শ্রাদ্ধে চ ভুরিভোজনম্

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংস্কৃতে শ্রৎ  ধা  অণ্ ঞ্চ শ্রাদ্ধ৷ ‘শ্রৎ’ শব্দের অর্থ হ’ল যা সত্য ও তৎসহ যা সত্য রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ ‘‘শ্রদ্ধা’’ শব্দের অর্থ হ’ল সত্যরূপে যাকে স্বীকৃতি দিয়ে তার প্রতি নিষ্ঠা সহকারে যে চলছে বুঝতে হবে সে শ্রদ্ধাকে জাগিয়ে তুলেছে৷ শ্রদ্ধয়া ক্রিয়তে অথবা শ্রদ্ধয়া দীয়তে ইত্যর্থে ‘শ্রাদ্ধ’৷ যে বস্তু শ্রদ্ধার সঙ্গে  দেওয়া হয় অথবা যে বস্তু শ্রদ্ধার সঙ্গে করা হয় তা–ই ‘‘শ্রাদ্ধ’’৷ প্রাচীনকালে মানুষ বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর জন্যে ভোজ্য ও ব্যবহার্য অন্যান্য বস্তু নিবেদন করত৷ জিনিসটাকে তারা বলত ‘শ্রাদ্ধ’৷ তারা ভাবত ওই সকল স্থূল বস্তু মৃতের ব্যবহারে লাগবে যদিও ধারণাটা ছিল ভুল, কারণ তাদের দেওয়া জল, সুরা, মধু, তণ্ডুল মৃতের কোন কাজেই লাগবে না....মরা গোরু ঘাস খায় না কিন্তু তার আত্মীয়েরা তখন ভাবত মৃত বুঝি তা’ খাবে৷

সুপ্রাচীনকালে মৃতদেহ দাহ করার প্রথা ছিল না–সমাধিস্থ করা হত৷ পরবর্ত্তীকালে সমাধি দেওয়ার চেয়ে দাহ করাই অধিক বিজ্ঞানসম্মত বিবেচিত হত৷ দাহ করার প্রথা প্রবর্ত্তিত হয় একাধিক কারণে৷ সেই কারণগুলির একটি হচ্ছে, মৃতদেহগুলির সমাধি যদি স্থায়ী বা পাকা ভাবে প্রস্তুত করা হয় তবে তা অনেকখানি স্থান দখল করে রাখবে দীর্ঘকালের জন্যে৷ একবার চীন গিয়ে দেখে এসেছিলুম মাটিতে স্থানাভাব ঘটায় মৃতদেহ পাহাড়ে সমাধিস্থ রয়েছে৷ সমাধি কাঁচা হলেও তা সাত–আট বছর ভূমি দখল করে রাখে কারণ শরীরের সমস্ত অস্থি মাটিতে মিশে যেতে আট বছর সময় লাগবে৷ দ্বিতীয়ত, মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হলে তাতে নিকটবর্ত্তী স্থানের ভূনিম্নস্থ জল দূষিত হতে পারে–তাতে রোগ ছড়াতে পারে৷ তৃতীয়তঃ মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা হলে দুষ্ট মানুষেরা অথবা শেয়াল–কুকুরেরা মাটি খুঁড়ে সেই মৃতদেহ তুলে নিতে পারে৷ অনেক সময় দেখাও যায় যে শেয়াল–কুকুরেরা মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ বার করে খাচ্ছে–বিশেষ করে শিশুর মৃতদেহ৷ যাঁরা দার্শনিক ভাবাপন্ন তাঁরা এর সঙ্গে আরও যোগ করে দিয়ে বলেন যে সমাধিতে থাকা মানে মাটির বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া৷ ভারতে অনুমিত হয় চার হাজার বৎসর ধরে শবদাহ–ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে৷ ঋগ্বেদের যুগে সমাধিস্থ করাই রীবাজ ছিল৷ ভারতের প্রাচীন বাসিন্দাদের মধ্যেও সমাধিস্থ করবার প্রথা প্রচলিত ছিল ও আজও কিছু কিছু জনগোষ্ঠীতে এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে৷ মিশরের সমাধি–স্থানগুলিতে (পিরামিড) মৃতদেহের সঙ্গে উত্তম মানের বস্ত্র, মদ্য, যব বা ভুট্টা পাওয়া গেছে৷ অবশ্যই মৃতের আত্মীয়েরা মৃতের ব্যবহারে লাগবে বলে ওগুলো তার সঙ্গে রেখে দিয়েছিল৷

