নিত্যানন্দ এক অনাদি অনন্ত নিরাকার পরমব্রহ্মের মানস কল্পনা হলো--- ‘‘এক ঃ অহম্ বহুস্যামি ৷’’ এটাই হল সৃষ্টির মূল রহস্য৷ এই বহু বিচিত্র সৃষ্টির মধ্যে তিনি অবিরাম লীলা করে চলেছেন৷ এইভাবে লীলানন্দময় রূপে নিজেকে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে বিকশিত ও প্রতিফলিত করে চলেছেন প্রতিনিয়ত৷ তারকব্রহ্ম মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী আনন্দসূত্রম এর পঞ্চম অধ্যায়ের অষ্টম সূত্রে বলেছেন--- ‘‘বৈচিত্রং প্রাকৃতধর্মঃ সমানাং ন ভবিষ্যতি৷’’ অর্থাৎ বৈচিত্রই প্রকৃতির ধর্ম৷ এই প্রকৃতিই হচ্ছে পরমব্রহ্মের ক্রিয়াশীল রূপ৷ সৃষ্ট জগতের কোন দুটি বস্তুই হুবুহু এক নয়--- দুটি শরীর এক নয়, দুটি মন এক নয়, দুটি অণু বা পরমানু এক নয়৷ এই বৈচিত্র্যও প্রকৃতির স্বভাব৷ তাই তো আমরা দেখি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে এক বৈচিত্র্যময় দৃশ্য্যপট৷ এমন কি দুটি জমজ সন্তান ও একরকমের হয় না৷ বৈচিত্রের বিস্ময়তম দৃষ্টান্ত হচ্ছে--- একটি বৃক্ষের কোন দুটি পাতা ও এক ধরনের নয়৷ কিছু পার্থক্য থেকে যায়৷ আরও অবাক হওয়ার কথা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অতীত থেকে বর্ত্তমান কাল পর্যন্ত শরীর, চেহারা ও মনের দিক থেকে কোন মিল নেই কারো সাথে কারোরেই৷ তাই তো নিউটন, গ্যালিলিও, শেক্স্পিয়ারের, রবীন্দ্রনাথ আজও অদ্বিতীয় ৷ পূর্ব জন্মের সংস্কার অনুযায়ী মানুষের , শরীর মন পৃথক পৃথক হয়৷ প্রতিটি মানুষের সংস্কার আবার এক রকমের হয় না৷ অজস্র অলৌকিক ডেমোন্স্টেশনের মত একটি ডেমোনষ্ট্রেশনে মহাকৌল শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি দেখিয়েছেন দুটি মানুষের সংস্কার এক হলে তাদের পৃথক অস্তিত্ব থাকে না৷
যাইহোক আসল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে--- এত বৈচিত্র থাকা সত্ত্বেও সব কিছু সমান কেবল প্রকৃতির অব্যক্ত অবস্থায় ৷ প্রতিটি সত্তার , প্রতিটি প্রজাতির কতকগুলি প্রকৃতি দত্ত মৌলিক বৈশিষ্ট্য অব্যক্ত অবস্থায় আধারিত ও সঞ্চারিত৷ যেমন আহার, নিদ্রা, ভয় ও বংশ বিস্তার এর এষণা প্রতিটি জৈবিক সত্ত্বার মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য৷ আবার যেমন বাঘ, সিংহ, জন্মগতভাবে মাংসাহারী৷ কিন্তু গরু, ছাগল, খরগোস, হরিণ জন্মসূত্রে তৃণভোজী, নিরামিষাসী৷ তেমনি সত্যি কথা বলতে গেলে---
মানব শরীর প্রকৃতিগতভাবে নিরামিষাসী৷ তার দাঁতের গঠন, নাড়িভুড়ি, পাকস্থলীর গঠন সেইভাবে তৈরী৷ কিন্তু লোভ, লালসার বশবর্ত্তী হয়ে আমিষ ভোজন করে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ করছে৷ তারফলে তার শরীর মন রাজসিক ও তামসিকস্তরে অবনত হচ্ছে৷ তাই মানুষের উচিৎ সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করে আধ্যাত্মিকতার পথে অণুসরণ করা৷ তেমনি আবার প্রতিটি বস্তু বা সত্ত্বার মধ্যে বিশেষ বিশেষ সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম রয়েছে৷ যেমন জলের ধর্ম ভিজিয়ে দেওয়া, আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি৷ আর মানুষের প্রকৃতিগতভাবে অব্যক্ত বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম হচ্ছে--- ভাগবত ধর্ম৷ অর্থাৎ স্রষ্টা পরম ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য, জীবনচক্রে পরিক্রান্তিলাভের জন্য নিরলস, নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়াস চালানো অর্থাৎ সাধনা করা৷ জগৎগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী তাই বলেছেন--- ‘‘ধর্মবিহীন মানব জীবন পশুর চেয়ে অধম জীবন৷’’
