শুচিত্ব কি কেবল বিচার সর্বস্ব!

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আর জি কর কাণ্ডের বিচারের একটা পর্ব শেষ৷ এরপর উচ্চ আদালত আছে, শীর্ষ আদালত আছে৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জঘন্যতম অপরাধীরও ন্যায়বিচার চাওয়ার পাওয়ার অধিকার আছে৷ আরজিকরের অপরাধীরও সে অধিকার আছে৷ তাই নিম্ন আদালতের একটা রায় ঘোষণায় বিচার শেষ হয় না৷ বিচার চলবে, চলতে থাকুক৷

কিন্তু একটা মানবিক প্রশ্ণ যেটা সবাই এড়িয়ে যাচ্ছেন অথবা প্রশ্ণটার কথা ভাবার প্রয়োজনই মনে করেননি৷ এই নয় যে আরজিকরের জঘন্য ঘটনা সমাজে প্রথম ঘটলো৷ মাননীয় বিচারকও রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বলেছেন---আর জি করের ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়৷

আর জি করের মতো ঘটনা সমাজে আগেও অনেক ঘটেছে, অপরাধীর যত কঠোর সাজাই হোক, এই ধরনের ঘটনা আবারও ঘটবে৷ যারা অপরাধীর চরম দন্ড চেয়ে সরব হয়েছেন তারা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না আরজিকর কান্ডের অপরাধীর চরম দন্ড সমাজ থেকে এই পাপ নির্মূল করবে৷ একথা বলার অর্থ এই নয় যে, সমাজে আইন আদালতের প্রয়োজন নেই৷ সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন আদালতের প্রয়োজন অবশ্যই আছে৷ কিন্তু সমাজের শুচিত্ব বজায় রাখা আইন আদালতের কাজ নয়৷ তাছাড়া বিচার সব সময় নির্ভুল হয় না৷ মানুষের সীমাবদ্ধ বুদ্ধির দৌড় নিয়ে সব সময় নির্ভুল বিচার করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু যেটা দেখা উচিত তা হলো বিচার যেন প্রতিশোধ মূলক না হয়, একজন নিরাপরাধও যেন শাস্তি না পায়৷ চরম দন্ড চাওয়ার মধ্যে কতকটা প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করে৷ বিচারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সংশোধনমূলক৷ মানবিকতার দৃষ্টিতে অপরাধীকে, সে যত বড় অপরাধী হোক সংশোধনের একটা সুযোগ দেয়া উচিত৷

এখন যে মানবিক প্রশ্ণটা কেউ ভাবছেন না, অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন---তা হল মানুষ কেন এই ধরনের জঘন্য অপরাধ করছে? এই ধরনের অপরাধ ঘটলেই প্রথমেই শুরু হয়ে যায় অপরাধীর পরিচয় খোঁজা৷ সে কোন দলের, কোন গোষ্ঠীর,কোন সম্প্রদায়ের, কোন জাতির ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কেউ একবারও ভাবে না সেও একজন মানুষ৷ মানুষ কেন এই জঘন্য অপরাধ করছে? সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বিপদ জীবের এই অধঃপতন কেন?

মহান দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘যুক্তির রাজত্ব’ রচনায় বলেছেন---‘সকল মানুষের জীবনেই রয়েছে কতকগুলি সাধারণ ও সহজাত বৃত্তি৷ স্বভাবগতভাবে তাদের কেউ কেউ হয়তো মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়, কেউবা নিয়ে যায় অবনতির দিকে৷ যে বৃত্তি মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায় তাকে আমাদের উৎসাহ প্রদান করা উচিত৷ আর যে বৃত্তি মানুষকে অবনতির পথে নিয়ে যায় তাকে নিরুৎসাহিত করা উচিত৷ এই পৃথিবীর কোথাও কোথাও মানুষকে ব্যাপক নগ্ণ চিত্র ও অশ্লীল সাহিত্যের মাধ্যমে নৈতিক অধোগতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷’

