দেখা যায়, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশের মত ভারতেরও বেশীর ভাগ মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে৷ সবচেয়ে বেশী শিকার শিশুরা৷ আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ পাঁচ বছর বা তার কম বয়সের শিশু৷ অনেক শিশু পাঁচ বছর পূর্ণ করার আগেই মারা যায়৷ এর বড় কারণ হ’ল অপুষ্টি৷
পুষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে শিশুদের ‘প্রোটিন–ক্যালরির অভাবজনিত অপুষ্টি’৷ যাকে বলে ‘প্রোটিন–এনার্জি ম্যালনিউট্রিশন’ বা প্রোটিন ক্যালরির অপুষ্টি৷ এই অপুষ্টির প্রাদুর্ভাব বাঙলাদেশ সহ ভারত, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় বেশী৷ কোটি কোটি শিশু এ রোগের শিকার৷
প্রোটিন–ক্যালরির অভাবজনিত রোগগুলো হচ্ছে কোয়াশিয়রকর, ম্যারাসমাস, পুষ্টিগত দেহখর্বতা ও স্বল্প ওজনের শিশু৷ এর মধ্যে শিশুর প্রধান দুটি রোগ হচ্ছে কোয়াশিয়রকর ও ম্যারাসমাস৷ শিশুদের ‘প্রোটিন–ক্যালরির অভাবজনিত অপুষ্টির’ প্রধান রোগটি হচ্ছে কোয়াশিয়রকর৷ এ রোগের প্রধান ঘাটতি প্রোটিন৷ আমাদের দেশের মানুষ শিশুর এ রোগকে বলে ‘ফোলা রোগ’৷
রোগের কারণ
এক থেকে তিন বছরের শিশুদের মধ্যেই এই রোগ হয়৷ শিশু মায়ের দুধ পানের সময় হঠাৎ স্বল্প আমিষযুক্ত পারিবারিক খাদ্যে অভ্যস্ত হলে, দারিদ্র্যতার কারণে পুষ্টিকর খাবার কম খেলে বা উদ্ভিজ খাবার না খেলে, মৌসুমি খাদ্যের স্বল্পতায় এ রোগ দেখা দেয়৷
এছাড়া শিশুকে খাওয়ানোর ত্রুটিপূর্ণ নিয়ম, খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ বণ্টন, প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস, দারিদ্র্য ও আনুষঙ্গিক রোগ, হাম, ম্যালেরিয়া, হুপিংকাশি ও ডায়ারিয়ার সংক্রমণে, খাদ্য সম্পর্কে মা–বাবার অজ্ঞতায় ও শিশুর ক্ষুধার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় এ রোগ হতে পারে৷
রোগতত্ত্ব বা এপিডেমিওলজি
বিজ্ঞানীদের মতে, শিশু পুষ্টিকর খাবার কম খাওয়ায় প্রোটিন সংশ্লেষণের পরিমাণ কমে গিয়ে দেহকলার প্রতিস্থাপন, দেহের বৃদ্ধি ও ঘটন ব্যাহত হয়৷ এনজাইম ও কোষকলা তৈরী হয় না৷ রক্তরসে এলবুমিন কমে৷ দেহে শোথের সৃষ্টি হয়৷ ওজন হ্রাস পায়৷ দেহে ইলেকট্রোলাইটসের বিপর্যয় দেখা দেয়৷ যকৃত ও মাংসপেশীর কাজ সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় এসব অঙ্গে মেদজাতীয় পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়৷
রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ
শিশুর শরীর ফুলে যাওয়ার কারণে ওজনের ঘাটতি হঠাৎ ধরা না পড়লেও বয়স অনুপাতে ওজন কমে যায়৷ দেহে বিশেষ করে পায়ে, হাতে, মুখে শোথ বা রসস্ফীতি ঘটে৷ শোথের কারণে শীর্ণতা ধরা পড়ে না৷ কখনো বাহু ও পায়ের পেশীতে তা ধরা পড়ে৷
