১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী দেশ শাসনের জন্যে ভারতের নিজস্ব সংবিধান প্রবর্ত্তিত হয়৷ তারপর সত্তরটা বছর অতিবাহিত হয়েছে৷ আজ দেশের নাগরিককে নাগরিকত্বের প্রমাণের জন্যে লাইনে দাঁড়াতে হবে৷ সীমাহীন অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বিভাজন ও রাজনৈতিক সংঘাতে প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার৷ পরিতাপের বিষয় এই যে শাসক দলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদতে এগুলি হয়ে চলেছে৷ অথচ শাসক দলেরই প্রধান দায়িত্ব সংবিধানের অঙ্গীকারগুলি পালন করা৷ মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করা৷
দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক সার্বভৌম, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে সংবিধানে৷ প্রতিটি মানুষের জন্যে ন্যায় বিচার ও সমানাধিকারের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে৷ সেই সঙ্গে জনসাধারণকে ছয়টি মৌলিক অধিকার দিয়েছে৷
সেগুলি হ’ল সাম্যের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিষয়ে অধিকার ও প্রতিবিধানের অধিকার৷ এই সব অধিকারের মূল লক্ষ্য সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সব রকম বৈষম্যের অবসান৷ কিন্তু হায় সত্তর বছরে এই বৈষম্য আরও দীর্ঘ হয়েছে৷
অর্থনীতির কথাই ধরা যাক৷ দেশের মোট সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশীর মালিক মাত্র ৬৩ জন ধনকুবের৷ এই তথ্যেই ধন-বৈষম্যের করুণ অবস্থা জানা যায়৷ এই বৈষম্য কমার লক্ষণ নেই বরং আরও বাড়বে৷ সামাজিক বিভাজন---শাসক দলই সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সামাজিক বিভাজনের আইন পাশ করিয়েছে৷ জাতিগত, সাম্প্রদায়িকগত সংঘাত তো লেগেই রয়েছে৷ রাজনৈতিক ভেদ-বিদ্বেষ, সংঘাত তো আছেই, নেতাদের আচার-আচরণ কথাবার্তা অত্যন্ত নিম্নমানের ও কুরুচিপূর্ণ৷ পদে পদে সংবিধানকে অবজ্ঞা করে সাধারণের ওপর দাদাগিরি তো আছেই৷
শিক্ষার অধিকার--- আজ এদেশে কোটি কোটি মানুষ অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছে৷ দেশে মন্দির, মসজিদ নির্মাণে যে অর্থ ব্যয় হয় তার ১০ শতাংশও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় হয় না৷ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উগ্র হিন্দী প্রেম আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতির সাংবিধানিক অধিকারকে প্রতিনিয়ত পদদলিত করছে৷ শোষণ, অন্যায় অধিকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকার---সেও শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে আতঙ্কিত৷ শাসক দলের বিরুদ্ধে কথা বললেই দেশদ্রোহী তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে৷
কেন একটা স্বাধীন দেশ সত্তর বছরে তিলে তিলে অধঃপতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কেন তার আজ এই দুর্দশা! কারণ একটাই৷ পুঁজিবাদ আশ্রিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ যে দলই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ধন কুবেরদের স্বার্থ রক্ষা করাই তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়৷ গণতন্ত্রের বহুল প্রচলিত প্রবাদকে ব্যঙ্গ করে এখানে গণতন্ত্রের অর্থ হয়েছে পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে, পুঁজিবাদের দ্বারা নির্বাচিত পুঁজিবাদের সরকার৷ জনসাধারণের ভূমিকা নিতান্তই গৌণ৷ সাধারণের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পুঁথির পাতায় রয়ে গেছে৷ সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর প্রখর দূরদৃষ্টি দিয়ে স্বাধীন ভারতের এই পরিণতি বুঝে নিয়েছিলেন বলেই রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও বলেছিলেন৷ তাই তো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক আত্মত্যাগে মহান মানুষটির স্থান পুঁজিবাদ আশ্রিত কংগ্রেসে হয়নি৷ পুঁজিবাদের অর্থের দাস কম্যুনিষ্ট, আর.এস.এস. ও সেদিন তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি৷ তাই তো সুভাষচন্দ্র আজও অজানা অন্ধকারে রয়ে গেছেন৷
আজ সংবিধানের অঙ্গীকার সার্থক করে তুলতে হলে জনগণের হাতে প্রথমেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিতে হবে৷ শুধুমাত্র চাকুরীজীবীদের বেতন বৃদ্ধি নয়, সবাইকে ক্রয়ক্ষমতা দিতে হবে৷ বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক দূরাবস্থা থেকে মুক্তির একটাই মাত্র পথ৷ এ পথ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব তথা প্রাউটের পথ৷ প্রাউট দেখিয়েছে কীভাবে জল হাওয়া ভৌগোলিক অবস্থান ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দেখে, সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে স্থানীয় মানুষের হাতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দায়িত্ব দিয়ে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়৷ তাই প্রাউটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই মানুষ মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করবে৷ সেইদিনই সংবিধানের অঙ্গীকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে৷
- Log in to post comments