যাইহোক, যে কথাটা বলতে চাইছি, সেটা হলো সব মানুষই অমৃতের সন্তান, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ রূপায়ণ, সব মানুষের মধ্যে পারস্পরিক একটি আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান৷ কারণ সবাইকার স্রষ্টা একই ব্রহ্ম৷ উন্নত মস্তিষ্ক ও সমুন্নত বুদ্ধি সম্পন্ন ও বিকশিত মননশীলতার অধিকারী মানুষকে আজ দ্বিধীহীনভাবে স্বীকার করতেই হবে--- ‘‘হরপিতা, গৌরীমাতা, স্বদেশ ভূবনত্রয়ম্৷’’ শুধু মানুষ কেন, সব কিছু চেতন অচেতন, জৈব অজৈব সত্তার স্রষ্টা ও পালনকর্তা একই পরমব্রহ্ম৷ ব্রহ্ম একং অদ্বিতীয়ম্৷ ’’ তাই তত্ত্বগতভাবে সব সৃষ্টির মধ্যে একটা পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে৷ সেজন্য প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে একটা ভারসাম্য সামঞ্জস্য ও সন্তুলন রাখা প্রকৃতির অমোঘ বিধান৷ মানবসমাজে সব মানুষের মধ্যে একটা আন্তরিকতাপূর্ণ মমত্ববোধ থাকা বাঞ্জনীয় ও কাম্য৷ এই বিধানও নিয়মের ব্যতিক্রম হলে সমূহ বিপদ৷ প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ করার কারনে প্রাকৃতিক পরিশোধের কবলে পড়তে হবে৷ পরস্পরের মধ্যে বৈচিত্র্য, পার্থক্য তো থাকবেই৷ কিন্তু বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ঐক্যতান ধরার ধুলিকে সুখ, শান্তি ও আনন্দের সুর মুর্চ্ছনায় ভরিয়ে দেবে রঙবেরঙের বিচিত্র পুষ্পে সুশোভিত পুষ্পোদ্যানের মত অবনীর মাঝে স্বর্গীয় নন্দনের সুরভি সৌরভ ও সুষমা বিরাজ করবে৷
বর্তমান মানবসমাজে সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক মৌলনীতি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেছে৷ তাই দিকে দিকে দেখা যায় মাৎস্যনায়, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি , সন্ত্রাস বিশ্বের মানব সমাজকে বিধবস্ত, বিপর্যস্ত ও সন্ত্রস্ত করে তুলেছে৷ মানবতার মোহনবাণী দয়া, প্রেম, ভালবাসা, মমতা, মমত্ববোধ সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে৷ বর্তমান এই অবক্ষয়িত মানব সমাজের করুণ, বিভৎস, মর্মান্তিক মাৎস্য ন্যায় অবলোকন করে তারকব্রহ্ম যুগাবতার শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর সাধের সৃষ্টির অবক্ষয় ও মানব সমাজের অধোগতি এবং মানবতার গ্লানি অপনোদনের নিমিত্ত মহাসম্ভূতিরূপে আবির্ভূত হয়েছেন, অবর্ণনীয় ক্লেশ বরণ করে অব্যর্থ মকরধবজের বিধান দিয়েছেন, যা ইতোপূর্বে কোন মহাপুরুষ দেননি৷ তিনি সামাজিক মূল্য ও মানবিক মৌলনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘সুদূর অতীত থেকে একে বিবর্তনের ধাপ পেরিয়ে মানুষ আজকের এই পরিবেশে এসে পৌঁচেছে৷ তার এই অবিরল যাত্রা কিন্তু একক নিঃসঙ্গ যাত্রা নয়৷ সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে৷ সমাজকেও৷ মানুষের অস্তিত্বের দুটি দিক--- একটা সে নিজে তার ব্যষ্টির অস্তিত্ব৷ আর দ্বিতীয়টি হলো সে সমাজের সদস্য---তার সমষ্টিগত অস্তিত্ব৷ এই দুই অস্তিত্ব থেকে মানুষের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়৷ একটি তার সামাজিক মূল্য আর অপরটি হলো তার মানবিকমূল্য৷’’
তিনি বলেছেন‘‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য!’’ মানুষ মানুষ ভাই ভাই৷ মানুষে মানুষে ও অনেক সময় মতবাদগতভাবে ভেদ দেখা দেয়৷ মতবাদের ভেদ জিনিষটা কি? যে জিনিষটাকে মানুষের ভাল লেগেছে সেই আদর্শটিকে যে পথটাকে তার ভাল লেগেছে, কোন একটা থিওরী কারো ভাল লেগেছে, সে সেইপথে চলুক না, তাতে মানুষে মানুষে সংঘাত বাধবে কেন৷’ বাধতেই পারে না৷ সুতরাং এক অবিভাজ্য মানবসমাজকে যদি কেবল মতাদর্শের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়, সেটাও হবে সম্পূর্ণ একটা দুষ্টপরিকল্পনা৷ মতবাদের ভেদ থাকলেই যে তারা পাশাপাশি থাকতে পারে না, তা হতে পারে না৷ এক বাড়ির