সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়ের কেন্দ্রবিন্দু আনন্দনগর

লেখক
প্রভাত খাঁ

পশ্চিম বাঙলায় পুরুলিয়া জেলা নোতুন করে অন্তর্ভূক্তির আগে বিহারের ছোটনাগপুর ডিভিশনের অন্তর্ভূক্ত ছিল৷ পুরুলিয়ার পূর্ব নাম ছিল মানভূম৷ মানভূমের সদর মহকুমা ছিল পুরুলিয়া বা পুরুল্যে৷ ১৯৫৬ সালে এই জেলা ঘটিত হয়৷ খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে জৈন ধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর এখানে এসেছিলেন৷ এটি বজ্রভূমির অন্তর্ভূক্ত ছিল৷ কুর্মি, ভূমিজ, বাউরি, কোবা, মাহালি, মুণ্ডা এই স্থানের আদিবাসী পরে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় এসে বাস করে৷ ধীরে ধীরে তারা এই এলাকার মানুষ হয়ে যায়৷ পুরুলিয়ায় বা পারুল্লা (পুরুল্যে) এর আদি অর্থ হ’ল পাথুরে ডাঙ্গার মধ্যে অবস্থিত  গ্রাম৷ আর মুণ্ডা বা মোড়ল হ’ল গ্রামের কর্তা৷ মানসিংহ ১৫৯০ খ্রীষ্টাব্দে ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে মেদিনীপুরে পৌঁছে এই সব এলাকা জয় করেন৷ সম্ভবতঃ মানবাজার মানসিংহের নামে হয়৷ এখানকার ছোট ছোট জমিদার বা রাজারা পরবর্ত্তীকালে ইংরেজ শাসন কায়েম হলে ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তো৷ কথিত আছে ১৭৬৫ সালে এই সব এলাকা ইংরেজদের হাতে আসে৷ একনাগাড়ে ২৩ বছর ধরে সংঘাত চলে৷ ১৮৩২ সালে গঙ্গানারায়ণ হাঙ্গামা হয়৷  কোল অভ্যুত্থান ঘটে৷ আদিবাসীরা বিদ্রোহে অংশ নেয়৷ ইংরেজ আমলে ১৮৩৩ সালে মানভূমের জন্ম হয়৷ এই সব জঙ্গল এলাকা বৃহত্তর বাঙলার অন্তর্ভূক্ত ছিল কিন্তু ১৯১১ সালে মানভূমকে বাঙলা থেকে আলাদা করে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়৷ মানভূম ও ধলভূম দুটি জেলাই বাংলা ভাষাভাষী এলাকা৷ বাঙলায় ইংরেজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জাগ্রত হলে ইংরেজ সরকার বাঙলার অংশ বিহারে যুক্ত করে বাঙলার সীমানা সংকুচিত করে৷ স্বাধীনতার পর ১৯৫৩ সালে রাজ্য পুনর্ঘটন কমিশন ঘটিত হয়৷

স্থানীয় রাজনৈতিক লোকদলের আন্দোলনে অতুল চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে আন্দোলন হয়৷ ডাঃ বিধান রায়ের আমলে ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর মানভূমের পুরুলিয়া মহকুমা ছাঁটখাট করে পশ্চিম বাঙলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়৷ পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার (হস্তান্তর ও অঞ্চল) আইনের মাধ্যমে৷ ধানবাদকে দাবী করা হয় পশ্চিম বাঙলায় দিতে কিন্তু কঞ্জুরু কমিশন কেন্দ্রের অঙ্গুলি হেলনে ধানবাদকে পশ্চিম বাঙলাকে দেয়নি৷ অতি কাঁকুরে ও অনগ্রসর এলাকা পুরুলিয়াকে দেওয়া হয়৷ জামশেদপুরের মতো খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকা বিধান রায় দান খয়রাতি করেন বিহারকে৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর বাঙলার এলাকা বাঙলাকে প্রত্যর্পণ করার দাবী ঘোষণা করা হয় কিন্তু দিল্লী অদ্যাবধি তা দেয়নি৷ (মাঝে বিহারকে ভাগ করে ঝাড়খণ্ড করা হ’ল যেখানে ১৭টি জেলার ১৩টিতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হ’ল অদ্যাবধি বাংলা যাদের মাতৃভাষা তারা ঝাড়খণ্ডে শিক্ষালাভ হতে বঞ্চিত৷ বাংলা ভাষাকে রাজ্যভাষার মর্যাদা আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি৷ আমরা বাঙালী দল বহু বছর যাবৎ আন্দোলন করে চলেছে৷

