পরিচয় ও প্রজাতি ঃ তোমরা শোভাঞ্জন বা শোজনের অথবা (Moringa oleifera pterygosperma Gaetn.) সঙ্গে ভাল ভাবেই পরিচিত৷ শোভাঞ্জন ঞ্ছ শোহাঞ্জন ঞ্ছ শোআঞ্জন ঞ্ছ শোজিনা ঞ্ছ শোজনে৷ শোভাঞ্জন শব্দের ভাবারূঢ়ার্থ হ’ল চোখের শোভা৷ শীতকালে যখন শাদা শোজনে ফুলে গাছ ভরে যায় তখন তা দেখতে ভারী সুন্দর লাগে৷ তাই এর নাম শোভাঞ্জন৷ শোজনের ফুল আসে শীতের মাঝামাঝি সময়ে৷ ডাঁটা ধরে শীতের শেষে–সেই সময়ে যে সময়ে বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হয়৷
বার মেসে শোজনের ফুল একটু হলদেটে বা ঘিয়ে রঙের, স্বাদও একটু কম লোভনীয়৷ দেখতেও ততটা সুন্দর নয়৷ নাজনের ডাঁটা একটু মোটাসোটা৷ স্বাদ শোজনের চেয়ে কিছুটা কম৷ বারমেসে শোজনেকে কলকাতায় আমরা নাজনে বলি, বর্দ্ধমানে বলি শাজনা৷ অসম, বাংলা, ওড়িষ্যা, মিথিলা ও পূর্বভারতের সর্বত্রই মাটি ও আবহাওয়া শোজনের (ও নাজনের) পক্ষে বিশেষ অনুকূল৷
রক্ত–পরিষ্কারক, চর্মরোগ বিনাশক, যকৃত ও অগ্ণ্যাশয়ের পক্ষে সহায়ক ঃ শোজনেতে সমাবিষ্ট হয়েছে অজস্র গুণ৷ শোজনের মূল (শেকড়, ছাল, পাতা, ডাঁটা ও বীজ–সব কিছুরই ঔষধীয় মূল্য রয়েছে৷ শোজনে যকৃতের পক্ষে ভাল, রক্ত–পরিষ্কারক, কিঞ্চিৎমাত্রায় রক্তবর্দ্ধকও৷ শোজনে চর্মরোগ বিনাশক, ক্ষুধাবর্দ্ধক ও লালাস্রাবী–অর্থাৎ পরিপাক কার্যেও সহায়ক৷ শোজনেতে যে সকল ভাল ভাল গুণ রয়েছে, নাজনেতেও সেই গুণগুলোর সবক’টিই রয়েছে–ঈষৎ অল্প মাত্রায়৷ তাই নাজনেও একটি সুখাদ্য৷ তোমরা শীতের সময় সুযোগ পেলেই শোজনে ব্যবহার করো৷ অন্য সময়ও মধ্যে মধ্যে নাজনে খেও৷ এতে যকৃত, মূত্রাশয়, রক্ত ও চর্ম ভাল থাকবে৷
শোজনে মূলের ছাল ঃ শোজনে মূলের ছাল জিহ্বার আড়ষ্টতা দূর করে৷
শোজনে গাছের ছাল ঃ শোজনে গাছের ছাল কন্ঠস্বরকে মধুর করে৷
শোজনের ফুল ঃ শোজনের ফুল পরিমিত হিসেবে খেলে অগ্ণ্যাশয়ের কাজে সাহায্য করে ঙ্ম শোজনে ফুল খাওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় হ’ল বড়া বা চচ্চড়ী রেঁধে খাওয়া৷ শোজনে ফুলের ঝোল তৈরী করলে তাতে তিক্ততা ও কষাভাব বেশী থাকবেই, তাই এই ভোজন খুব সুখকর হয় না৷
শোজনের ডাঁটা ও বীজ ঃ শোজনের ডাঁটা দন্তমূলের (মাড়ি) শক্তিবর্দ্ধক৷ শোজনের ডাঁটা একটি সুলভ উচ্চমানের প্রোটিন৷ শোজনে বীজের বিষক্রিয়া যথেষ্ট ও অনেক ব্যাধির বিষকে নষ্ট করে দেয়৷ তাই শোজনের বীজকে গরাত্মক বলা হয়৷ শোজনের ডাঁটা চিবোবার সময় এমন ভাবে চিবোবে যাতে তার মধ্যস্থিত বীজটিও ভাল ভাবে চর্বিত হয়ে উদরসাৎ হতে পারে৷
