পশু পক্ষীদের গণিতে দক্ষতা

লেখক
সমর ভৌমিক

‘‘আমি আজ কানাই মাস্টার পোড়ো মোর বিড়াল ছানাটি৷’’ আমরা অনেকেই জানি,  এই কবিতাটি কোন্ কবির রচনা৷ কবিতাটি লিখেছেন – বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কবি এখানে নিজেই কানাই মাস্টার হয়েছেন৷ কবির এখানে পড়ুয়া ছাত্র হ’ল বিড়ালছানা৷ কিন্তু সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে – পড়ুয়া হিসাবে না পড়িয়ে, পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে বিড়াল ছানাকে কানাই মাস্টার সেজে শিক্ষা দান করার কথা কবি ভাবলেন কেন? তাহলে কি সত্য সত্যই পশুপক্ষীদের বাস্তবে শিক্ষা দান করা যেতে পারে? সম্ভবতঃ পশু পক্ষীদের শিক্ষাদানের ইঙ্গিত কবির মনে উদ্ভাসিত হয়েছে৷ কিন্তু কিভাবে এই পশুপাখিদের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে? পশু পক্ষীদের কি প্রথম ভাগের অ, আ, ....... , ক, খ, ....... প্রভৃতি অক্ষর পরিচয় করানো যাবে? কোন পদ্ধতিতেই বা শিক্ষা দেওয়া এদের সম্ভব হবে? এদের মধ্যে এক এক ধরণের পশুপক্ষীরা বিশেষ বিশেষ ধ্বনি তুলে এদের অবিকশিত মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে৷ আবার কোন প্রাণী ডাকে  অ্যাম্বা, অ্যাম্বা করে, কেউবা ঘেউ ঘেউ করে, কেউবা গ্যাঙর্ – গ্যাঙর্  শব্দ করে৷ পক্ষীকুলের মধ্যে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি – কিচির–মিচির, কা–কা, কুই–কুই ইত্যাদি নানান ধরণের অভিব্যক্তি৷ অবশ্য এই অভিব্যক্তিগুর্িলর অর্থ আমরা অধিকাংশ না বুঝলেও, এরা এদের স্বগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থবহ ভাষা হিসাবে কাজ করে৷ এই ধ্বনিগুলিই হ’ল এদের মনের ভাষা৷ এহেন পশু–পক্ষীদের শিক্ষা দানের কথা ভাবলে সত্যি সত্যিই অবাক লাগে৷ একি বাস্তবে সম্ভব?

এক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে এই সমস্ত পশুপক্ষীদের একটা অর্থবহ–ভাব বিনিময় করলে তবেই শিক্ষা দান সম্ভব৷ বাস্তবে আমরা সার্কাসের মধ্যে দেখি – কুকুর, ঘোড়া, বিড়াল, টিয়া, পাখি প্রভৃতি বিভিন্ন পশুপক্ষীর শিক্ষাগত দক্ষতা৷ এই সমস্ত পশুপক্ষীরা কেউ বা সাহিত্যে দক্ষতা দেখায় আবার কেউ বা গণিতে দক্ষতা দেখিয়ে আমাদের অবাক ক’রে দেয়৷ এই সমস্ত পশুপক্ষীদের এমন সব দক্ষতার পরিচয় পাই, যা আমরা দেখে বিস্মৃত না হয়ে পারি না৷ অনেক সময় দেখা গেছে, মানুষ হয়ত যে গাণিতিক সমস্যা সমাধানে অক্ষম, সেইসব ক্ষেত্রে অতিতে পশুশিক্ষকরা এমন প্রমাণ দিয়েছেন যাতে ওই গাণিতিক সমস্যাগুলির সমাধান এই পশুপক্ষীরা অতি সহজেই দিয়েছে৷

পশুপক্ষীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা, ইংরাজী, ইতিহাস, ভূগোল ও গণিত প্রভৃতি বিষয়গুলির মধ্যে সব বিষয়ে সব প্রাণীদের দক্ষতা সমান নয়৷ প্রাণী শিক্ষকগণ এই বিষয়গুলির মধ্যে গণিত বিষয়কেই শেখানো সহজ বা উপযুক্ত বলে মনে করেন৷