দুর্ভাগ্যের বিষয় হিন্দী সংখ্যালঘুদের ভাষা তাদের ভাষা হিন্দীকে রাজভাষা করে বাঙালীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে৷) পুরুলিয়ার আলোচনায় ফিরে আসি৷ পুরুলিয়া অরণ্য সম্পদে সমৃদ্ধ৷ এই জেলা খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ৷ জলের অভাবে চাষাবাদ তেমন হয় না৷ মুণ্ডারা বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা মনে করে৷ মাহাতো ও মাহালিরাও আদি বাঙ্গালী৷ লাল মাটি জেলা এই পুরুলিয়া৷ কাঁকুরে মাটি জলধারণের ক্ষমতা নেই বলে জল চলে যায়৷ যদি উপযুক্ত সার, বীজ, জলের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এই মাটিতে সোনা ফলে৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় আজও স্থানীয় লোকেরা পানীয় জলটুকু পায় না৷ উঁচু টাঁঢ় জমিতে জল ধরে রাখা যায় না৷ এই সব স্থানে ফলের গাছ হয়৷ গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্গত এই পুরুলিয়া৷ মানুষের আদি সভ্যতার কেন্দ্র স্থল হ’ল এই পুরুলিয়া৷ রাঢ় এলাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে পুরুলিয়া৷ আগ্ণেয় শিলা ঘটিত এই এলাকায় ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড়গুলি একসময়ে এখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন জন্তু–জানোয়ারদের আবাসস্থল ছিল৷ ডাইনোসোরস, প্রাচীন মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে এই পুরুলিয়ার মাটিতে৷ আগ্ণেয়গিরিও বিদ্যমান এই জেলায়৷ যা আজ মৃত আগেগিরিতে রূপান্তরিত হয়েছে৷ পুরুলিয়ার দর্শনীয় স্থান হ’ল অযোধ্যা পাহাড়৷ এখানে টুরগা ও বামনী ঝর্ণা আছে৷ দুয়ারসিনি দর্শনীয় স্থান৷ অরণ্যের সৌন্দর্য বহন করছে কুইলা পাল৷ কাঁসাই বা কংসাবতীর ওপর মুরগুমা ড্যাম দর্শনীয়৷ দেউলঘাটায় আছে জৈন মন্দির৷ ঝালদা পাহাড় ঘেরা দর্শনীয় স্থান৷ বান্দোয়ান থেকে যাওয়া যায়৷ জয়চণ্ডী পাহাড়ে এসে দর্শক পুরুলিয়া সৌন্দর্য্যকে দেখতে পাবে৷

পুরুলিয়া দেখতে হলে, চিনতে হলে ও এখানকার ইতিহাস জানতে হলে পর্যটকদের অবশ্যই আসতে হবে আনন্দনগরে আনন্দমার্গ আশ্রমে৷ আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যিনি আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় আশ্রম গড়ে তুলেছেন পুন্দাগ স্টেশনের অদূরে বাগলতা অঞ্চলে৷ স্থানীয় গড় জয়পুরের রাণী প্রফুল্ল কুমারী দেবীর দেওয়া বিশাল ভূখণ্ডে গড়ে তোলেন আনন্দ আশ্রমের কেন্দ্রীয় কার্যালয়৷ এখানে একসময়ে মানুষ দিনের বেলা যেতে ভয় পেত৷ শ্বাপদ সংকূল কাঁকুরে টাঁঢ় জমিতে তিনি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ কঠোর পরিশ্রমে এই আশ্রম গড়ে তোলেন৷ এখানে তিনি নৃতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন৷ পুরুলিয়ায় মাটির নীচে যে সব ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন তা যেমন এই সংগ্রহশালায় শায়িত আছে ঠিক তার পাশাপাশি বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষিত আছে যা অন্য কোন সংগ্রহশালায় নেই৷ মানুষ ও ডাইনোসোরসের জীবাশ্ম উদ্ধার করে তিনি এখানে রেখেছেন৷ তাছাড়া বহু প্রাচীন দেব–দেবীর মূর্ত্তি, তৈজসপত্র সংগ্রহ করে রেখেছেন আনন্দমার্গের আনন্দনগরের সংগ্রহশালায়৷ এখানে স্কুল, কলেজ, ফুল ও ফলের বাগান, চিকিৎসালয়, কুষ্ঠাশ্রম, জাগৃতি, আশ্রম গৃহ, অতিথিশালা, পাঠাগার ইত্যাদির দ্বারা শোভিত এক অত্যাধুনিক আশ্রম গড়ে তুলেছেন৷ যা দর্শনার্থে সারা পৃথিবী ভক্তবৃন্দ ও পর্যটকগণ এখানে আসেন৷ এটি বর্ত্তমানে পুরুলিয়া জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান বলে মনে হয়৷ পাণ্ডব বর্জিত এই এলাকা আজ বিশ্বের দরবারে একটি দর্শনীয় স্থান হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছে পরমারাধ্য মার্গ গুরুদেবের অক্লান্ত পরিশ্রমে৷ সভ্যতার আদিবিন্দু অর্থাৎ কেন্দ্রস্থল এই রাঢ়ের আনন্দনগর সত্যই মানবসমাজকে মানব ইতিহাসের অজ্ঞাত বিষয়গুলির সন্ধান দেবে৷