শোজনের ক্কাথ ঃ শোজনের ক্কাথ (পাতা ও ডাঁটার ঘন ঝোল বা সুরুয়া বা নির্যাস) জীবনীশক্তি–বর্দ্ধক্ রূপে প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত । প্রথম পাতে শোজনে পাতার ঝোল, ডিস্পেপসিয়া বা অজীর্ণ রোগেরও ঔষধ কাঁচা শোজনে পাতার রস এক চামচ ভোরে খালি পেটে কয়েক দিন খেলে যকৃত ও অগ্ণ্যাশয়ের কাজে সহায়ক হয়৷
শোজনে বীজের তেল ঃ শোজনের পাকা ডাঁটার বীজ থেকে যে তেল পাওয়া যায় সেই তৈল নানান চর্মরোগের ঔষধ৷
অন্যান্য ব্যবহার ঃ কম বয়সের ছেলেমেয়েদের যখন বয়ঃব্রণ বা মুখ–ব্রণ হয়, সে সময় পরিমিত মাত্রায় শোজনের ফুল, ছাল, পাতা, ডাঁটা, বীজ যে কোন একটি খেলে ব্রণের প্রকোপ প্রশমিত হয়৷ শোজনের মূল, পাতা, ফুল ও ডাঁটা বসন্তরোগের (গুটিকা) প্রতিষেধক৷
শোজনে ও মুগা রেশম ঃ হেমন্তের শেষে শোজনে গাছে প্রচুর পরিমাণে শুককীট ন্তুত্রব্ধন্দ্বব্জ হ্মন্প্তপ্ত্ত্রব্জগ্গ দেখা যায়৷ এদের থেকে উন্নত মানের অ–তুঁত রেশম প্সু–প্পব্ভপ্তত্ব্ন্দ্বব্ ব্দন্প্তন্সগ্গ তৈরী করা হয়৷ এই শোজনে পাতা খাওয়া শুককীটের দ্বারা যে অ–তঁুত রেশম তৈরী হয় তাকে মুঙ্গা বা মুগা বলা হয়৷ শোজনে বা শোভাঞ্জনের অন্য নাম মুদগক৷ তার থেকে মুংগা/মুঙ্গা শব্দ আসছে৷ শোজনে গাছের পাতার মাদকতায় মুগা–রেশমের প্রজাপতি এতেই ডিম পাড়ে৷ বাচ্চারা যখন শোঁ–পোকা হয়ে জন্মায় তখন ওই গাছের কাছাকাছি জায়গায় যায় কার সাধ্যি এই শোঁ পোকারাই শেষ পর্যন্ত মুগা রেশমের গুঁটি বাঁধে৷
এই মুংগা বা মুগা শিল্প প্রাচীনকালে অসমে বেশ উন্নতি লাভ করেছিল৷ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শোজনে চাষ করে বাংলায় প্রচুর পরিমাণে মুগা রেশম প্রস্তুত করা যায়৷ এমন কি এদিকে একটু বেশী নজর দিলে সমগ্র বাংলার বস্ত্রের প্রয়োজন এক মুগা রেশমেই মিটিয়ে দেওয়া যায়৷ একটু চেষ্টা আর একটু আন্তরিকতা থাকলে আজ যাদের দরিদ্র কর্ষক বলছি তাদেরও মুগা বস্ত্র (রেশম) পরাতে পারি৷ রাঢ়ের টাঁড় জমি যা অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকে তাতে শোভাঞ্জনের চাষ করে মুগার উৎপাদন ক্ষাড়ানো আদৌ অসম্ভব নয়৷
(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)