আমরা যদি পশু পক্ষীদের লক্ষ্য করি, তা হলে দেখতে পাবো যে, এই সমস্ত প্রাণীদের গণিতের ধারণা মোটামুটি আছে৷ আজকের প্রবন্ধটিতে  এরূপ কিছু  প্রাণী শিক্ষকের  পশুপক্ষীদের শিক্ষাদানের বাস্তব ইতিহাস আলোচনা করব৷ প্রসঙ্গত বলি – দেখা গেছে প্রাণীদের মধ্যে কুকুর ও ঘোড়ার আই. কিউ ঢ. ত্বগ্গ সর্ব্বাধিক৷ এটা পরীক্ষিত৷ প্রমাণিত হয়েছে, এরাই ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়ার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে৷ বাস্তবে দেখা গেছে, চড়ুই পাখী যখন বাসা ত্যাগ করে বাইরে যায় সে কটি ডিম রেখে গেল তা হিসেব করে রাখে, দিনান্তে ফিরে এসে তার ওই ডিমের হিসাব ঠিক আছে কিনা তা সে অবশ্যই মিলিয়ে দেখে৷ ডিমের হিসাবের গোলমাল হলেই, চড়ুই কলহ করে৷ এটা আমরা বাস্তবে দেখি৷

এ পর্যন্ত দেখা গেছে যে, বিংশ শতাব্দীতে পশুপক্ষীদের কিভাবে সংখ্যার সহিত পরিচয় করানো যায়, তা নিয়ে সর্বপ্রথম শুরু হয় বার্লিন শহরে৷ এটা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা৷ বার্লিন শহরে উইলহেম ওস্টেন নামক এক ব্যষ্টি একটি ঘোড়াকে নিয়ে গণিত শিক্ষা দিতে শুরু করেন৷ ঘোড়াটির নাম ছিল হ্যান্স৷ কিন্তু কিভাবে তিনি ওই হ্যান্সকে গণিত শিক্ষা দিয়েছিলেন৷

সর্বপ্রথমে ডানদিক, বাঁদিক ও ওপরে নীচে কিছু সংখ্যা লিখে ওই সংখ্যাগুলির সঙ্গে হান্সের পরিচয় ঘটানোর চেষ্টা চলতে থাকেন৷ আর এটাই হ’ল সম্ভবতঃ শিক্ষার প্রথম লেস্ন্৷ উইলহেম ওস্টেন এই ‘প্রথম লেসন’ শিক্ষা হান্সকে দিয়ে ভালই ফল পেয়েছিলেন৷ এরপর তিনি দ্বিতীয় লেসনের শিক্ষার তোড়জোড় করেছিলেন৷