পরিশেষে বলি যে আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার আদর্শবাদী ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন–‘‘রাঢ়ের প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শনগুলিকে উদ্ধার করে বাঙলার ইতিহাসকে নতুন ভাবে গড়ে তোল৷ ভারতের ইতিহাস থেকে ত্রুটিগুলিকে সরিয়ে দাও৷ মানুষের ইতিহাসকে মহামানবের বাণীতে ঝঙ্কৃত করে দাও৷

শ্রীসরকার বলেন–ভারতের আস্তিক্য  দর্শনে রয়েছে তিনটি  মৌলিক ধারা–দুটি সাংখ্য, দুটি মীমাংসা ও দুটি ন্যায়৷ এদের মধ্যে প্রাচীনতম দর্শন হচ্ছে কপিল নিরীশ্বর সাংখ্যর প্রবক্তা মহর্ষি কপিল রাঢ়ের পাট ঝালদা গ্রামের সন্তান ছিলেন, সিদ্ধিলাভ করেছিলেন কপিল পাহাড়ে, মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গঙ্গাসাগরের সাগরদ্বীপে৷ দ্বিতীয় সাংখ্য হচ্ছে মহর্ষি পতঞ্জলীর সেশ্বর সাংখ্য৷ তিনি ছিলেন রাঢ়ের বর্দ্ধমানের নিকটবর্ত্তী পাতুন গ্রামের সন্তান৷ তিনি আরো বলেন–‘‘মানব সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়, মানব সংস্কৃতির চক্রনাভি রাঢ়৷ সেই রাঢ় আবার স্বীয় গৌরবে উদ্ভাসিত হোক৷ সেই রাঢ় আবার ফলে–পুষ্পে–সম্পদে–ম্ উপচে পড়ুক৷ তার চলার পথের কুজ্ঝটিকার আবরণ সরে যাক, তার বিষাদমলিন মুখ হাসির ঔজ্জল্যে ফুটে উঠুক৷’’ আজ আনন্দনগর তথা রাঢ়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার স্মরণে আসছে আচার্য কীর্ত্তানন্দ অবধূতের কথা৷ তিনি একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন যার নাম ‘রক্তমৃত্তিকা রাঢ়, ঐতিহাসিক স্মৃতির কথা’৷ উৎসর্গ করেন পরমারাধ্য শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের শ্রীচরণ কমলে৷ পরমারাধ্য বাবা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেন–কীর্ত্তানন্দ, তুমি রাঢ়কে নিয়ে গবেষণা করছ বলে আমি খু–উ–ব খুশী৷ লেখক রাঢ়ের ইতিহাস, ধর্ম, প্রত্নতত্ত্ব, প্রাণী ও সংস্কৃতি নিয়ে সমগ্র পুস্তকটি লেখেন৷ তিনি গবেষণাকে চালিয়ে যেতে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন৷ যতদূর মনে পড়ে আচার্য কীর্ত্তানন্দ মহামুনি কপিলের জন্মস্থান পাট ঝালদায় কপিল মুনির স্মৃতি উৎসবের প্রতিষ্ঠা করেন৷ আজও গঙ্গাসাগর মেলার দিনে পৌষ সংক্রান্তিতে পাট ঝালদায় মেলা বসে৷ লোকে এই মেলায় যোগদান করে অতীতের মহান মুনিকে স্মরণ করে থাকে৷ মোদ্দা কথা হ’ল পুরুলিয়ার আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের আশ্রমটি মানবেতিহাসের এক অনবদ্য পীঠস্থান৷ রাঢ়কে জানতে হলে, বাঙলা বাঙালীকে তথা মানব সভ্যতা, কৃষ্টি সংস্কৃতিকে জানতে হলে, অবশ্যই এই মহাতীর্থে প্রতিটি মানুষের আগমন জরুরী৷