সাধারণতঃ মাতৃগর্ভে আট মাসের কম থাকার পরে শিশু জন্মগ্রহণ করলে সে মৃত অবস্থাতেই জন্মগ্রহণ করে, অথবা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মারা পড়ে৷ মৃতবৎসা নারীরা তাই সাত মাসে বা তার চেয়ে কম বয়সে শিশু প্রসব করে’ থাকে৷ আট মাসে জন্মালে বেশীর ভাগ শিশু প্রাণে বেঁচে থাকে, তবে আট মাসে জন্মায় খুব কম শিশু৷ তার চেয়ে বরং ন’মাসে জন্মায় বেশী শিশু৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শতকরা ৯৫ শতাংশ ভাগ জন্মায় দশ মাসে, ক্বচিৎ কখনো দু’–একটা জন্মায় একাদশ মাসের গোড়ার দিকে৷ প্রথম সন্তান কোন কোন ক্ষেত্রে ন’মাসের শেষের দিকে জন্মে থাকে৷ নয় মাসের শেষে যারা জন্মায় তারা মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় থাকে৷ তাদের স্বাস্থ্যহানি বড় একটা হয় না৷ তবে গোড়ার দিকে তাদের স্বাস্থ্যের একটু বেশী যত্ন নিতে হয়৷ পরিশ্রুত জল মেশানো পাতলা রাই–সরষের তেল (সমভাবে) মাখিয়ে প্রাতে সেই শিশুকে খানিকক্ষণ মৃদু রোদে শুইয়ে রাখা ভাল৷ তারপর রৌদ্র পক্ব কবোষ্ণ জলে শিশুকে স্নান করানো উচিত৷ গোড়ার দিকে বেশ কিছুদিন স্বাভাবিক মাতৃদুগ্ধ, গর্দভী–দুগ্ধ অথবা জল মেশানো গো–দুগ্ধ ছাড়া অন্য কিছু খেতে দিতে নেই৷ জন্মের পর দু’মাস অতিক্রান্ত হবার পরে তাদের অন্য শিশুদের সমপর্যায়ে আনতে হয়৷
একাদশ মাসে যে শিশুর জন্ম হয়, স্বাভাবিক নিয়মে তার একটু শক্তি সামর্থ্য বেশী হয়৷ তবে তারা যে ব্জ্ত্রন্তুন্দ্ব বা জনগোষ্ঠীতে জন্মায়, সেই জনগোষ্ঠীর যে স্বাভাবিক বর্ণ তার চেয়ে একাদশ মাসে জাত শিশুটির বর্ণ কিছুটা হালকা কৃষ্ণাভ থেকে যায়৷ যে সব জনগোষ্ঠী অত্যন্ত ফর্সা, তাদেরও এগার মাসে জাত শিশু যদিও খুব ফর্সা হয়, কিন্তু অন্যান্যদের তুলনায় একটু কম ফর্সা হয়৷
যে সব শিশু আট মাসে জন্মায় কথ্য বাংলায় তাদের বলে আটাসে ছেলে (মেয়েগ্গ৷ এই সব শিশুর ক্ষ্রহ্মতালু অনেক দিন পর্যন্ত খুব নরম থাকে৷ অন্যান্য শিশুর ক্ষ্রহ্মতালু শক্ত হতে যতটা সময় নেয়, এদের শক্ত হতে তার দ্বিগুণের বেশী সময় নেয়৷ তাই এই সব শিশুদের অত্যন্ত যত্ন নিতে হয়৷ প্রাচীন বাংলায় এদের জন্য তৈরী করা হত এক ধরনের চাকাযুক্ত কাঠের বাক্স৷ সেই কাঠের বাক্সে পিঠে ও মাথার ওপরের দিকে ও পাশে হালকা ভাবে সেলাই করা শিমুল তুলো বিছিয়ে রাখা হত৷ শিমুল তুলোর তোষক নয়–যেমন তুলো তেমনিই রয়েছে৷ কেবল তার ওপরের দিকে কয়েকটা সেলাই চালানো হয়েছে যাতে সূতো বিচ্ছিন্ন হতে না পারে বা ছট্কে ছট্কে শিশুর নাকে, কানে, মুখে তুলো ঢুকতে না পারে৷ এই যে কাঠের বাক্সের মধ্যে রাখা তুলোর বিছানা, এরই ভাল নাম ‘গল্লপক্ষ্ম’৷
আটাসে ছেলেদের/মেয়েদের যদি পাঁচ বৎসর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা হয়, তাহলে তারা অন্যান্য মানুষদের মতই দীর্ঘজীবী হয়৷ তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা চিরকালই ক্ষীণজীবী থেকে যায়৷ সাধারণতঃ আটাসে ছেলেরা (মেয়েরা) খুব বেশী সুদর্শন হয় না (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)৷ শরীর হয় লিক্পিকে, শরীরের তুলনায় হয়ত মাথাটা একটু বড়৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথাটা হয় তিন–এঁটে৷৯১