প্রাচীনকালে সমস্ত মৃতদেহকেই সমাধিস্থ করার প্রথা প্রচলিত ছিল৷ পরবর্ত্তীকালে যখন দাহ–প্রথা প্রবর্ত্তন করা হয় তখন পাঁচ বৎসরের অনধিক বয়সের শিশুদের সমাধিস্থ করবার প্রথা প্রচলিত থেকে যায়৷ তবে তাদের ক্ষেত্রে শ্রাদ্ধ ব্যবস্থা থাকে না৷ পাঁচ ও পাঁচের অধিক বয়সের শিশুদের দাহ করার প্রথা প্রবর্ত্তিত হয় ও তাদের শ্রাদ্ধ–ব্যবস্থাও প্রচলিত হয়৷

দুই ভাই ছিলেন৷ উমেশচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ–তিনি ছিলেন বড় ভাই, স্মৃতিশাস্ত্রে (Social code) পণ্ডিত৷ ছোট ভাই ছিলেন রমেশ ন্যায়রত্ন তিনি ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত৷

একবার বড় ভাই উমেশ স্মৃতিতীর্থ গেছেন দূরবর্ত্তী কোন একটি স্থানে শিষ্য বাড়ীতে দান–দক্ষিণা প্রাপ্তির আশায়৷ বাড়ীতে রয়েছেন ছোট ভাই৷ নানান মানুষে নানান সামাজিক ক্রিয়াকর্মের প্রয়োজনে নিজের ও আশপাশের গ্রামের লোকের প্রয়োজনে প্রায়ই উমেশ পণ্ডিতের কাছে আসতেন, বিধান নিতেন ও দক্ষিণাও দিয়ে চলে যেতেন৷ এতে উমেশ পণ্ডিতের দিন–কাল মন্দ চলত না৷ শ্রাদ্ধের ঘৃত–তণ্ডূল তো ছিলই, অধিকন্তু ছিল কারণে অকারণে রকমারি ধরণের সিধা (না–রাঁধা ভোজ্য)৷ এছাড়া অন্নপ্রাশনে, বিবাহে রকমারি ভোজ্য ও তৎসহ ছাঁদা (‘ছন্দবদ্ধ’ থেকে বাংলায় ‘ছাঁদাবাঁধা’) তো ছিলই তা ছাড়া কারও গৃহে কারও মৃত্যু হলে তিনি তার ডান–কাণে বাঁ–কাণে অস্ফূট স্বরে (ফিস্ ফিস্ করে) বলতেন–‘শ্রাদ্ধে চ ভুরিভোজনম্’ অর্থাৎ তোমার বাপ–মায়ের শ্রাদ্ধে যদি উদর–পূর্ত্তি করে (‘ভুরি’ শব্দের লোকার্থ হচ্ছে উদরপূর্ত্তি আর প্রজ্ঞার্থ হচ্ছে মানসিক তৃপ্তি) খাওয়াও অর্থাৎ ভুরিভোজন করাও তাহলে তোমারও ঐহিক–পারত্রিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়ে রইল, আর যিনি মারা গেছেন তাঁর কল্যাণ তো হবেই৷ আর তুমি যদি উদর–পূর্ত্তি করে না খাওয়াও, কার্পণ্য কর অথবা দেনাকর্জ করবার জন্যে হাত পাতার সুযোগ পেয়েও যদি দেনাকর্জ করে ভুরিভোজন না করালে মৃতের নরক–গমন তো অনিবার্য বটেই, তোমারও নরক গমন অনিবার্য৷ আরে বাবা সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে মা–বাপ তো বারে বারে মরবে না, একবারই মরবে৷ তাই শ্রাদ্ধটা করিয়েই নাও না, ভুরিভোজন করিয়েই দাও না, ক্ষতিটা কী দেনা না হয় একবার করলেই৷ তাঁর যুক্তির সারবত্তা সবাই মানত৷

তিনি আরও বিধান দিতেন যে দই খেলে যদি সপসপ শব্দ না হয় তাহলে বুঝবে দইয়ের ভুরিভোজন হয়নি আর পায়েস খাবার সময় যদি হাপুশ হুপুস ধ্বনি উত্থিত না হয় তাহলে বুঝবে নিমন্ত্রিতেরা অর্ধভুক্ত হয়ে রয়েছেন.....তাঁরা ভুরিভোজনে তৃপ্ত হননি৷ তাই প্রাচীনকালে অনেক ভেবে চিন্তে মুনি–ঋষিরা ব্যবস্থা দিয়েছিলেন–শ্রাদ্ধে চ ভুরিভোজনম্৷ বুঝলে হে আজকালকার ছেলেছোকরা তোমরা এসব ধর্ম–কর্ম মানতে চাও না কিন্তু যখন নরকে যাবে, যমরাজ শূলে চড়াবেন তখন বুঝবে এই স্মৃতিতীর্থ যা বলেছিল তার দাম কতখানি........গরীবের কথা বাসি হলেই লোকে মানে......টাটকা মানতে চায় না৷ এটাই পৃথিবীর দশম আশ্চর্য৷

ছোট ভাই রমেশের তেমন কোন বাড়তি আয় ছিল না৷ অতি কষ্টে তাঁর দিন চলে যেত৷ সময় না কাটলেই নয়, তাই কেটে যায় কিন্তু তা ধরিত্রীপৃষ্ঠে কোন রেখাপাত করে না৷ তিনি ন্যয়রত্ন৷ নৈয়ায়িক পণ্ডিতেরা তাঁর কাছে আসেন.....তর্কে বসেন আর চরু–নস্যির শ্রাদ্ধ করে চলে যান৷ সত্যিই তাঁর কী দুর্ভাগ্য৷

যেদিন বড় ভাই উমেশ স্মৃতিতীর্থ দূর গ্রামে গেছলেন সেইদিনই তাঁর নিজের গ্রামে একটি ধনী পরিবারের একটি শিশুর মৃত্যু হয়৷ শিশুর আত্মীয়রা উমেশ পণ্ডিতের দ্বারস্থ হলেন বিধান নিতে–ওই শিশুর মৃতদেহ দাহ করা হবে না সমাধিস্থ করা হবে তা জানতে৷ উমেশ পণ্ডিত বাড়ীতে না থাকায় ছোট ভাই রমেশের সামনে শিশুর আত্মীয়েরা এসে দাঁড়ালেন৷ তাঁরা বললেন–পণ্ডিত মশায়, আমাদের যে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে তার বয়স পাঁচ বছর৷ আপনি বিধান দিন, শাস্ত্রমতে একে পোড়ানো হবে না সমাধিস্থ করা হবে৷

রমেশ প্রমাদ গুণলেন৷ ভেবেছিলেন কিছু দান–দক্ষিণা, কিছু ভোজ্য–সিধা পাবেন৷ তার বদলে তাঁর সামনে ছোড়া হ’ল কিনা একটি অগ্ণিবাণ যার প্রত্যায়ূধ তার জানা নেই৷

তিনি লোক–দেখানো খানিকক্ষণ বিভিন্ন শাস্ত্রের পাতা ওল্টালেন৷ বললেন–আমি যা দেখছি শিশুটির বয়স যখন ঠিক পাঁচ বছর তখন ওকে সমাধিস্থ করা উচিত৷

মৃতের আত্মীয়েরা চলে গেলেন মৃতদেহকে মাটিতে পুঁতে দিতে৷

পরের দিন যখন বড় ভাই উমেশ পণ্ডিত ঘরে ফিরে এলেন তখন রমেশ বললে–দাদা, মৃতের বয়স যদি ঠিক পাঁচ বছর হয় তাহলে কী করতে হয়? পাঁচের কম হলে সমাধিস্থ করতে হয় তা আমি জানি৷ পাঁচের বেশী হলে তার দাহক্রিয়া হবে এটাও জানি, কিন্তু বয়স যদি একেবারে চাঁচাঁছোলা পাঁচ বছর হয় তখন কী করতে হবে?