এই পর্যায়ে উইলহেম ওস্টেন একটি টেবিলের ওপর একটি পেরেক রাখেন ও চিৎকার করে বলেন ‘এক’, আর সঙ্গে সঙ্গে হান্সের গোড়ালীটি তুলে একবার মাটিতে জোরে আঘাত করালেন৷ এইভাবে হান্সকে ‘এক’ এর শিক্ষা দিয়েছিলেন৷ এরপর ‘দুই’–এর সাথে পরিচয় করানো হ’ল হান্সের গোড়ালীটি দুবার মাটিতে আঘাত করে৷ এমনি ভাবে ‘তিন’, চার, থেকে পর পর ‘নয়’ পর্যন্ত হান্সকে শিক্ষা দেওয়া হ’ল ও এতে উইলহেম আশ্চর্যজনক সাফল্য পেয়েছিলেন৷ এরপর টেবিল হতে পিনগুলি সরিয়ে দেওূয়া হ’ল ও শুরু হ’ল অক্ষর পরিচয় করানোর জন্যে সংখ্যাগুলিকে একটি ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে পূর্বের মত ঘোড়াটির গোড়ালী একবার মাটিতে ঠুকে চিনিয়ে দেওয়া হল ১–এর আকার কিরূপ৷ এমনি করে বোর্ডে ২, ৩, ৪ ইত্যাদি লিখে যথাক্রমে ২– বার, ৩–বার, ৪–বার গোড়ালী টোকা দিয়ে দুই, তিন, চার–এর আকার হান্সকে চিনিয়ে দেওয়া হ’ল৷ এই ভাবেই ঘোড়াটিকে অঙ্কগুলি শিখিয়ে সংখ্যা সম্পর্কে জ্ঞান সম্পূর্ণ করেছিলেন৷ উইলহেম ওস্টেন ঘোড়ার অঙ্ক শিক্ষার দক্ষতা দেখে অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন ও পরবর্তী সময়ে ওই হান্সকে যোগ, বিয়োগ বিশেষ পদ্ধতিতে শিখিয়েছিলেন৷ ঘোড়ার সুপ্ত মেধা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওস্টেন সাহেব নিজেই বিস্মিত হয়েছিলেন ও সেই সঙ্গে হান্সের এই বিচিত্র পারদর্শিতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল বেশ কিছু পশু মনস্তত্ত্ববিদের মধ্যে৷ শুনলে খুবই অবাক হতে হয় যে, এই সাফল্যের কথা শুনে পরবর্তী কালে পশুদের শিক্ষার জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল৷ এই কমিটিতে বিশেষ বিশেষ গণ্য–মান্য ব্যষ্টিরা ছিলেন৷ এই কমিটিতে ছিলেন – বার্লিন ইউনিভারসিটির সাইকোলজির প্রফেসার হেয়ার স্ট্রাম্প্ফ্, ফিজিওলজির প্রফেসার হেয়ার ন্যাগেল, জুওলজিক্যাল গার্ডেনের ডিরেক্টর, পশুচিকিৎসকরা, সার্কাসের ম্যানেজারগণ ইত্যাদি বিশিষ্ট বিশিষ্ট ব্যষ্টি বর্গ৷

এবার কিন্তু ঘোড়াকে গ্গ চিহ্ণ ও –গ্গ চিহ্ণ চিনিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ তারপর আরও উৎসাহের সঙ্গে বর্গমূল, ঘনমূল প্রভৃতি ঘোড়াকে শেখানোর চেষ্টা খুব উৎসাহের সঙ্গে চলেছিল ও এতে চরম সাফল্যও  পাওয়া গিয়েছিল৷ 

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে উইলহেম ওস্টেন–এর মৃত্যুর পর ওস্টেনের শিক্ষায় শিক্ষিত ঘোড়া হ্যান্সকে কার্লক্রম নামক এক ব্যষ্টি সংগ্রহ করেন৷ তারপর কার্লক্রম হ্যান্সকে ১ হতে ৯ ও পরে শূন্যের সাহায্যে দশক, শতক সংখ্যা অত্যাশ্চর্য শিক্ষায় শিক্ষিত ক’রে ছোট, বড় যোগ–বিয়োগ শিখিয়ে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন৷

পরবর্তীকালে, পশু জগতের শিক্ষার কথা পশু মনস্তত্ত্ববিদ্দের  ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় – শুধু ঘোড়া নয়, অন্যান্য পশু যেমন, কুকুর, বিড়াল ও বিভিন্ন পক্ষীরাও গণিত শেখার মত দক্ষতা রাখে৷ পশুপক্ষীরা গণিতে যে দক্ষতার পরিচয় দেয় তা সাধারণের কাছে অবাক, বিস্ময় ও রূপকথার কাহিনী ছাড়া কিছুই নয়৷ কিন্তু এসব কাহিনী বিজ্ঞানের মত পরীক্ষিত সত্য ঘটনা৷

এহেন পরিস্থিতিতে আমরা যদি ওই কানাই মাস্টারের মত পশুদিগের জন্যে বিশেষ গণিত শিক্ষার ব্যবস্থা করে পশুদের সুপ্ত সত্ত্বা –কে জাগিয়ে মানব সমাজের জন্যে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করতে পারি তবে – তা কি ‘বাবার’ দেওয়া নব্যমানবতাবাদকে পালন করা হবে?