উপযুক্ত জমির জন্যে উপযুক্ত ফসল নির্বাচন, অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহার, প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার, যথাযথ সেচব্যবস্থা চালু করা, কৃষি–সমবায় বিগ্রেড তৈরী, উৎপন্ন ফসলের যথাযথ সংরক্ষণ, বন্টন তথা বাজারজাত করা – এইসব অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করতে হবে৷ বিশেষ করে প্রয়োজন হচ্ছে কৃষিকে এক শিল্পের মর্যাদা দেওয়া৷ এর ফলে শিল্পপতির মত একজন সাধারণ চাষীও কৃষিকাজে তার সমগ্র খরচের সঙ্গে লভ্যাংশ যুক্ত করে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারিত করার সুযোগ পাবে৷ এটার অভাবে আজও ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশে দেনার দায়ে আকণ্ঠ ডুবে থাকা চাষীর আত্মহত্যার খবর শোনা যায়৷ এটা লজ্জার কথা নয় কি
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখা ও ক্রমশঃ তার বৃদ্ধির জন্যে প্রাউটের দ্বিতীয় ব্যবস্থা হচ্ছে মানুষের প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক দ্রব্যের (essential goods) সর্বাধিক উৎপাদন৷ আজ এর ঠিক উল্টোটাই হচ্ছে৷ বাজারে এখন দেদার বিকোচ্ছে নানা বিলাসদ্রব্য ও নানা কায়দায় সেসবের বিজ্ঞাপন টিভির দৌলতে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে৷ তার আকর্ষণ এত তীব্র যে অল্প সঙ্গতিসম্পন্ন মানুষও সেসবগুলি কিনেও নিচ্ছেন বা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন৷ অথচ আলু–পেঁয়াজ, ডাল–তেল, শাকসবজী, কাপড়–চোপড়, অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের দাম অনবরত বেড়েই চলেছে৷ গ্রামে শহরে পরিস্রুত পানীয় জলের পর্যন্ত ব্যবস্থা নেই৷ আর সাধারণ মানুষের শিক্ষা–চিকিৎসা–গৃহ নির্মাণের অবস্থা তো আরও করুণ সরকারের সমাধান হচ্ছে খাদ্য সুরক্ষা, একশ’ দিনের কাজ, বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে রাঁধা খাবার সরবরাহ – যেসব কেবল দুর্নীতিকেই পুষ্ট করে তুলছে কিন্তু সাধারণ মানুষের মূল সমস্যার সমাধান তাতে হচ্ছে না৷ মনে রাখতে হবে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বা নানা ভেট দিয়ে ভোট পাবার রাজনীতিতে আর যা কিছু হোক, ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে না৷
এ ব্যাপারে প্রাউটের বক্তব্য অতি স্পষ্ট৷ বিলাস দ্রব্যের উৎপাদন একেবারে কমিয়ে দিয়ে ভোগ্য দ্রব্যের উৎপাদন অনেক বাড়িয়ে দেওয়া৷ তার সঙ্গে প্রয়োজন হচ্ছে উৎপাদন ও বণ্ঢনের সর্বস্তরে সমবায়ীকরণ •co-operativisation—, ক্রেতা সমবায়, উৎপাদক সমবায়, এমনকি মার্কেটিং সমবায় ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া৷ সমবায় সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী ও উৎসাহ জাগানোর জন্যে প্রাউটের সমবায় ব্যবস্থাকে এমন সুন্দরভাবে চারটি ধাপে সাজানো হয়েছে যাতে মনস্তাত্বিক কারণে ধীরে ধীরে সকলের সমবায়ে অংশগ্রহণের জন্যে আগ্রহ বাড়তেই থাকবে৷ এইভাবে সর্বস্তরে সমবায়ের সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে তত উৎপাদন ও বণ্ঢনের মধ্যে সমতা আসতে থাকবে – যা অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত বড় সত্য৷ এসবের সামগ্রিক ফলশ্রুতি হচ্ছে অত্যাবশ্যক পণ্যের উৎপাদন ও যোগান বাড়া যাতে করে মানুষ তার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহ করে নেবে৷
ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে প্রাউটের তৃতীয় ব্যবস্থা হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করে তাদের হাতে আর্থিক স্বাধীনতা প্রদান৷ এই ভারতেই আছে ৪৪টি সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল যাদের অধিকাংশই অনুন্নত৷ স্বভাবতঃই সেইসব অঞ্চলের মানুষ বঞ্চনা ও শোষণের ক্ষোভে ফুটছে৷ অথচ তারা অসহায়৷ ধুরন্ধর রাজনৈতিক দলগুলি দলীয় স্বার্থে তাদের নিয়ে রাজ্য–বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে৷ এটা আজ প্রমাণিত যে, সর্বক্ষেত্রে পৃথক রাজ্য গঠন করলে উন্নয়ন হয় না, বরং তা হাজারটা সমস্যা ও অমঙ্গল নিয়ে আসে৷ সমান ধরণের ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত পরিবেশ, আর্থিক–সামাজিক পরিস্থিতি, সেখানকার মানুষদের মধ্যে ভাবগত ঐক্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল গঠিত হয়৷ অর্থনীতিতে মাইক্রো প্ল্যানিং বা অনুস্তরীয় পরিকল্পনা ও মাইক্রো প্ল্যানিং দুই ধরণের পরিকল্পনার কথা বলা আছে৷ যেখানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানুষের ভালোর কথা ভেবে, কল্যাণের কথা ভেবে মাইক্রো প্ল্যানিং অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা রচিত হয় সেটাই সবচেয়ে কার্যকরী প্ল্যানিং৷ প্রতিটি অঞ্চলের মানুষেরা সেখানকার সমস্যা সবচেয়ে ভালো করে বোঝে ও সমাধান তারাই ঠিক করতে পারে, প্রয়োজন পড়লে বিশেষজ্ঞেরা তাঁদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখন, অঞ্চলগুলির হাতে নিজেদের উন্নয়ন নিজেরা করবার জন্যে আর্থিক স্বাধীনতা দিয়ে দিলে ও এর জন্যে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে তাদের যথেষ্ট অর্থভাণ্ডারের ব্যবস্থা করে দিলে তারাই নিজেদের রচিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে আর্থিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে নেবে৷ সেইসব অঞ্চলে ও সমগ্র ভারতে এইভাবে উৎসাহ–উদ্দীপনা ও আর্থিক উন্নয়নের এক প্লাবন বয়ে যাবে৷ প্রতিটি সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জনের জন্যে ব্লক স্তরীয় পরিকল্পনা রচনা করবে, কেন না এই ধরণের মাইক্রো প্ল্যানিং–এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো৷ এতে অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ হবে, স্থানীয় মানুষ কাজের ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাবে ও উন্নয়ন হবে ফলপ্রসূ ও সার্থক উন্নয়ন৷
ক্রয়ক্ষমতার ব্যাপারে প্রাউটের চতুর্থ ব্যবস্থা হচ্ছে যে, সরকারী অর্থ কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কাজে না লাগিয়ে উন্নয়ন খাতে খরচ করা৷ এখানে উন্নয়নের অর্থ উন্নত ধরণের রাস্তাঘাট তৈরী, সেতু নির্মাণ, ব্যাপক সেচব্যবস্থা ও পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ ইত্যাদি কাজ অর্থাৎ পরিকাঠামো উন্নয়ন (infrastructural development )৷ এর সুফল মাইক্রো–ম্যাক্রো দুইস্তরেই পৌঁছে যায় ও সমগ্র দেশ উন্নত হয়৷ যাতায়াত সুগম হলে, পণ্য চলাচল সহজ হলে, গ্রাম ও শহরের সংযোগ বাড়ালে সকলেরই তো সুবিধা৷ আমাদের দেশে সব শহর কেন্দ্রিক উন্নয়ন – বড় বড় উঁচু উঁচু হাউসিং কমপ্লেক্স, ঝাঁ–চকচকে শপিং মল অর্থাৎ কংক্রিটের জঙ্গল, গাড়ীর ভিড়ে পথ চলার দায় অথচ অধিকাংশস্থানে রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভরা৷ আর উন্নয়নের নামে যা করা হয় তা একধরণের ছেলেখেলা, অর্থের নয়ছয় আর এক শ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের পোয়াবারো৷ অথচ সরকারের কাজ হচ্ছে প্রকৃত উন্নয়নের দিকে সবচেয়ে বেশী নজর দেওয়া, কেননা এতে সামূহিক সম্পদ তৈরী হয়, দেশ প্রগতির পথে এগিয়ে চলে৷ এসব না করে বছর বছর নিয়ম করে সরকার বেতন বৃদ্ধির দিকে বেশী নজর দেওয়ায় সরকারী বাজেটে প্রকৃত উন্নয়ন খাতে কত আর বেঁচে থাকে৷ একজন কর্মচারীর যদি মাসে তিন হাজার টাকা বেতন–বৃদ্ধিও হয়, সেই কর্মচারী বাজারে গিয়ে দেখে মুদ্রাস্ফীতির দরুণ তার সব অর্থ নিঃশেষ হয়ে গেল অথচ প্রয়োজনের সব জিনিস সে সংগ্রহ করতে পারল না, তাহলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল ভষ্মে ঘি ঢালা৷ তাহলে দেখা গেল বেতন বৃদ্ধি হলে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে না৷ তাই আগে সামূহিক সম্পদ বৃদ্ধি ও তারপর বেতন বৃদ্ধির কথা৷ তাহলে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে ও জনগণ উপকৃত হবে৷
ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে প্রাউটের পঞ্চম ব্যবস্থা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বেঁধে রাখা কোন সময়েই তাকে সেই সীমারেখার বাইরে যেতে না দেওয়া৷ বাজার অর্থনীতির অনেকগুলি কুফলের মধ্যে একটি অতিরিক্ত মুনাফা বৃদ্ধিকে প্রশ্রয় দেওয়া এখানে সামূহিক স্বার্থের দিকে তাকানোর কোন প্রশ্ণ নেই৷ মূল্যবৃদ্ধির আর একটি কারণ সরকারের ভুল নীতি৷ প্রথমতঃ সরকার নীতি রূপায়ণে দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের দলীয় ‘স্বার্থকে বেশী প্রাধান্য দেয়৷ দ্বিতীয়তঃ সব সরকারই দেশী–বিদেশী পুঁজিবাদের স্বার্থে নীতি রূপায়ণ করে, যাদের একমাত্র স্বার্থ হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে সব সুবিধা নিয়ে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করা৷ তৃতীয়তঃ ভোটের বছরে প্রতিটি সরকার নানা জনমোহিনী প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে ও ভোটের আগেই তার রূপায়ণও শুরু করে দেয়৷ ভোট পর্ব মেটার কিছু সময় পরে যখন দেখে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তখন সরকার আরও ভুলনীতি নিতে থাকে৷ এর ফলে সৃষ্টি হয় এক নীতিহীনতা তথা নীতিপঙ্গুত্ব৷ এই সবকিছুর সুযোগ নেয় বুদ্ধিমান ও সুচতুর মুনাফাবাজরা৷ তাই জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হতে থাকে৷ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা চুলোয় যাক৷ এই ব্যাপারে প্রাউটের বক্তব্য অতি স্পষ্ট৷ সমস্ত নীতি তৈরী হবে ও রূপায়িত হবে ক্রয়ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে৷ প্রাউটের পুর্বোল্লোখিত চারটি ব্যবস্থার মিলিত ফলশ্রুতি হবে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে ও ক্রয়ক্ষমতা সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত হবে৷ তদাতিরিক্ত এ ব্যাপারে যে কয়েকটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপের প্রয়োজন তা হচ্ছে – মধ্যস্বত্বভোগীদের একেবারে উৎখাত করে দেওয়া৷ এরজন্যে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে সামবায়িক কৃষিবাজার, অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের নিয়মিত বাজার তৈরী করে দেওয়া অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক কো–পারেটিভ মার্কেটিং নেটওয়ার্ক তৈরী করা৷ দ্বিতীয়তঃ সমাজে ভোগ্যপণ্যের বাজার দর বেঁধে দেওয়া ও সে সম্পর্কে নিরন্তর নজরদারী চালানো৷ পুঁজিবাদীরা ও তার স্তাবকেরা এর বিরোধিতা করবেই৷ তৃতীয়তঃ বিভিন্ন স্তরে রেট বোর্ড তৈরী করা৷ তারা সবসময় ক্রয়ক্ষমতার স্বার্থে দামকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবে৷ বিভিন্ন উৎপাদক ও ক্রেতা সমবায় নিজেদের মধ্যে অলোচনা করে এই রেট বোর্ড তৈরী করে নেবে৷ প্রয়োজন পড়লে সরকার মধ্যস্থতা করবে ও সুপরামর্শ দেবে৷ চতুর্থতঃ কোন ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত মুনাফাবৃদ্ধিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না কেননা তা জনগণের ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে৷
পরিশেষে এটাই বলি যে সকলের মিলিত প্রয়াসে তৈরী হোক এক নোতুন অর্থনীতি–ক্রয়ক্ষমতা ভিত্তিক অর্থনীতি, সূচনা হোক এক নবযুগের, রচিত হোক নোতুন দেশ, নোতুন পৃথিবী৷ লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানবতা আজ অধীর আগ্রহে পূর্ব দিগন্তে সেই নোতুন অরুণোদয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে৷
- Log in to post comments