স্মৃতির অন্তরালে জনৈক বঙ্গ মহিলা’’

লেখক
কণিকা দেবনাথ

                                ‘‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে

                                                আসে নাই কেহ অবনী পরে,

                                সকলের তরে সকলে আমরা

                                                প্রত্যেকে আমরা পরের তরে৷’’

আজ থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগে এক বঙ্গললনার কলমে রূপ পেয়েছিল সমসমাজতত্বের ভাবনা৷ সেই সময় বাঙলা দেশে নারী শিক্ষা খুবই দুর্লভ৷ নারীজাতিকে গৃহকোণে আবদ্ধ রাখাই সামাজিক প্রথা৷ অবশ্য তারও ৫০ বছর আগে রাজা রামমোহন রায় হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুরতম প্রথা সতীদাহ নিষিদ্ধ করেন ও নবজাগরণের দীপ জ্বেলে দিয়ে যান৷ গোঁড়া হিন্দু সমাজপতিরা তখনও ক্রোধে ফুঁসছে৷ কুসংস্কারের কুহেলিকা ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার মানবিকতা তাদের ছিল না৷

ঠিক ওই সময় এক শিক্ষিত ব্রাহ্ম-সমাজ পরিবারে ১৮৬৪ সালের ১২ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করে কামিনী রায়৷ তাঁর জন্মস্থান তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাখেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে৷ বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়৷ ব্রাহ্মসমাজের পরিবেশে থাকায় সেই সময় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তাঁর উচ্চশিক্ষালাভের  পথে কোন পারিবারিক বাধা ছিল না৷ তৎকালীন সমাজে ব্রিটিশ ভারতে সংস্কৃতভাষায় তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন৷ তাঁর পিতা চণ্ডীচরণ সেন বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন৷ পিতার কাছেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ৷ ১২ বছর বয়সে প্রথম স্কুলে ভর্তি হন৷ ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতার  বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে এফ.এ (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিকের সমতুল্য) পাশ করেন৷ ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বেথুন কলেজ থেকে সংস্কৃত ভাষায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ  করেন৷ ওই বছরই তিনি বেথুন স্কুলে শিক্ষিকার পদে নিযুক্ত হন৷ পরবর্ত্তীকালে বেথুন কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন৷

তৎকালীন সমাজে নারী শিক্ষা খবুই বিরল ঘটনা৷ তিনি সেই সময়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি অবদমনের প্রতিবাদে সরব ছিলেন৷ তাঁর রচিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধেও তার প্রতিফলন পড়ে৷ তাই তাঁকে নারীবাদী লেখিকা বলতেন অনেকে৷ মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন৷ ১৫ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’ প্রকাশিত হয়৷

প্রথমদিকে তিনি ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন৷

তাঁর অতি পরিচিত একটি কবিতা---

‘করিতে পারিনা কাজ সদাভয় সদালাজ

সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে....’

তৎকালীন সমাজে তিনি শুধু একজন প্রথিতযশা কবি ছিলেন না, ছিলেন সমাজকর্মী৷ তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশনের সদস্য হয়েছিলেন৷ ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে স্টাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়৷ ১৯০৯ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামীর  মৃত্যু হয়৷ কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি বেশকিছু প্রবন্ধ লেখেন৷ সেই সময় মেয়েদের শিক্ষালাভে উৎসাহ দিতে তিনি প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বালিকা শিক্ষার আদর্শ’ রচনা করেন৷ ১৯২৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিনী স্বর্ণপদক প্রদান করে সম্মানিত করেন৷ তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ সভাপতি হয়েছিলেন ১৯৩২-৩৩ সালে৷ তিনি ১৯৩৩ সালের ২৭শেসেপ্ঢেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন প্রথিতযশা কবি ও সমাজকর্মী কামিনী রায়৷