ফোঁড়া কেন হয় ঃ
শরীরের সর্বাঙ্গে অথবা স্থান বিশেষে রক্তদুষ্টি ঘটলে, কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্যের অভাব ঘটলে অথবা আঁবের সময় হঠাৎ অধিক পরিমাণে আঁব (আম) অর্থাৎ ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের কোন কোন অংশ স্ফীত হয়ে ওঠে রক্ত একত্রিত হয়ে সেই স্ফীত অংশ থেকে বহির্গত হতে চায়৷ একে বাংলায় বলি স্ফোটক, কথ্য বাংলায় ফোঁড়া৷ গ্রীষ্মকালে তোমরা যদি কখনো বেশী আঁব খাও, আমি অনুমান করে নিতে পারি সেই সময়ে তোমাদের ফোঁড়াও হয়ে থাকে৷ লোম ফোঁড়াকেও অনেকে বলেন বিষফোঁড়া৷ এই ফোঁড়া যখন হয় স্থানটি অনেক সময় ব্যথায় টনটন করে৷ তবু মানুষের হাত ঘুরে ফিরে সেই স্থানেই চলে আসে৷ এর অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে জায়গাটি ফুলে থাকে৷ রক্তদুষ্টি, চর্মজাতীয় রোগ অথবা ক্যালসিয়ামের অভাব বা অন্য কিছু–এদের মধ্যে যে কারণের জন্যে ফোঁড়া হয়েছে তা ক্ষুঝে নিয়ে সেই অনুসারে চিকিৎসা করলেই রোগটি সেরে যায়৷
কৃষ্ণবীজ (তোকমারী) ঃ
কৃষ্ণবীজ বলতে বোঝায় তোকমারীকে৷ শরীরে ফোঁড়া হলে তা সহজে ফাটতে না চাইলে (কিছু পরিমাণ) তোকমারীকে একটা কাপড়ের গায়ে জলে ভিজিয়ে লাগিয়ে দিয়ে ফোঁড়ার ওপর প্রলেপ হিসাবে সেঁটে দিতে হয়৷ ওই প্রলেপ চামড়াকে টেনে আড়ষ্ট করে দেয় ও পরে ফোঁড়াকে ফাটিয়ে দেয়৷ তোকমারীর মধ্যে একটা আঠা আঠা ভাব আছে৷ সেই আঠা ভাবটিতেই এর ঔষধীয় গুণ নিহিত রয়েছে৷ কতকটা এই তোকমারীর পুলটিশের মতো মস্নের পুলটিশও (তিসির পুলটিশ) এ ব্যাপারে ব্যবহার করা যায়৷
বয়ঃব্রণ ও তার ঔষধ
মানুষের সাধারণতঃ ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সে শরীরে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন গ্রন্থিরসের ক্ষরণ (Secretion of hormone) হতে থাকে৷ এর ফলে রক্তের উষ্ণতায়, গতিতে, সংরচনায় পরিবর্তন ঘটে৷ তাতে করে মুখমণ্ডলে, বিশেষ করে কপাল ও গালে ছোট ছোট ফুসুক্ড়ি দেখা যায়৷ বাংলায় একে ব্রণ বলা হয়৷ এটা বিশেষ একটা বয়সে হয় তার পূর্বেও হয় না, পরেও হয় না৷ তাই একে বয়ঃব্রণ বলা হয়৷ সংস্কৃত ভাষায় ব্রণ বলতে বয়ঃব্রণকে তো বোঝায়–ই, অধিকন্তু যে কোন ক্লেশদায়ক ফোঁড়া বা ফুসুক্ড়ির জন্যেও ব্রণ শব্দ চলতে পারে৷ ব্রণরোগ মানে ঘা–এর রোগ৷
‘যথা অতি রমনীয় চারু কলেবরে
ব্রণ অন্বেষণ করে মক্ষিকানিকরে৷’
কখনো কখনো দেখা যায় যে, নানান ওষুধ ব্যবহার করেও ব্রণ সারতে চায় না, কখনো বা বিষিয়ে গিয়ে মুখ ফুলে যায়৷ তাই ব্রণের একটা ওষুধের কথা বলে দিচ্ছি৷ শিমুল কাঁটা, শিমুল কাঁটা না পেলে খাড়ি মুসুরী বা গোটা মুসুরী, দইয়ের সরের সঙ্গে শিলে ঘষে ব্রণের ওপর প্রলেপ দিলে খুব সহজে ব্রণ সেরে যায়৷ শিলেতে দুধের সঙ্গে গোলমরিচ ঘষে সেই ঘষা জিনিস মুখে লাগালে তাও বয়ঃব্রণের অন্যতম ঔষধ৷
