আজকাল কিছু কিছু দ্ধিজীবী জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রগতি সম্পর্কে আলোচনায় মুখর৷ প্রথমতঃ, প্রগতি জিনিসটা সরলরেখায় চলে না৷ প্রগতি ব্যাপারটা হ’ল সংকোচ বিকাশী ও ছন্দায়িত৷ দ্বিতীয়তঃ, মনে রাখতে হবে যে প্রগতির গতি স্থানবিশেষে ও ক্ষেত্র অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়৷ কোন্ ক্ষেত্রে প্রগতি ঘটছে, তদনুযায়ী প্রগতির গতি পরিবর্তিত হয়৷
মানব অস্তিত্বের মূখ্যতঃ তিনটি দিক--- ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ তিনটি ক্ষেত্রেই মানুষের প্রগতির পরিমাপ সমান নয়৷ প্রগতির ধারাটা হচ্ছে ছন্দায়িত ও গতি-স্থিরতাধর্মী৷ ভৌতিক ক্ষেত্রে যদি প্রগতির পরিমাপ বেশী হ’ল তো মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে কম৷ আবার মানসিক ক্ষেত্রে প্রগতি বেশী হ’ল তো ভৌতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে প্রগতি কমে গেল৷ তেমনি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে প্রগতির মাত্রা বেশী তো ভৌতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে প্রগতি কম৷
‘‘সর্বে চ পশবঃ সন্তি’’৷ সৃষ্টির প্রথম পর্বে সব প্রাণীই ছিল পশুতুল্য৷ সেই জড়সর্বস্বতার যুগে মানুষের জড়ভোগলিপ্সা ছিল অত্যন্ত প্রকট৷ প্রগতির গতি ও ছন্দ ভৌতিক জগতের বস্তুসমূহের সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলে৷ এই স্তরটাকে বলা হয় পশ্বাচার৷ এই স্তরে এসে মানুষ মোটামুটি স্থির করতে পারে কীভাবে সে এগোবে, কোথায় যাবে, জীবনের অন্তিম পশুতুল্য হওয়ায় অধ্যাত্মবাদীরা তাদের ‘পশু’ আখ্যা দিয়ে থাকেন৷ এদের উদ্দিষ্ট দেবতা শিবকে তাই এইস্তরের সাধকেরা ‘পশুপতি’ নামে সম্বোধন করেন৷
উন্নতির দ্বিতীয় স্তরে এসে প্রগতি মানসিক স্তরে বেশী হয়ে থাকে৷ মনে সুখ-দুঃখের ােধটা বেশ প্রকট হয়৷ তন্ত্রে এই স্তরটাকে বলা হয় বীরাচার বা বীরভাব৷ ভৌতিক স্তরের তুলনায় মানসিক স্তরে সংঘর্ষ প্রকটতর ও জটিলতর হয়৷ এই জন্যে এই স্তরে অধিকতর মানস শক্তি, অধিকতর শক্তিশালী স্নায়ুকোষ ও স্নায়ুতন্তুর দরকার পড়ে৷ যে সব সাধক মানসিক স্তরে সংগ্রাম চালিয়ে যায় তাদের বীর আখ্যা দেওয়া হয়৷ তারা সাধারণ মানুষ নয়--- তারা বীর৷ এই স্তরটাকে বলা হয় বীরাচার৷ তারাই নেতৃস্থানীয় , সকল কাজে অগ্রপথিক৷ তাদের উপাস্য দেবতা হচ্ছেন বীরেশ্বর৷ সুতরাং এই দ্বিতীয়স্তরের সাধকেরা পরমপুরুষকে ‘বীরেশ্বর’ নামে সম্বোধন করেন৷ সাধক বলেন--- হে পরমপুরুষ, তোমার কৃপায় আমি বীর পর্যায় উন্নীত হয়েছি৷ তুমি আমার উপাস্য দেবতা৷ --- তাই তুমি হ’লে বীরেশ্বর৷ শিবের অপর নাম বীরেশ্বর৷
