রসায়নাগার-জাতক ও মাইক্রোবাইটাম সম্পর্কে প্রাউট প্রসঙ্গে  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অভিমত

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

 ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে রাঁচীতে মহাপ্রাজ্ঞ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রাউট প্রসঙ্গে  যে প্রবচন দিয়েছিলেন, সেই প্রবচনে তিনি বহু সমস্যার সমাধান এর কথা, বলে গিয়েছেন৷ যেমন--- শ্রমিক সমস্যার  কথা, ভূমি সংস্কারের কথা পণপথার সমাধান, বিশ্বরাষ্ট্র গড়ার পথ, লিপি ও সংসৃকতি কেমন হবে, পরিবার পরিকল্পনা, জন্ম-নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ব্যবস্থা, রসায়নাগার জাতক প্রভৃতি সম্পর্কে বহুবিধ সমস্যার সমাধান  এই প্রাউটের প্রবচনে বলেছেন৷

আজকের আলোচ্য বিষয় হ’ল---রসায়নাগারে-জাতক বা রসায়নাগার -শিশুদের নিয়ে শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের অভিমত৷

তিনি তাঁর প্রবচনে অভিমত প্রকাশ ক’রে বলেছেন---‘‘এমন একদিন অবশ্যই আসবে যখন মানুষ রসায়নাগারে (ল্যাবরেটরীতে) টেষ্টটিউব বেবী সৃষ্টি করবে৷ এইভাবে মানুষ সৃষ্টি যখন ব্যাপকভাবে সাফল্যলাভ করবে তখন প্রকৃতি যেভাবে আদিম মানুষ অষ্ট্রালোপিমেসিন থেকে শুরু করে মানব শরীরের বিভিন্ন বিবর্ত্তন ঘটিয়েছে  ঠিক তেমনি ভাবেই প্রজনন ক্ষমতাও লুপ্ত করে দেবে৷ যখন মানুষের প্রজনন ক্ষমতা থাকবে না ও যখন মানব শিশু রসায়নগারেই জন্মগ্রহন করবে--- মানব সভ্যতার আগামী সেই যুগের আলোচনা খুবই  কৌতুহলোদ্দীপক হবে৷’’

সৃষ্টি করার প্রবনতা হ’ল মানুষের একটি স্বাভাবিক গুন৷ এই প্রবণতার  প্রেরণাতেই মানুষ থাকে৷ সৃষ্টির এই এষণাতেই মানুষ খোঁজে তার অন্তরের অন্তরতম চৈতন্যসত্তাকে৷ যখন এই চৈতন্যসত্তাকে অন্তরে অনুভব করে তখন একেই বলে প্রেম৷ অন্যথায় সৃষ্টির এই প্রবণতাকে সাধারণতঃ ‘কাম’ Sexual impulse) বলা হয়৷

শ্রী পি.আর.সরকারের মতে যখন রসায়নাগারেই মানবশিশু জন্মগ্রহণ করবে এবং মানুষের প্রজনন ক্ষমতা প্রকৃতি কেড়ে নেবে তখন মানুষ তার এই উদ্বৃত্ত সৃষ্টির প্রবণতাকে শুভ পথে চালিত করতে পারবে৷ সৃষ্টির এই প্রবণতাকে শুভপথে পরিচালনা করার ফলে মানুষ বিভিন্ন দিকে নোতুন নোতুন আবিষ্কার করতে থাকবে ও জীবনের মহত্তম লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে৷ এই সৃষ্টি  প্রবণতার এত ব্যাপক উপযোগিতার ধারণা এর আগে কখনও  করা হয়নি৷ এমন কি  ভগবান সদাশিব কিংবা শ্রী কৃষ্ণের সময়েও এত  কাল কেউই করেন নি৷ হয়ত বা তখন এই ধরনের চিন্তার প্রয়োজন হয়নি৷ মানুষের এই সৃষ্টি সামর্থ্যের সুবিশাল ব্যাপকতার উদ্ভাসনের  কথা এই প্রথম শ্রী পি.আর সরকারই প্রাউট প্রসঙ্গে ব্যক্ত করেছেন৷ এখানেই প্রাউট দর্শনের নোতুনত্ব৷ তাই বলা যায়,দর্শনের জগতে প্রাউট দর্শন হ’ল এক নববিধান৷ মানব সমাজের সুষম সর্বাত্মক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাউট হ’ল সর্বরোগের একমাত্র মকরধবজ৷

এখন প্রশ্ন হ’ল কিভাবে রসায়নাগারে নব জাতকের জন্ম হবে? এর উত্তরে শ্রী সরকার বলেছেন---

‘‘গবেষনাগারে মানুষ তৈরী হবে দু’ধরনের৷

(১) যান্ত্রিক শিশু ও (২) জৈবিক শিশু৷ যান্ত্রিক মানব শিশুগুলি বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত পুতুল সদৃশ হবে৷ শরীর অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন উপকেন্দ্র থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশ পরিচালিত হবে৷ এদের কোন স্নায়ুকোষ বা স্নায়ুতন্তু থাকবে না৷ তারা তাদের প্রভুর নির্দেশানুসারে বাধ্য ভৃত্যের মত নিঃশব্দে মানবসেবা ক’রে যাবে. যান্ত্রিক মানবের তুলনায় জৈব-মানব হবে অনেক ত্রুটিমুক্ত৷ শুক্রানু ও ডিম্বানু--- উভয়েই রাসায়নিক যৌগ হওয়ায় রসায়নাগারেই এদের প্রস্তুত করা সম্ভব হবে৷ শুক্রানু ও ডিম্বানুর নিষিক্তিকরণের ফলে যে ভ্রুণের সৃষ্টি হয় তাও বিশেষ প্রক্রিয়ায় সম্ভব হবে৷ এই প্রক্রিয়ার ফলে যে শিশু জন্মাবে তাকেই বলা হবে রসায়নাগার-জাতক৷ এই পদ্ধতিতে নিখঁতভাবে সমগ্র অবয়ব, এমনকি মস্তিষ্কও সৃষ্টি করা সম্ভব হবে৷’’ কিন্তু মানব মন তৈরী করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাই এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন---‘‘মানব তৈরী করা মানুষের কাজ নয়৷ এটা মানুষের সাধ্যের অতীত৷ মানব ইতিহাসের স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় যেমন হয়ে এসেছে, ঠিক তেমনি রসায়নাগার-জাত ভ্রুনের সঙ্গে প্রকৃতি এক বিদেহী মনকে সংযুক্ত করে’ দেবে৷’’

কিন্তু বিদেহী মনই হ’ল একপ্রকার  মাইক্রোবাইটাম৷ যেমন--- দেবযোনী ও প্রেতযোনী এরা হ’ল এক এক ধরণের  মাইক্রোবাইটাম৷ মানুষের কর্মানুযায়ী এই মাইক্রোবাইটামের প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের হয়৷ এখন এই বিদেহীমন অর্থাৎ মাইক্রোবাইটাম যখন কোন ভ্রুনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তখন ঐ ভ্রুনটিকে ক্রিয়াশীল করে ও নূতন জীবন বা দেহ তৈরী করে থাকে৷ এইভাবে বিদেহী মন দেহ থেকে দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে ও আগের জীবনের ধারণাগুলিকে বা সংস্কারগুলিকে পরবর্তী জীবনে সঞ্চারিত করে৷ যেহেতু বিদেহী মন থাকছে, অতএব এই রসায়নাগার -জাতকরা সংস্কার মুক্ত হবে না৷ পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগের ব্যাখ্যা এখানেই নিহিত রয়েছে৷

এখন, এই সমস্ত রসায়নাগারে শিশুরা বর্তমানের স্বাভাবিক মানুষের চাইতে দীর্ঘজীবী হবে ও উন্নত ধরণের মস্তিষ্কের (ব্রেণ-এর) অধিকারী হবে৷

মহান দার্শনিক প্রভাতরঞ্জন সরকার তাই বলেছেন---‘‘ভবিষ্যতে এমনকি  এও সম্ভব হবে যে রসায়গার-জাতকরা তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ খুলে রেখে শুধু মস্তিষ্ক নিয়ে  যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারবে৷ রসায়নাগার জাতকের বিভিন্ন অঙ্গ পরিবর্তন করাও সম্ভব হবে, কিন্তু মস্তিষ্ক পরিবর্তন করা যাবে না৷ কারণ মস্তিষ্কই সংস্কারের আধার, তাই মস্তিষ্ক পরিবর্তনের অর্থই হ’ল ব্যষ্টিত্বের পরিবর্তন৷ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের সমাহার, আর সার্বিকভাবে সেটাই তার ব্যষ্টিত্ব৷ স্নায়ুকোষের মধ্যে পরিবর্তন না এনে অর্থাৎ ব্যষ্টিত্বের পরিবর্তন না করে’ মস্তিষ্কের পরিবর্তন করা সম্ভব নয়া’’৷

রসায়নাগার-জাতকদের প্রকৃতি কিরূপ হবে তাও শ্রী সরকার ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ যেমন---(১) রসায়নাগার জাতক ব্যবস্থার যখন অগ্রগতি হবে তখন প্রকৃতি মানুষের প্রজনন ক্ষমতা কেড়ে নেবে,তখন মানুষ আজকের মত স্বাভাবিকভাবে মানুষ সৃষ্টি করতে পারবে না৷ তখন তারা কেবল রসায়নাগারেই জাতক সৃষ্টি করবে৷

(২) এই সমস্ত রসায়নাগার শিশুদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকবে বটে, কিন্তু যারা এদের লালন-পালন করবে তাদের প্রতি খুব বেশী টান থাকবে না৷

(৩) বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এরা একটা ট্যাবলেট খেয়েই বেশ কিছু দিন সুস্থই থাকবে৷ সুতরাং এদের কায়িক পরিশ্রম করতে হবে না৷

(৪) যেহেতু রসায়নাগারে রাসায়নিক যৌগ হ’তে এই সমস্ত শিশুরা সৃষ্টি হবে, সেহেতু এদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনও থাকবে না৷ ক্রমশঃ তাদের মধ্যে জাগতিক সুখ ভোগের প্রতি ইচ্ছার সৃষ্টি হবে না৷

তাই শ্রী সরকার এ সম্পর্কে বলেছেন--- ‘‘এমন একদিন আসবে  যখন এই রসায়নাগার জাতকরা তাদের অপূর্ণতা সম্বন্ধে  সচেতন থাকবেন ও মহান সাধক হবেন৷ যেহেতু তাঁদের হাতে অফুরন্ত সময় থাকবে সেহেতু তাঁরা বেশী বেশী করে’ সাধনায় রত থাকবেন৷’’

তাই প্রাউট প্রণেতা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার নিজেই বলেছেন--- ‘I have not come here to establish Sadvipra Samaj. That is but a fraction of my true purpose. My real mission is to inundate the world with devotion’’

‘‘আমি এখানে সদ্বিপ্রসমাজ ঘটনের উদ্দেশ্যে আসিনি৷ সেটা আমার আসল উদ্দেশ্যের একটা ভগ্ণাংশ মাত্র৷ আমার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীকে ভক্তি-স্রোতে প্লাবিত ক’রে দিতে৷’’