থুজা–ঝাউ ও আঁচিল–গজমোতি
ঝাউ জাতীয় যে গাছকে ইংরেজীতে থুজা (Thuja) বলা হয়, তাকে সংস্কৃতে বলা হয় ‘অর্বুদঘ্ণী’৷ অর্থাৎ এই থুজা নামের ঝাউজাতীয় গাছ অর্বুদনাশক অর্থাৎ এর রস অর্বুদ বা আব বা টিউমার রোগের ঔষধ আভ্যন্তরীণ প্রয়োগক্৷ অন্যান্য জীবের তুলনায় হাতীর মাথায় অর্বুদ (Tumour) হয় বেশী৷ এই অর্বুদ কিছুটা বৃহদাকার হয়ে গেলে হাতী উন্মাদ হয়ে যায় ও তার মৃত্যু হয়৷ এই অর্বুদ সময় সময় এত কঠোর হয়ে যায় যে তাকে সহজে ভাঙ্গা বা কাটা যায় না৷ এই জিনিসটাকেই লোকে গজমোতি বলে থাকে (এর সঙ্গে মুক্তা–মাণিক্যের সত্যিকারের কোন সম্পর্ক নেই)৷ এই অর্বুদ রোগের জন্যে হস্তি–মস্তিষ্ক্ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সেই সময় রোদে ঘোরাঘুরি করলে হাতীর রগ •temple) ফেটে যায়, রস বেরিয়ে আসে৷ হাতীকে বৎসরের যে কোন একটি অমাবস্যার রাত্রিতে, বিশেষ করে ফাল্গুনী, চৈতী বা বৈশাখী অমাবস্যায় কিছু পরিমাণে থুজা বর্গীয় ঝাউয়ের পাতা খাওয়ালে এই মস্তিষ্ক্ রোগ থেকে হাতী রক্ষা পায়৷
‘অর্বুদ’ থেকে বাংলায় ‘আব’ শব্দটি এসেছে৷ আব, আঁচিল এই দুটি রোগে থুজা ঔষধ৷ [ থুজা জাতীয় ঝাউ গাছ থেকে তৈরী হোমিওপ্যাথি ‘থুজা’ ঔষধ এ ব্যাপারে বেশ কার্যকরী ]৷
ক্যাসুয়ারিণা বর্গীয় ঝাউ, ছুঁচের মত সরু–পাতা দেশী ঝাউ, থুজা ঝাউ–এর বর্গের মধ্যে পড়ে না৷ ঝাউবর্গীয় গাছ পৃথিবীতে এসেছে অনেক কাল পূর্বে–জীব পৃথিবীতে আসবার অনেক আগে৷ ফার্ন জাতীয় গাছেরা হ’ল ঝাউয়ের পূর্বপুরুষ৷ বর্ত্তমান বিশ্বে প্রায় ১২৫ প্রজাতির ঝাউয়ের গাছ আছে৷ সমুদ্র তীরে স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতি ভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে (বিভিন্ন) প্রকার উদ্ভিদ (তেকাটা মনসা, বালুকাপাটি বা বালুচাপাটি নামে এক প্রকারে লতানে গাছ যা বালুর ওপর দিয়ে বেয়ে চলে ও তাদের শেকড় ও ডাল–পালার বজ্রবন্ধনে বালিকে বেঁধে ফেলে যাতে ওই বালি সহজে উড়ে সমুদ্রে গিয়ে না পড়ে) ও আপনা থেকে সমুদ্র তীরে জেগে ওঠা সামুদ্রিক ঝাউ–এর অরণ্যের মাধ্যমে৷ সাধারণতঃ গাঙচিলের বিষ্ঠার দ্বারা ওই ঝাউয়ের বীজ সমুদ্রতীরে ছড়িয়ে পড়ে৷ তীরের ভাঙ্গন রোধ করতে গেলে এই ঝাউ লাগানো দরকার৷ জাপানে এক ধরনের কাঁটাযুক্ত ঝাউ* আছে যা তীরের ভাঙ্গন রোধে দারুণ সাহায্য করে৷ ভবিষ্যতে বিধ্বংসী বন্যার হাত থেকে ঙ্মথবা প্রবল জলোচ্ছাসের হাত থেকেক্ষ সমুদ্রোপকূলকে বাঁচাবার জন্যে তোমরা এই সব উদ্ভিদ, সামুদ্রিক ঝাউ ও জাপানী ঝাউ (বিজয় কেতন) অধিক সংখ্যায় লাগাবার ব্যবস্থা করো৷ এতে সমুদ্রতীর সামুদ্রিক ঝড়ের তাণ্ডব থেকে কিছুটা রেহাই পাবে৷
– শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে