তেইশে জানুয়ারী! এই শব্দবন্ধটি উচ্চারিত হলে প্রত্যেক বাঙালীর দেহের রোম খাড়া হয়ে ওঠে, শরীরের প্রতিটি কোষে রোমাঞ্চ অনুভূত হয়, শিরা-ধমনীর রক্ত প্রবাহে এক অনাস্বাদিত উদ্বেলতা সঞ্চারিত হতে থাকে৷ ২৩শে জানুয়ারী ক্যালেণ্ডারের পাতায় একটি লাল বর্ণে লিখিত তারিখ মাত্র নয়---এ যেন বাঙালীর মনের মণিকোঠায় সযত্নে সাজানো সোণায় বাঁধানো এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস৷ কারণ, এই দিনটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ‘পৌরুষের বজ্রকৌস্তুভ, উল্কার অনলশিখা, রাজনীতির জ্বলন্ত ধূমকেতু, আপোষহীন সংগ্রামের মূর্ত্ত প্রতীক, স্বদেশ প্রেমের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক,’ মহান বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম৷ সুভাষচন্দ্র শুধুমাত্র একজন মানুষের নামই নয়---একটি আদর্শ জীবনবোধ, মানবপ্রেম তথা বিশ্বপ্রেমের প্রতিভূ, স্বাধীনতা সংগ্রামের মূর্ত্ত বিগ্রহ, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অসম্ভবকে সম্ভব করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ সুভাষচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী, উড়িষ্যার কটক শহরে৷ তাঁর পিতৃদেব জানকীনাথ বসু ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও মাতা প্রভাবতী দেবী ছিলেন মমতাময়ী, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীলা মহীয়ষী মহিলা যিনি পরবর্তী পর্যায়ে সুভাষচন্দ্রের দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন৷ জানকীনাথ বসুর পৈতৃক বাসস্থান ছিল বাঙলারই ২৪ পরগণায় কোদালিয়া গ্রামে৷ কিন্তু কর্মজীবন সূত্রে তিনি কটকে বসবাস করতেন৷ সেই সময় কটক ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত একটি শহর৷
সুভাষচন্দ্রের জন্ম এমন একটা সময়ে হয়েছিল যখন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের চল্লিশ বছরের শিকড় দৃঢ়নিবদ্ধ ও শাসককুলের দাপট মধ্যগগনে৷ ভারতবাসীর ওপর নির্যাতন ও অসম্মান ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার৷ দুবেলা দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্যে দেশবাসীকে অশেষ যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল৷ যুব সমাজের মধ্যে এক ধরণের নির্জীবতা ও ক্লীবতার ছাপ ছিল সুষ্পষ্ট৷ যদিও একদল স্বদেশপ্রেমিক দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন৷ এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে বাঙালীর ঘরে যে অগ্ণিশিশু ভূমিষ্ঠ হলেন তাঁর ললাটে বিধাতা এঁকে দিলেন ভবিষ্যতের জাতীয় নেতার বিজয়তিলক---যার জীবন ত্যাগে শুভ্র, বৈরাগ্যে গৈরিক আর মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে সম্পূর্ণ উৎসর্গীকৃত৷
সুভাষচন্দ্রের শৈশবের শিক্ষারম্ভ হয় কটকের মিশনারী স্কুলে৷ তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও দৃঢ়চেতা৷ পরে তিনি র্যাভেনশ’ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন ও সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন৷ র্যাভেনশ’ কলেজিয়েট স্কুলে অধ্যয়ন কালে সুভাষ সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেনীমাধব দাস মহাশয়ের সংস্পর্শে আসেন৷ তিনি ছিলেন মানবপ্রেমিক ও উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের পূজারী৷ তিনিই সুভাষের তরুণ মনে সংবেদনশীলতা, রুচিজ্ঞান, মানবপ্রেম ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন৷ সুভাষের বয়স যখন পনেরো বছর স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলীর প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন ও সেগুলি পাঠের মাধ্যমে তাঁর মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন ঘটে৷ বিবেকানন্দের জীবন ও বাণী তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল৷ স্বামীজীর ভাবশিষ্য সুভাষ আধ্যাত্মিকতার প্রতিও ছিলেন সমান অনুরাগী৷ আধ্যাত্মিক চর্চা ও যোগাভ্যাস সম্বন্ধে বিভিন্ন বইপত্র আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন ও যোগাভ্যাস অনুশীলনও করতেন৷ এইভাবে বিবেকানন্দের জীবনদর্শন তাঁর মনকে অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক ধর্ম বিষয়ক কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার কাজে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল৷ কারণ স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয়ে যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ এই আদর্শের প্রভাবে সুভাষচন্দ্র দেশসেবা ও দেশবাসীর কষ্টমোচনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ও বহুবিধ সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন৷
উচ্চ শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে সুভাষ কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন৷ কলকাতায় তিনি লক্ষ্য করলেন, ইংরেজ শাসকেরা প্রতি পদে পদে ভারতীয়দের অপমান করত ও মানুষ বলেই গণ্য করত না৷ তাঁরা পথে ঘাটে ট্রেনে বা অন্যান্য যানবাহনে জাতিগত ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করত---এমনকি সমাজের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত ব্যষ্টিদেরও রেহাই দিত না৷ এইসব ঘটনা পরম্পরায় সুভাষের স্বদেশী সচেতনতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও ইংরেজদের প্রতি কঠোর মনোভাবের জন্ম দেয়৷ ১৯১৬ সালের গোড়ার দিকের দু’টি ঘটনা সুভাষের জীবনে বিশেষ পরিবর্তন এনে দিয়েছিল৷ জানুয়ারী মাসের একদিন সকালে ইংরেজ অধ্যাপক ই.এফ.ওটেন তাঁর ক্লাস ঘরের সামনের বারান্দায় কিছু ছাত্র গণ্ডগোল করায় তাদের টানা-হ্যাঁচরা, ধাক্কাধাক্কি ও অসম্মানসূচক গালিগালাজ করেন৷ প্রতিবাদে ছাত্রেরা একজোট হয়ে দাবী করে, ভারতীয়দের অসম্মান করার জন্যে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে৷ কিন্তু ওটেন সাহেব তা করতে রাজী না হওয়ায় কলেজে সাধারণ ধর্মঘট হয়৷ ধর্মঘটের অন্যতম নেতা সুভাষচন্দ্রকে সতর্ক করে দেওয়া হ’ল,কিন্তু তিনি তাঁর দাবীতে দৃঢ় রইলেন৷ অবশেষে অধ্যাপক ওটেন ছাত্রদের সঙ্গে আপোষে ব্যাপারটি মীমাংসা করতে বাধ্য হলেন কিন্তু মনের রাগ মনেই পুষে রাখলেন৷ তীব্র দেশাত্মবোধ ও আত্মমর্যাদা ছিল সুভাষচন্দ্রের অন্তরের চালিকাশক্তি৷ তাই স্বদেশ বা দেশবাসীর সম্বন্ধে কোনও অবমাননাকর ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ৷ ওই ঘটনার প্রায় একমাস পর মিঃ ওটেন অপর একজন ছাত্রের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও ভারতবাসী সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেন৷ শুধুমাত্র প্রতিবাদ বা ধর্মঘটের দ্বারা ওটেন সাহেবের সুবুদ্ধির উদয় হবে না বুঝে কয়েকজন ছাত্র মিঃ ওটেনকে খুব মারধর করে৷ আর এই ঘটনার পরিণামে সুভাষকে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ তবে এই বহিষ্কারের জন্যে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র দুঃখবোধ ছিল না৷ বরং তিনি তৃপ্তিলাভ করেছিলেন এই ভেবে যে, দেশ ও জাতির সম্মান রক্ষায় তিনি রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন৷ বাস্তবিক পক্ষে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বহিষ্কার তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রার দিক্ নির্দেশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল৷ এই ঘটনার ফলে তিনি আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্ব দানের শক্তি অর্জন করেছিলেন৷ তাঁর পরিবারের সদস্যরাও এই সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন৷ যাইহোক, পরবর্তীকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের চেষ্টায় সুভাষচন্দ্র স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হন ও দর্শন শাস্ত্রে অনার্স সহ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ কিন্তু এম. এ. পরীক্ষার আগেই ১৯১৯ সালে সিবিল সার্বিস পরীক্ষার জন্যে তিনি ইংল্যাণ্ড যাত্রা করেন ও ১৯২০ সালে আই.সি.এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments