স্থূলতা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

লক্ষণ ঃ মানুষের শরীরের পক্ষে মেদ একটি অত্যাবশ্যক ধাতু৷ মেদ না থাকলে অস্থি ও মাংসের স্বাভাবিক ক্রিয়াশীলতা এই মুহূর্ত্ত অব্যাহত থাকতে পারে না৷ কিন্তু এই মেদ যখন প্রয়োজনের মাত্রা ছাড়িয়ে বৃদ্ধি পায়, তখন তার ফলে সমস্ত শরীর যন্ত্রই অপটু হয়ে পড়ে৷ এই অবস্থার নাম মেদবৃদ্ধি বা স্থূলতা৷

কারণ ঃ শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ও তৎসহ দধি, দুগ্ধ, মাখনাদি, পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাচুর্য, মিষ্ট খাদ্যের প্রাচুর্য্য, অধিক পরিমাণে শ্লেষ্মাবর্ধক খাদ্যের (মৎস্য, তেঁতুল প্রভৃতি) ব্যবহার প্রভূতি এই রোগের প্রধান কারণ৷ বিশেষ করে উপরিউক্ত কারণগুলির সঙ্গে ব্যষ্টিবিশেষের মানসিক পরিশ্রমের আধিক্য থাকলে রোগী অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থূলকায় হয়ে পড়ে৷

আমিষ খাদ্য, পুষ্টিকর খাদ্য ও ঘৃত–দুগ্ধাদির প্রয়োজন যারা শারীরিক পরিশ্রম করে তাদের পক্ষেই বেশী৷ যারা মানসিক পরিশ্রম বেশী করে কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম কম করে তাদের পক্ষে আমিষ, শর্করা জাতীয় ও চর্বি জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন অল্প৷ কিন্তু ভোগী মানুষ রসনার তৃপ্তির জন্যে যে খাদ্য তার পক্ষে অপ্রয়োজনীয় বা অল্প–প্রয়োজনীয় সেগুলিও অধিক পরিমাণে ব্যবহার করে৷ আজকের পৃথিবীতে মানুষের অধিকাংশ সম্পদ অল্পসংখ্যক পরিশ্রমবিমুখ বুদ্ধিজীবীর কুক্ষিগত৷ তাই আমিষ, ঘৃত, মাখন, মিষ্টান্ন প্রভৃতি অপক্ষাকৃত মহার্ঘ খাদ্যবস্তুসমূহ তারাই ক্রয় করতে পারে ও রসনার তৃপ্তির জন্যে তারাই সেগুলি ব্যবহার করে৷ এর ফলে এক দিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় মেদে তাদের শরীর স্ফীত হয়ে উঠে অন্য দিকে তেমনি নিঃস্ব হূতসর্বস্ব পরিশ্রমী মানুষেরা তাদের শরীর রক্ষার পক্ষে প্রয়োজনীয় ঘৃত মাখন, মিষ্টান্নাদি থেকে বঞ্চিত হয় ও শরীরের ক্ষয়–ক্ষতি যথোপযুক্তভাবে পূরণ না হওয়ায় দুর্বল, কৃশকায়, ভগ্ণস্বাস্থ্য হয়ে পড়ে৷ পুষ্টির অভাবে ও অতি পরিশ্রমে তাদের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ দেখা দেয়৷ মনে রাখা দরকার গ্রীষ্মপ্রধান দেশের পক্ষে আমিষ খাদ্য বিষবৎ৷ তবু যারা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করে তারা যদি অল্প পরিমাণ আমিষ খাদ্য গ্রহণ করে সেটা তাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর তো হয়ই না, মনের উপরও তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না৷

তাই বলছিলুম স্থূলতা রোগটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বচ্ছল, পরিশ্রমবিমুখ সমাজের রোগ৷ অফিসার বা উচ্চ বেতনভোগী কর্মচারী, স্বচ্ছল ব্যবসায়ী ও পরপিণ্ডভোজী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এই ব্যাধির প্রকোপ বেশি করে দেখা যায়৷

মনে রাখা দরকার, মানবদেহে সঞ্চিত মেদ তার কর্মশক্তির নিদ্রিত অবস্থা মাত্র৷ উপবাস ও পারিশ্রমে ওই মেদই দগ্ধ হয়ে প্রাণশক্তি বা কর্মশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে’ যায়৷ তাই যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করে, মেদ তাদের শত্রুর রূপ ধারণ করে ও অপমৃত্যুর কারণ হয়৷ এই মেদ তলপেটে জমে নারীর বন্ধ্যাত্ব ও পুরুষের যৌন অক্ষমতার কারণ হয়৷ তাই স্থূলকায় ব্যষ্টিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিঃসন্তান হয়৷ বক্ষে ও উদরে অতিরিক্ত মেদ জমে বায়ুর আক্ষেপ সৃষ্টি হয় ও তার ফলে যকৃৎ যতদিন না আক্রান্ত হয় ততদিন মেদরোগীর থাকে রাক্ষুসে ক্ষুধা, নিমন্ত্রণ বাড়ীতে তারাই হয় নামী নামী ঔদরিক৷ আর লক্ষণীয় বিষয় এই যে যে সকল খাদ্যে মেদ বৃদ্ধি পায় সেই সকল খাদ্যের দিকেই এদের লোভ থাকে বেশী অর্থাৎ যজ্ঞবাড়ীতে গিয়ে এরা ভুলেও তরিতরকারী বেশী খায় না, বেশী খায় লুচি, মাছ, মাংস ও মিষ্টান্ন৷ পরে যৌবনের শেষের দিকে যকৃৎ যখন দুর্বল হ’য়ে পড়ে এদের ঔদরিকতারও নিবৃত্তি ঘটে৷ লোকের কাছে এরা তখন দুঃখ করে’ বলে, ‘‘আর ভাই তেমন খেতে পারি না’’৷ শরীরের মাংসপেশী তখন শিথিল হয়ে’ ঝুলে পড়ে৷ অম্লরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য বা কোন আন্ত্রিকরোগ রোগীর দেহে ফুটে’ উঠে৷ মেদ বক্ষস্থলে অধিক পরিমাণে সৃষ্ট হলে হূৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কার্যধারা ব্যাহত হয়, রোগী শ্বাস–প্রশ্বাসে কষ্ট অনুভব করে, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, হাঁসফাঁস করে, ঘর্মাক্ত কলেবরে বেবস’ পড়ে৷ রক্তবহা নাড়ীর মধ্যে এই মেদ জমলে রক্তচাপ বৃদ্ধি রোগ দেখা দেয়৷ পরিণামস্বরূপ, হূৎপিণ্ডের চাপে শিরা ছিঁড়ে’ মস্তিষ্কের বা দেহের অন্য স্থানে আভ্যন্তরীণ রক্তরণের ফলে রোগীর মৃত্যু হয় বা পক্ষবধ রোগ দেখা দেয়৷