শিশুর মানসিক পরিবর্তন ঘটে৷ উদাসীন, নিস্পৃহ থাকে৷ মেজাজ খিটখিটে থাকে৷ চুল, মিহি, খাড়া, নরম ও পাতলা হয়৷ ঘটন ও রঙের পরিবর্তন হয়৷ কালো চুল বাদামি হতে পারে৷ রোগের গুরুতর পর্যায়ে ত্বকের পরিবর্তন ঘটে৷ পা, নিতম্ব ও কুঁচকির স্তরে স্তরে লাল ক্ষত দেখা যায়, অনেকটা আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো৷ ঠোঁটে, ঠোঁটের কোণে, জিহ্বায় ও মলদ্বারে ঘা হয়৷ শিশু খেতে চায় না৷ বমি হয়৷ পাতলা পায়খানা করে৷ তাতে রক্তমিশ্রিত থাকে৷ লিভারে চর্বিজাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হয় বলেই স্ফীতি ঘটে৷ শিশুর রক্তশূন্যতা থাকেই৷ কখনো চোখের ঝিল্লি শুকিয়ে জ্বালা–যন্ত্রণা হয়৷ আবার কিছু কিছু রোগ যেমন উদরীয় যক্ষ্মা, ক্রনিক আমাশয়, বেরিবেরি, নেফ্রাইটিস ইত্যাদি কোয়াশিয়রকর রোগের সঙ্গে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে৷
প্রতিরোধ
এ রোগের প্রধান কারণ মা–বাবার অজ্ঞতা ও দারিদ্র্য আগে দূর করতে হবে৷ শিশু জন্মের পর থেকে কম পক্ষে দু‘বছর পর্যন্ত বুকের দুধ ও পাঁচ মাস বয়সের পর পাশাপাশি অন্যান্য খাবার ও পরবর্তী সময়ে প্রোটিন সমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ খাবার দিতে হবে৷ শিশুকে এক বছরের মধ্যে সবগুলো টিকা দিতে হবে৷ ডায়রিয়ায় খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে৷
এছাড়া শস্যজাতীয় ও শুটিজাতীয় খাদ্য বা বাদাম ইত্যাদি খাদ্যের যথাযথ সংমিশ্রণের সাহায্যে শিশুর এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব৷
চিকিৎসা
শিশু যদি ফোলা রোগে আক্রান্ত হয় এর চিকিৎসা অবশ্যই প্রয়োজন৷ সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে না রাখলে এ রোগের বিভিন্ন জটিলতায় শিশু মৃত্যুবরণ করে৷
শিশুর এ রোগে জলশূন্যতা ও ইলেক্ট্রোলাইসের ভারসাম্যহীনতায় শিশুকে মুখে খাবার স্যালাইন ও দেহ শিরায় ইলেক্ট্রোলাইট দ্রবণ প্রয়োগ করা হয়৷
শিশুর দেহে কম তাপমাত্রার কারণে উষ্ণ কাপড় বা কম্বলে জড়িয়ে রাখতে হয়৷ রক্ত শর্করার স্বল্পতায় শিরায় গ্লুকোজ, মারাত্মক রক্তশূন্যতায় প্যাকড রেড সেল দেওয়া হয়৷ সংক্রমণে অ্যাণ্টিবায়োটিক ও কৃমির জন্যে ওষুধ দেওয়া হয়৷ তাতে ভিটামিন এ ক্যাপসুল ও অন্যান্য ভিটামিন পরিমাণ অনুযায়ী সেবন করাতে হয়৷ শিশুকে পর্যাপ্ত মাত্রায় ক্যালোরি ও ভাল জৈব মানসম্পন্ন প্রোটিন ও সঙ্গে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ পদার্থযুক্ত সহজপাচ্য ও উপযোগী খাবার দিতে হবে৷ চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু মিনারেল যেমন পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, জিংক ও ফেরাস সালফেট দেওয়া হয়৷ তিন–চার দিন পর থেকেই শিশুকে ভাত, আলু, কলা, ডিম, গম, রুটি, দুধ, খিচুড়ি ইত্যাদি দেওয়া যায়৷ তখন কয়েক ঘণ্টা পরপর তাকে খাবার দেওয়া প্রয়োজন৷ শিশুকে মায়ের সান্নিধ্যে রাখতে হবে৷
ভালো হাসপাতালেও মারাত্মক রোগীর মৃত্যুহার প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ৷ প্রথম সপ্তাহে এ হার বেশী৷ কিন্তু সঠিক ও সময়মত চিকিৎসার ফলে শিশুরা এ রোগ থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে৷
- Log in to post comments