উমেশ পণ্ডিত বললেন–বিধিটা হচ্ছে মৃতের বয়স পাঁচের কম হলে পুঁততে হবে কিন্তু পাঁচ বা ততোহধিক হলে তাকে পোড়াতে হবে৷

রমেশ বললে–দাদা, এসম্বন্ধে আমরা রীতিমত সন্দেহ ছিল৷ তাই আমি কোন ঝুঁকি (রিস্ক) না নিয়েই প্রশ্ণকর্তাদের বলেদিয়েছি–পাঁচ বছর হলেই পুঁততে হয়, তার বেশী হলে পোড়াতে হয়৷

উমেশ পণ্ডিত বললেন–এরকম কেন বলেছিস রে

রমেশ বললে–ভেবেছিলুম, তুমি আসার পরে যদি শুনি পুঁততে হয় তাহলে আমি তো ঠিক নির্দেশই দিয়েছি–কিন্তু তুমি আসার পর যদি বল মৃতদেহ পোড়াতে হয় তাহলে মৃতদেহকে সমাধি থেকে তুলে অনায়াসে পোড়ানো যাবে৷ আমি যদি না জেনে বলতুম পোড়াতে হয় আর তুমি যদি বলতে পুঁততে হয় আর ওরা যদি পুড়িয়েই ফেলত তাহলে মৃতদেহকে পুঁতবার জন্যে আর পেতুম না৷ তাই আমি কোন ঝুঁকি না নিয়ে পুঁততেই বলে দিয়েছি৷

উমেশ পণ্ডিত বললেন–হ্যাঁ, ন্যায়রত্ন বলে তোর স্মৃতি শাস্ত্রের জ্ঞান যে কোন স্মার্ত্তের চেয়েও বেশী৷ এই ভাবে চালাকি না করলে স্মার্ত্তেরা কোন কালেও হালে পানী পেত না৷ আমি লাখ লাখ বার তোর বুদ্ধির প্রশংসা করছি৷ আর দেখ রমেশ, মৃতের আত্মীয়দের দেখা হলে বলবি–ওগো তাড়াতাড়িতে শাস্ত্রের একটা পাতা দেখা হয়নি৷ ওতে সংস্কৃতে লেখা আছে মৃতের বয়স যদি পাঁচ বছর পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে তাকে পোড়াতেই হয়৷ যাই হোক তোমরা মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ তুলে এনে যথাবিধি দাহ করে দিও৷ আর হ্যাঁ, শাস্ত্রে আছে যদি কাউকে দাহ করা উচিত ছিল কিন্তু তাকে ভূলবশতঃ পোঁতা হয়ে গেছে তাকে মাটি থেকে তুলে আনবার সময় স্মার্ত্তের বিশেষ অনুমতি নিতে হবে৷ আর যে সময় দান–সাগর শাস্ত্রের সমান বড় রকমের একটা শ্রাদ্ধও করতে হবে৷ তবে তোমরা সেই শ্রাদ্ধটা বড় করে করবে না ছোট করে করবে তা তোমরাই মৃতের কল্যাণের কথা বুঝে ঠিক করো৷ তবে যদি বড় রকমের শ্রাদ্ধ কর আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি আর যদি নমোনমো করে কোনও রকমে শ্রাদ্ধটা সারো তাহলেও আমরা পেছিয়ে থাকব না৷

যাই হোক, মৃতের আত্মীয়েরা ছিল বড় রকমের ধনী৷ তাঁরা কী ধরণের শ্রাদ্ধ করেছিল আমার ঠিক তা জানা নেই৷ তোমরা গিয়ে মৃতের আত্মীয়দের জিজ্ঞেস করে দেখতে পার৷