অতিরিক্ত স্থূলতার দরুণ প্রাণবায়ু বা যকৃতে কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, কোষ্ঠবদ্ধতা, ধাতুরোগ, ঋতুরোগ ও নানান ধরণের আন্ত্রিক রোগ সৃষ্টি হয়৷

চিকিৎসা ঃ প্রথম পর্যায়ে–

                প্রত্যুষে ঃ উৎক্ষেপ মুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, যোগমুদ্রা ও ভুজঙ্গাসন৷

                সন্ধ্যায় ঃ ভুজঙ্গাসন, পশ্চিমোত্তানাসন ও শলভাসন৷

প্রথম পর্যায়ের আসন–মুদ্রাগুলি কতকটা অভ্যস্থ হয়ে’ যাবার পরে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে৷

দ্বিতীয় পর্যায়ে–

                প্রত্যুষে ঃ উৎক্ষেপমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, যোগমুদ্রা, ভুজঙ্গাসন, পদহস্তাসন৷

                সন্ধ্যায় ঃ মৎস্যমুদ্রা, নৌকাসন, পশ্চিমোত্তানাসন ও মৎস্যেন্দ্রাসন৷

দ্বিতীয় পর্যায়ের আসন মুদ্রাগুলি কতকটা অভ্যস্ত হয়ে যাবার পরে তৃতীয় পর্যায় শুরু হবে৷

তৃতীয় পর্যায়–

                প্রত্যুষে ঃ উৎক্ষেপমুদ্রা, দীর্ঘপ্রাণায়াম, ভুজঙ্গাসন, কর্মাসন, গরুড় মুদ্রা৷

                সন্ধ্যায় ঃ নৌকাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, মৎস্যেন্দ্রাসন ও কূর্মকাসন৷

পথ্য ঃ অনেকে মেদরোগীর আহার কমিয়ে দেবার পক্ষপাতী, ভাবেন তাতেই বুঝি রোগীর মেদমুক্তি হয়ে যাবে৷ এ ধারণা ঠিক নয় কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আহার কমাবার ফলে রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে এমনকি তারা উঠ্বার, হাঁটবার শক্তি হারিয়ে ফেলে৷ রোগীর জন্যে প্রয়োজন সুনির্বাচিত সাদাসিদে খাদ্য যেমন–

১) জল যথেষ্ট পরিমাণে পান করা যেতে পারে (আন্দাজ ৪/৫ সের, তবে এক সঙ্গে অধিক নয়) কিন্তু সম্ভবমত সর্বক্ষেত্রে ওই জলের সঙ্গে নেবুর রস মিশিয়ে নিতে হবে৷

২) আমিষ খাদ্য, ঘৃত ও তৈলজাতীয় খাদ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে৷ কেবল পাতলা দুধ একটু একটু করে’ অনেক বারে গোটা দিনে তিন পোয়া/এক সের পান করা যেতে পারে৷

৩) রোগীর ক্ষুধা অনুযায়ী সব রকমের ফলই যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করা যেতে পারে, বিশেষ করে রসাল টক ফল রোগীর পক্ষে অত্যন্ত হিতকর৷

৪) ভাত–রুটি–ডালের মাত্রা কমিয়ে বা বন্ধ করে’ সবুজ তরিতরকারী ও ঝোলের পরিমাণ বাড়াতে হবে৷

৫) চীনী বা গুড়ের ব্যবহার কমিয়ে অল্প পরিমাণে মধু ব্যবহার করা যেতে পারে৷ মধুও দৈনিক তিন চামচের অধিক নয়৷ বিধিনিষেধ ঃ উপবাস বিধি, আতপস্নান বিধি রোগীকে মেনে চলতে হবে৷ সাধারণতঃ এটি পরিশ্রমবিমুখ ও ভোজনবিলাসীদের রোগ৷ তাই যতদূর সম্ভব সাদাসিদে ভোজ্য গ্রহণ করতে হবে৷ লুচি, পুরীর পরিবর্তে শুষ্ক্ রুটি খেতে হবে ও বসে বসে ফরমাইস করার অভ্যাস ত্যাগ করে’ হাতে–পায়ে গায়ে–গতরে পরিশ্রম করতে হবে৷

উৎস

‘‘যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ’’