কাম মানুষের সেই রকমই একটি বৃত্তি৷ যা একদিকে জীবজগতের সৃষ্টির ধারা বজায় রাখে, আবার যার অসংযত ব্যবহার সমাজের শুচিত্ব নষ্ট করে৷ একথা অস্বীকার করা যাবে না আজকের সমাজে মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক অধোগতির মূলে আছে এক ধরনের অশ্লীল নগ্ণ চলচ্চিত্র সঙ্গীত সাহিত্য৷ এই ধরনের হীন রুচির অসংস্কৃতি মানুষকে কামবৃত্তির অসংযত ব্যবহারে উৎসাহিত করছে৷ আনন্দমঠ,নীল দর্পণ, পথের দাবী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল, কারণ এই বইগুলি দেশপ্রেমিক তৈরি করতে উৎসাহ যুগিয়ে ছিল যুবসমাজের মধ্যে, তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই বইগুলি নিষিদ্ধ করেছিল৷ তাহলে আজকের বিপরীত ধর্মী নগ্ণ অশ্লীল সাহিত্য চলচ্চিত্র সেই যুবসমাজকে কি অধোগতির দিকে নিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে না?

আর জি করের অপরাধীর বিচার হবে সাজা হবে এটা সভ্য সমাজের রীতি৷ তাতে অপরাধীর যে সাজাই হোক না সমাজের শুচিত্ব ফিরবে না৷ এই ধরনের অপরাধ ও অপরাধীর চরমদণ্ডের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে৷ কিন্তু এমন একটা দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিচারক বলতে পারবেন যে আমি অপরাধীকে চরম দণ্ড দিয়ে সমাজের শুচিত্ব রক্ষা করেছি৷

এখন প্রশ্ণ তাহলে সমাজের শুচিত্ব বজায় রাখার পথ কি? এই প্রসঙ্গেই শ্রদ্ধেয় প্রভাত রঞ্জন সরকারের রচনা থেকেই বলি--- ‘মানুষের জীবনে শুধু রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলি সব কিছু নয়, তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে৷ এই আধ্যাত্মিকতাই জীবনের অন্যান্য দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷’

এই প্রসঙ্গে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন গ্রন্থের নববর্ষ রচনা থেকে বলি---’সাধনা করে তবে মানুষকে মানুষ হতে হয়---তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ৷’

এই প্রাণপণ চেষ্টাই আধ্যাত্মিকতা, এই প্রাণপণ চেষ্টাই যোগ সাধনা৷ বছরে একদিন কোন এক রাষ্ট্রপ্রধান ওপর দিকে ঠ্যাং তুলে যোগ দিবস পালন করে দিলেন তাতে যোগ সাধনা হলো না৷ এই যোগ সাধনা প্রতিটি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলনের বিষয়, যা ঘরের কোণে বসেই করা যায়৷ এর জন্য কোন স্বর্ণ ইটের মন্দিরের প্রয়োজন নেই৷

তাই আর জি কর কান্ডের অপরাধীর যে সাজাই হোক না, তাতে মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক অধোগতি রোধ করা যাবে না৷ আর জি কর কাণ্ডের মত অপরাধ সমাজে আবারও ঘটবে, তার বিচারও হয়তো হবে৷ কিন্তু সেটাই সব নয়৷ সমাজে এই ধরনের জঘন্য ঘটনার দায় আজকের এক শ্রেণীর কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা অস্বীকার করতে পারেন না৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যে অবদান, আজকের সমাজের এই অধোগতির পেছনেও আছে অশ্লীল নগ্ণ সাহিত্য চলচ্চিত্র সংগীতের অবদান৷ তাই আন্দোলন শুধু আর জি কর কান্ডের অপরাধীর বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন উঠুক অশ্লীল অসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, নগ্ণ হীন রুচির শিল্প সাহিত্য সংগীতের বিরুদ্ধে৷ মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যেতে, উন্নত চিন্তায় উৎসাহ দিতে সৃষ্টি করতে হবে নতুন সাহিত্য শিল্প সংগীত, দেখাতে হবে কুসংস্কার ও ভাব জড়তার জঞ্জাল মুক্ত আধ্যাত্মিকতার পথ৷ সমাজের শুচিত্ব রক্ষা করার এটাই হবে একমাত্র পথ৷