গাধার দুধ মাতৃদুগ্ধের বিকল্প
গাধার দুধের পুষ্টিমূল্য গোরু বা ঘোড়ার দুধের থেকে অনেক কম৷ মাখনের পরিমাণ খুব কম৷ গুণগত বিচারে গাধার দুধ প্রায় মানবী দুধের সমান৷ তাই শৈশবে মাতৃহারা সন্তানের কাছে গাধার দুধ মাতৃদুগ্ধের একটি সুন্দর বিকল্প৷
কোন শিশুর যদি মাতৃ বিয়োগ হয় আর মাতৃদুগ্ধ না পাওয়ায় সে শিশু যদি অস্থিচর্মসার হয়ে যায়, রোগা রোগা হয়ে যায় তবে সেই রোগের খুব ভাল ঔষধ হচ্ছে মজা কলা, অর্থাৎ যে কলার খোলাটা কাল্চে হয়ে গেছে৷ সেটা চট্কে ন্যাকড়ায় ছেঁকে খাওয়ালে মাতৃদুগ্ধের চেয়েও তার গুণ বেশী৷ এতে শিশু প্রয়োজন মত ক্যালসিয়াম পেয়ে যায় যা দুধের বিকল্প৷ কোন বাছুরের যদি মাতৃবিয়োগ হয়, দুধ না পায়, তাকেও ওই মজা কলা আর দ্বিগুণ ওজনের ছাতু মিশিয়ে জলে গুলে খাওয়ালে সেও হূষ্টপুষ্ট হয়ে যায়৷৯২
শিশুদের জন্যে স্বাস্থ্য বিধি
পাঁচ বৎসরের কম বয়স্ক্ বালক–বালিকার প্রধান খাদ্য দুগ্ধ ও ফলমূল৷ শ্বেতসার, শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য যত কম দেওয়া যায় ততই মঙ্গল৷ কারণ ওই সকল খাদ্য শিশুর অপরিণত যকৃৎ ও পরিপাক যন্ত্রগুলিকে দুর্বল করে দেয়৷
পাঁচ বৎসর বয়সের পূর্ব পর্যন্ত কোন অবস্থাতেই শিশুকে আমিষ খাদ্য দেওয়া উচিত নয়৷ পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে ধীরে ধীরে শ্বেতসার, শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাদ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়৷ ক্ষারধর্মী খাদ্যই শিশুর পক্ষে সবচেয়ে হিতকারী৷ পাঁচ বছরের পূর্বে কোন শিশু যদি দুধ বা ফলমূল বেশী খেতে না চায়, তবে আড়াই–তিন বছর বয়সের পরে অল্প নরম ভাত, পাতলা ডাল, ক্ষারধর্মী সহজ–পাচ্য সবুজ তরিতরকারীর ঝোল খাওয়ানো যেতে পারে৷ দারিদ্য নিবন্ধন অনেকে শিশুদের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দুগ্ধের ব্যবস্থা করতে পারে না৷ অথচ শিশুদের জন্যে প্রয়োজন দৈনিক অন্ততঃ পক্ষে তিন পোয়া/এক সের দুধ৷
শিশুকে মাঝে মাঝে ঝিনুকে করে চূণের জল (চূণ থিতিয়ে গেলে) খাওয়ালে ভাল হয়৷ শিশুদের পক্ষে প্রত্যহ কিছুটা সময় মুক্ত বায়ু ও মুক্ত সূর্যালোকের স্পর্শ বিশেষ উপকারী৷
চূণের জল
কোন একটি পাত্রে খানিকটা চূণ তার দ্বিগুণ জলে ভাল ভাবে গুলে নিতে হয়৷ তারপর তাকে থিতিয়ে যেতে দিতে হয় অর্থাৎ তাকে থিতু অবস্থায় (থিতু শব্দ ‘স্থিতু’ শব্দ থেকে আসছে) খানিকক্ষণ থাকতে দিতে হয়৷ চূণের জল থিতিয়ে গেলে চামচে করে’ ওপরের চূর্ণরহিত জল আস্তে আস্তে তুলে একটা পাত্রে ঢেলে নিতে হয়৷ এই চূণের জল শিশুদের নানান রোগের ঔষধ৷ শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব ঘটলে বা রিকেট রোগ ও কৃমিরোগ দেখা দিলে, এই চূণের জল ওষুধের কাজ করে৷ (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের
‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)