পথ চলতে গণিত কথা

লেখক
শ্রী সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

গণিত, গণিত আর গণিত৷ জন্ম হ’তেই মানুষ গণিতের  সঙ্গে জড়িত হ’য়ে পড়ে৷  জন্মের ক্ষণটুকুও লিখিত হয় গণিতের সহায়তায়৷  নবজাত শিশুর জন্মলগ্ণটা ও অঙ্কের দ্বারাই নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ শিশু কটা, কয় মিনিটে পৃথিবীতে এল তা অঙ্কের মাধ্যমেই লিখিত হয়৷ এমন কি পৃথিবী ছেড়ে যখন অনন্ত লোকে  গমন করে তখনও চাই অঙ্ক অর্থাৎ গণিতকে৷ জন্ম থেকে জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত গণিত আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে মানুষের সমাজকে৷ বিজ্ঞানের সমস্ত শাখাকে পরিপূর্ণতায় পল্লবিত করতে পারে এই গণিত শাস্ত্র৷ গণিতের সহায়তা ছাড়া অন্যান্য বিজ্ঞান শাস্ত্রগুলি অন্ধ৷ গনিতই পারে এই অন্ধতা দূর করতে৷ এমনকি কলা শাস্ত্রও গণিতের উপর নির্ভরশীল৷ অর্থশাস্ত্র ও সংগীত শাস্ত্রও গণিত ছাড়া পূর্ণতা লাভ করতে পারে না৷ সঙ্গীতের সুরসপ্তক, সাতটি সুরে বাঁধা৷ গণিত একটি বহুধা ব্যাপক ক্রমবর্ধমান শাস্ত্র৷ তাই এই গণিত নিয়ে Bacon’ বলেছেন---‘Mathematics is the gateway and  key to all sciencess’’ অর্থাৎ গণিত হ’ল সমস্ত বিজ্ঞানের প্রবেশ দ্বার ও চাবিকাঠি৷ গণিত যেহেতু সকল শাস্ত্রের মধ্যেই অনুপ্রবিষ্ট হ’য়ে রয়েছে, সেহেতু গণিত হ’ল Queen of all subjects’

কিন্তু অতীতের কোন শুভক্ষণ থেকে মানুষ এই গণিতচর্চায় মেতে উঠেছিল? আদিম যুগের মানুষ যখন অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে বেড়াত তখন প্রয়োজনের তাগিদে নিজ নিজ এলাকা দাগ কেটে বলেছিল---এটা আমার এলাকা৷ অর্থাৎ সেদিন হ’তে পরিমিতি শিখতে শুরু করেছে৷ কিন্তু গুন্‌তে তখনও জানে নি৷ আর জানবেই বা কি ক’রে? কারণ তখনও সংখ্যা কি, তা আবিষ্কার হয়নি৷ তারপর অনেক, অনেক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সংখ্যার আবিষ্কার হয়৷ আনুমানিক আজ হ’তে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে পুরুলিয়ার পাট ঝালদা নামে এক গ্রামে মস্তবড় গণিতবিদ্‌ জন্মগ্রহণ করেন ও ইনিই সর্বপ্রথম মানুষকে সংখ্যা তত্ত্ব উপহার দিয়েছিলেন৷ এই মস্ত গণিতবিদ্‌ হ’লেন---মহর্ষি কপিল৷ ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি যে দুই-সমকোন ও  সমত্রিকোনী-ত্রিভুজের প্রতিটি কোনের মান ৬০ ডিগ্রী হয়---এই আবিষ্কার কপিল মুনিরই আবিষ্কার৷ এমনই সব বহু জ্যামিতিক তত্ত্বের আবিষ্কার করে’ গণিত শাস্ত্রের প্রথম সোপান তিনিই তৈরী করেন৷ আজও এই আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি৷ বলা বাহুল্য, এই সমস্ত আবিষ্কার তিনি পাথরের গুহায় বসে করেছিলেন৷ আর ঐ একই গুহাতেই কপিলমুনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন৷

