শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

শিক্ষাই মানব সমাজের মেরুদণ্ড৷ পশু জন্ম থেকেই পশু কিন্তু একটা মানুষ জন্ম থেকে মানুষের গুণাবলী অর্জন করে না, মনুষত্বের বিকাশের জন্যে, সমাজ-চেতনার বিকাশের জন্যে তাকে শিক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়৷ তাই প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা যদি না থাকে, শিক্ষা-ব্যবস্থা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে যথার্থ মানুষ তৈরী হবে না, সমাজ অমানুষে ভরে যাবে, ও সমাজ-ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, ব্যাভিচার প্রভৃতি প্রবল রূপ নেবে৷ বর্তমানে সমাজে যে ব্যাপক উচ্ছৃঙ্খলতা, সমাজ-চেতনাহীনতা, ব্যাভিচারিতা তার মূল কারণ এটাই৷ তাই বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দেশনেতাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ আর শিক্ষার জন্যে একটা শান্ত পরিবেশও অত্যাবশক৷ প্রাচীনকালে এই কারণে  তপোবনে শিক্ষা দান করা হ’ত৷ তপোবনের মত শান্ত পরিবেশই শিক্ষা দানের অনুকূল পরিবেশ৷ কিন্তু বর্তমানে বিশেষ’ করে দলীয় রাজনীতি শিক্ষাক্ষেত্রকে মল্লভূমিতে পরিণত করেছে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার প্ররোচনায় তাদের অনুগত ছাত্র-সংসদের সদস্যরা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মারধোর থেকে শুরু করে নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কথায় কথায় অধ্যক্ষ-অধ্যাপকদের ওপর হামলা, ঘেরাও, কলেজের বিভিন্ন কাজে অনাবশ্যক খবরদারি, এমনকি উন্নয়নমূলক কাজেও বাগড়া দেওয়া---এটাই নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বামফ্রণ্ট আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে শাসকদলের দাপাদাপি চরমে উঠেছিল৷ তখন শাসক দল বিদ্যাস্থানগুলিকে নিজেদের পার্টি অফিস বানিয়ে ছেড়েছিল৷ এর প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে দক্ষিণ কলকাতাতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক পুলিশ কনষ্টেবল নিহত হওয়ার পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে তিনি দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত করে দেওয়ার সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন৷ বাস্তবে তিনি কিছুই করলেন না৷ বর্তমানে বলতে গেলে, ময়দানে শাসকদল ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব নেই৷ বিভিন্ন কলেজ সংসদও একচেটিয়া তৃণমূল ছাত্র পরিষদের হাতে৷ এখন ময়দানে তো বিরোধী দলই নেই৷ কিন্তু নিজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে৷ অধ্যাপক-অধ্যক্ষ-ঘেরাও প্রভৃতি ক্ষেত্রেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে৷  এককথায় যে যখন ক্ষমতায় আসে সেই তখন শিক্ষাক্ষেত্রকে দলীয় ক্যাডার কর্মী বানানোর কারখানায় পরিণত করে৷ এই কারখানার দখল নিতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট ছাত্রনেতারা পরস্পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য অরাজকতার এটাই অন্যতম কারণ৷

শিক্ষক নিয়োগেও শিক্ষা অধিকর্র্তদের দলের উর্ধে উঠতে হবে ও শিক্ষকদের শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখলেই চলবে না৷ তাদের চরিত্র ও নৈতিকমানও দেখা দরকার৷ কারণ আদর্শ ছাত্র তৈরী করতে আদর্শ শিক্ষক দরকার৷ কারণ শিক্ষা ব্যবস্থার বিশুদ্ধতা যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে৷ এর কোনও বিকল্প নেই৷ প্রাউট-প্রবক্তাও  দৃঢ়তার সঙ্গে তাই-ই চেয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ---গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার নীতি-নির্ধারণ, সিলেবাস তৈরী, পরীক্ষা পরিচালনা প্রভৃতি যাবতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্মের দায়িত্ব দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত প্রকৃত শিক্ষাবিদ্‌দের নিয়ে তৈরী বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়া উচিত৷ শিক্ষার ব্যয় ভার বহনের দায়িত্ব কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে৷ এটা সরকারের দায়িত্ব৷ প্রাচীনকালেও তপোবনে গুরুদের ওপর শিক্ষার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ছিল৷ রাজা সেখানে নাক গলাতেন না৷ কিন্তু শিক্ষার ব্যয়ভার রাজকোষ থেকেই বহন করা হ’ত৷ মূল নীতি এটাই হওয়া উচিত৷ তবে শিক্ষার বিশুদ্ধতা রক্ষা পাবে ও সে শিক্ষা মানুষ গড়ার শিক্ষায় পরিণত হতে পারবে ও দেশ প্রকৃত সুনাগরিক পাবে৷