শেষ স্তরে অর্থাৎ আধ্যাত্মিক স্তরে দ্রুতির ছন্দটা গিয়ে পড়ে আধ্যাত্মিকতার ওপর৷ আধ্যাত্মিক স্তরে মানুষের দুঃখের একটিই কারণ --- ‘‘পরমপুরুষ আমার প্রাণের প্রাণ, আত্মার আত্মীয়৷ তিনি আমার পরমপিতা, তবুও তাঁর ও আমার মধ্যে কত ব্যবধান’’৷ সাধকের পক্ষে এই ব্যবধান সত্যিই বেদনাবহ ও অসহনীয়৷ তন্ত্রের এই স্তরটার নাম দিব্যাচার বা দিব্যভাব৷ এই স্তরে পরমপুরুষের নাম মহাদেব বা দেবাদিদেব৷ এই স্তরের সাধককে বলা হয় দেব কারণ সে সমস্ত জগৎকে, বিশ্বকে ভাবস্পন্দনে স্পন্দিত, ঝঙ্কৃত করে দিতে পারে৷ এইস্তরের সাধক পরমপুরুষকে ‘মহাদেব’ আখ্যায় সম্বোধিত করেন৷ শিবের অপর নাম মহাদেব৷
সাধনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে একই উপাস্য দেবতা শিব ভিন্ন ভিন্ন নামে সম্বোধিত হন৷ ভৌতিক স্তরে সীমাবদ্ধ সাধক উপাস্য দেবতাকে সম্বোধন করছে ‘পশুপতি’ নামে, মানসিক স্তরে উন্নীত সাধক সম্বোধন করছেন বীরেশ্বর নামে ও আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত সাধক সম্বোধন করছেন ‘মহাদেব’ নামে৷
দেব মানেvibrational force,স্পন্দনাত্মক শক্তি আর সমস্ত স্পন্দনশক্তি যাঁতে সমাহিত বা বিধৃত তিনি হলেন মহাদেব৷ এই মহাদেব অন্যান্য ছোট-বড়-মাঝারি দেবতাকুলকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সমস্ত স্পন্দনাত্মক শক্তি তাঁর পূর্ণ শাসনাধীন৷
এখন যদিও তিনি বিশ্বের যাবতীয় স্পন্দনের আদি সৃষ্টিকর্র্ত্ত ও নিয়ন্ত্রণকর্র্ত্ত, তবুও তিনি কোনো ভৌতিক ও মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ নন৷ সুতারাং কোনো অবস্থাতেই তঁাঁর উদ্দেশ্যে শেষ কথা কিছুতেই বলা যাবে না৷ তাই শেষ পর্যন্ত এইটুকুই বলা যায়---
‘‘তব তত্ত্বং ন জানামি কীদৃশোহসি মহেশ্বর৷
যাদৃশোহসি মহাদেব তাদৃশায় নমো নমঃ৷৷’’
হে পরম তত্ত্ব, হে মহাদেব , হে সকল দেবতা ও দিব্যাচারী সাধকের চরম নিয়ন্তা, তুমি কে বা কী আমি জানি না৷ সুতরাং তোমার উদ্দেশ্যে কোনো গুণাত্মক অভিব্যক্তি বা সকাম প্রার্থনা সম্ভব নয়৷ তবে এটুকু বিশ্বাস করি ও মানি যে তুমি একটা কিছু তো নিশ্চয়৷ তোমার ব্যষ্টিত্ব কী রকমের তা জানি না কিন্তু এটুকু নিশ্চয় জানি যে তুমি একটা বিরাট ব্যষ্টিত্ব৷ যদিও তোমাকে পুরোপুরি জানি না, যদিও তুমি আমার ােধ-দ্ধির বাইরে , তবু তোমাকেই আমার ভক্তিবিনম্র প্রণাম’’৷ আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রগতিলাভ কালে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমাদের যাবতীয় বৃত্তি ও মানস স্পন্দনকে ভূমা চৈতন্যের দিকে চালিয়ে দিতে হবে৷ এই ভূমাচৈতন্য হলেন যাবতীয় স্থানকালের ঊধের্ব৷
২৬ নবেম্বর ১৯৭৮, সকালবেলা, মুম্বাই (ইংরেজী থেকে অনূদিত)