যে গুহায় বসে তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন এবং সাথে সাথে জ্যামিতি গবেষনা করতেন, তাঁর নাম অনুসারেই সেই গুহার নাম হয়--- কপিল গুহা৷ আজও এই গুহায় গনিতের বহু অমূল্য তথ্য পাহাড়ের গাত্রে খোদিত আছে৷

১৯৯১ সালের ২৯শে সেপ্ঢেম্বর মাসে রাঢ় একাডেমি সংস্থা অভিযান চালিয়ে শিকরা পাহাড়ের শিখর চূড়ায় একটি ২৫ ফুট দীর্ঘ গুহার মাঝখানে একটি কষ্টি পাথরের গায়ে কপিলের বিভিন্ন জ্যামিতিক নক্সার সন্ধান পেয়েছেন৷ এই যুগান্তকারী আবিষ্কার থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই রাঢ়ের মানুষেরা প্রাচীনকালেও জ্যামিতি চর্চা করত৷

মহান দার্শনিক ও ঐতিহাসিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের নির্দেশে এই অমূল্য তথ্য আবিষৃকত হয়৷ পরে তিনিই এই পাথরের বুকে অঙ্কিত অস্পষ্ট নক্‌শা পর্যবেক্ষন ক’রে জগৎবাসীকে জানিয়ে দিলেন ও বললেন প্রাচীন রাঢ়ে মানুষ জ্যামিতির চর্চা বিশ্বের বুকে প্রথম শুরু করেছিল৷ মহর্ষি কপিলের পূর্বেও মানুষ জ্যামিতির চর্চা করত তবে তখন এর কোন ফরমূলা বা বিধিবদ্ধ নিয়ম ছিল না৷ যেমন সদাশিবের জন্মের পূর্বেও মানুষ গান গাইত কিন্তু তাদের এই গান বা সঙ্গীত ব্যাকরণ সম্মত ছিল না৷ সদাশিবই প্রথম সুর সপ্তকের মাধ্যমে সংগীতকে ব্যাকরণ সম্মত করেন৷ ঠিক তেমনিই  মহর্ষি কপিল মুনির পূর্বে রাঢ়ের মানুষ জ্যামিতি নিয়ে চর্চা করত কিন্তু কপিল মুনি জ্যামিতি শাস্ত্রকে একটি ফরমূলায় বেঁধে দিয়েছিলেন৷

বর্তমানে যে পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানো হয়, তা প্রকৃতপক্ষে পিথাগোরাসের মৌলিক আবিষ্কার নয়৷ এটিও কপিলের নকল, অর্থাৎ কোন সমকোনী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে---লম্ব ভূমি অতিভূজ হয়, এটি মহর্ষি কপিলেরই আবিষ্কার যা আজও কপিল গুহায় পাথরগাত্রে খোদিত আছে৷ আনুমানিক ৫৮৫ খ্রীঃ পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে পিথাগোরাস সামোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন৷ জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি মিলেটাস, ব্যবিলন, মিশর, এমনকি ভারতেও আসেন৷ তাঁর ভারত ভ্রমণ সম্পর্কে পণ্ডিতরা সকলে একমত না হলেও অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ স্বীকার করেন, আর স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় উল্লেখ আছে---‘Pythagoras came to India and studied this philosophy (Sankha Darshan), and that was the begining of the philosophy of the Greeks’’ শুধু জ্যামিতি নয়, মহর্ষি কপিল বীজগনিতের ও বহু গবেষনা করেছেন৷(a+b)2 -এর ফরমূলাটিও কপিল মুনির মৌলিক অবদান৷ এই সমস্ত মৌলিক আবিষ্কারের বহু প্রমাণ আজও স্বাক্ষরিত হ’য়ে রয়েছে কপিলের ‘‘জ্যামিতিক চর্চা গুহায়৷’’

তাই কপিল সম্পর্কে, আমাদের কবি--- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত গর্বের সঙ্গে গেয়েছেন---

জ্ঞানের নিধান আদি বিদ্বান

কপিল সাংখ্যকার৷

এই বাঙ্‌লায় রচিল হায়

সূত্রেহীরক হার৷

কপিল মুনির এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য মানব জগতে আদি বিদ্বান সংখ্যার হিসাবে তিনি চির সম্মানিত ও চিরনমস্য হয়ে থাকবেন৷