শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করতে হবে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

শিক্ষাই মানব সমাজের মেরুদণ্ড৷ পশু জন্ম থেকেই পশু কিন্তু একটা মানুষ জন্ম থেকে মানুষের গুণাবলী অর্জন করে না, মনুষত্বের বিকাশের জন্যে, সমাজ-চেতনার বিকাশের জন্যে তাকে শিক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়৷ তাই প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা যদি না থাকে, শিক্ষা-ব্যবস্থা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে যথার্থ মানুষ তৈরী হবে না, সমাজ অমানুষে ভরে যাবে, ও সমাজ-ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, ব্যাভিচার প্রভৃতি প্রবল রূপ নেবে৷ বর্তমানে সমাজে যে ব্যাপক উচ্ছৃঙ্খলতা, সমাজ-চেতনাহীনতা, ব্যাভিচারিতা তার মূল কারণ এটাই৷ তাই বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দেশনেতাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ আর শিক্ষার জন্যে একটা শান্ত পরিবেশও অত্যাবশক৷ প্রাচীনকালে এই কারণে  তপোবনে শিক্ষা দান করা হ’ত৷ তপোবনের মত শান্ত পরিবেশই শিক্ষা দানের অনুকূল পরিবেশ৷ কিন্তু বর্তমানে বিশেষ’ করে দলীয় রাজনীতি শিক্ষাক্ষেত্রকে মল্লভূমিতে পরিণত করেছে৷

সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন--- শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে, কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না, সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি পা মেলে তবে হয় একদিন ছাঁচ ফেটে হবে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে সরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা  করের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে৷ সুখের কথা সোভিয়েতের ছাঁচ ফেটে চুরমার হয়ে গেছে, মানুষ মরে আড়ষ্ট হয়ে যায়নি৷

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দাদাদের মাতববরি শুরু হয়৷ বামফ্রন্ট আমলে সেই মাতববরি চরমে ওঠে৷ বিদ্যালয়গুলি শাসকদলের দলীয়-কার্যালয়ে পরিণত হয়৷ শিক্ষার বারোটা বেজে যায়৷ সত্যি বলতে কি বিদ্যালয়গুলি সরল মতি ছাত্রদের পলিটিক্যাল ডল বানাবার ছাঁচে পরিণত হয়েছে, বর্তমান সমাজ যে সব সামাজিক, সাম্প্রদায়িক, জাতিগত ভেদ-বিদ্বেষের শিকার তার মূল কারণ শিক্ষার অভাব, মানুষের সচেতনতার অভাব৷ তাই  সমাজকে যদি বাঁচাতেই হয় তবে শিক্ষনীয় বিষয় ও শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে৷

এখন শিক্ষা ব্যবস্থার বিশুদ্ধতা যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে৷ এর কোনও বিকল্প নেই৷ প্রাউট-প্রবক্তাও  দৃঢ়তার সঙ্গে তাই-ই চেয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ---গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার নীতি-নির্ধারণ, সিলেবাস তৈরী, পরীক্ষা পরিচালনা প্রভৃতি যাবতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্মের দায়িত্ব দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত প্রকৃত শিক্ষাবিদ্‌দের নিয়ে তৈরী বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়া উচিত৷ শিক্ষার ব্যয় ভার বহনের দায়িত্ব কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে৷ এটা সরকারের দায়িত্ব৷ প্রাচীনকালেও তপোবনে গুরুদের ওপর শিক্ষার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ছিল৷ রাজা সেখানে নাক গলাতেন না৷ কিন্তু শিক্ষার ব্যয়ভার রাজকোষ থেকেই বহন করা হ’ত৷ মূল নীতি এটাই হওয়া উচিত৷ তবে শিক্ষার বিশুদ্ধতা রক্ষা পাবে ও সে শিক্ষা মানুষ গড়ার শিক্ষায় পরিণত হতে পারবে ও দেশ প্রকৃত সুনাগরিক পাবে৷