চার ভাই-এর চারটি মতাদর্শ থাকতে পারে বৈকি৷ হ্যাঁ মনে রাখতে হবে যে, এমন কোন মতামর্শ না হয় যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, জঘন্য, সেই ধরনের মতাদর্শ সহ্য করা চলবে না৷ কারণ তা মানুষজাতের কাছে আত্মঘাতী৷ অন্যথায় বিভিন্ন মতাদর্শ,তাদের টিকা টিপ্পনী নিয়ে এগিয়ে চলুক, কারও বলবার কিছু থাকা উচিৎ নয়৷ কারণ এই বৌদ্ধিক সংঘাতের ফলে মনীষা এগিয়ে চলে৷ সুতরাং মনীষার সকল দ্বার অবরুদ্ধ রাখব কেন? বাইরের আবহাওয়া আসুক তাতে মনীষা পরিপৃষ্ট হবে৷’’ তিনি বলতে চেয়েছেন, --- মানুষ মানুষের সঙ্গে যতবেশী মিলে মিশে হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে, মানবজাতির ততবেশী কল্যাণ৷
তিনি মানবসমাজের এই দুর্দিনে মর্মাহত হয়ে আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘‘সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই মানুষের সামনে অনেক মতবাদ এসেছে, চলার পথে অজস্র ছন্দ এসেছে কিন্তু তারা কেউই মানুষজাতকে একটা অখণ্ড, অচ্ছেদ্য সত্তা হিসাবে দেখতে শেখায় নি৷ তাই আজ মানুষের মধ্যে এত হানাহানি, এত অসিষ্ণুতা৷’’ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী এহেন দুর্বিষহ মানব সমাজের ধবংসোন্মুখ পরিস্থিতিতে মানবসমাজকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করতে, মানবতাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে ধন্বত্বরী বিধান দিয়েছেন৷ যা অচিরেই মানবসমাজ ক্রান্তি , বিক্রান্তি পরিক্রান্তির পথ ধরে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাবে, মানুষ আধ্যাত্মিকতার পথে এগিয়ে গিয়ে দেবত্বের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে৷ এখন দেখা যাক্, তাঁর নির্দেশিত, প্রদর্শিত, নিদানগুলি কী কী৷
প্রথমেই বলতে হয়, তিনি ‘‘সংগচ্ছধবং সংবদধবং’’ মন্ত্রের উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করে মিলিত সাধনার পূর্বে তা অত্যাবশ্যকীয় ও বাধ্যতামূলক করেছেন, যাতে প্রতিটি সাধক এর যথার্থ অর্থ ও তাৎপর্য বুঝে নিজেদের সর্ববিধ সংকীর্ণতার উর্ধে উঠতে পারে৷ তাছাড়া তিনি শপথ গ্রহণের বাণী কঠোরভাবে পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা ঐক্যের পথে অমোঘবাণী৷
তিনি এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নব্যমানবতাবাদ দর্শন প্রবর্তন করেছেন, যা ইতোপূর্বে কোন মহাপুরুষ দেননি৷ এই দর্শনে তিনি প্রতিটি মানুষের মধ্যে সকল সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলার প্রেরণা দিয়েছেন৷ তিনি প্রভাত সঙ্গীতে একথাই উদাত্ত কন্ঠে বলেছেন---
‘‘ মানুষ যেন মানুষের তরে
সব কিছু করে যায়৷
একথাও যেন মনে রাখে
পশুপাখী তার পর নয়,
তরুও বাঁচিতে চায়৷৷’’
তিনি বিশ্বৈকতাবাদের সোপান তৈরী করে দিয়েছেন৷ যা সমগ্র মানব সমাজকে এক দৃঢ় নিবদ্ধ সম্প্রীতির ডোরে আবদ্ধ করে সমস্ত ভেদ বুদ্ধির অবসান ঘটাবে৷
আর তিনি মানুষে মানুষে, আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য দিয়েছেন সমুন্নত আধ্যাত্মিক দর্শন৷ আর মানুষের আর্থিক সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রবর্তন করেছেন যুগান্তকারী দর্শন প্রাউট তথা প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব৷
তিনি এভাবে হতাশাগ্রস্ত মানুষের মাঝে আশারবাণী শুণিয়ে প্রভাত সঙ্গীতের সুরে গেয়েছেন ও সাদরে আহ্বান জানিয়েছেন৷
‘‘চল চল চল,
গান গেয়ে চল,
আশার আলোকশিখা অতি উজ্জ্বল৷......’’
এই আশার পথ ধরেই বিশ্বের সকল মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত ধরে চলতে হবে পশুপাখী, তরুলতা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে৷
- Log in to post comments