সুষ্ঠু অর্থনীতি ছাড়া মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয়

লেখক
জহরলাল সাহা

আজকের সারা দুনিয়া জুড়ে চলছে ---সভ্যতার সঙ্কট৷ সে সঙ্কট কোথায় নেই? শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই চলছে চরম সঙ্কট৷ আলোচনার  এ ক্ষুদ্র পরিসরে হয়তঃ সব সংকটের কথা বলা যাবে না৷ কিন্তু সবার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে যে সংকট যা সকল সংকটের মূল কারণ তা নিয়ে প্রথম আলোচনা করা উচিত বলে মনে করি৷

কথাটা এমন যে--- পেট্রোপণ্যের দাম বাড়লে গাড়ী ভাড়া বাড়ে, মালের আমদানী রপ্তানী খরচ বাড়ে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় আর একে একে সব ক্ষেত্রেই  তার প্রভাব পড়ে৷ ঠিক তেমনি সমাজজীবনের সব  কিছুতেই প্রভাব বিস্তার করে অর্থনীতি৷ সুষ্ঠ অর্থনীতি ছাড়া সব মানুষের জীবন-জীবিকা একেবারেই অচল৷ প্রথমতঃ রাজনীতি৷ রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়--- রাজনীতি মানে নীতির রাজা বা শ্রেষ্ঠ নীতি৷ ওই শ্রেষ্ঠনীতিতে গলদ থাকলে সমাজের সব ক্ষেত্রেই তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে  দেখা যায়৷

আজকের সমাজে সাধারণতঃ তিন প্রকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেখা যায়৷ যথা---(১) পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র৷ ধনতন্ত্র এসেছে-রাজতন্ত্রের পর৷ রাজতন্ত্রে কোন অর্থনীতি ছিল না৷ রাজার কথাই ছিল তখন আইন৷ কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে আসে নবজাগরণ বা রেনেসাঁ৷ এই রেণেসাঁর মূল কথা হলো--- মানুষ স্বাধীনতাভাবে জন্মেছে, তাকে স্বাধীনতাভাবেই বাঁচতে দিতে হবে৷ এই ভাবনায় রাজনীতিতে এল-সংসদীয় গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক গণতন্ত্র৷ এতে কালক্রমে এল টাকার খেলা, তারপর এল পেশীতন্ত্র---‘জোর যার মুলুক তার৷’ তারপর এল ভোটব্যাঙ্ক তৈরীর নানা কূটকৌশল--- সোজা বাংলায় যাকে বলা যায় মানুষে  মানুষে অহেতুক লড়াই লাগিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া৷ পৃথিবীর দু-চারটি দেশ ছাড়া আর সব জায়গাই চলছে এ ঘৃণ্য রাজনীতি যার ফলে মুষ্টিমেয় ধণিক শ্রেণী আর অগণিত অন্নহীন বস্ত্রহীন বাসস্থান হীনের জীবন যন্ত্রণা৷

দেশের অধিকাংশ মানুষের দুর্দশা দেখে ১৮৪৮ সালে কার্লমার্কস দিলেন মার্কসবাদ---১৮৬৪ সালে ডাস-ক্যাপিটেল গ্রন্থে প্রকাশ করলেন তাঁর পূর্ণাঙ্গ মতবাদ৷ এ মতবাদকে কমিউন-ইজমও বলা হয়৷ শোষণকে  উৎপাটনের জন্য এ মতবাদে পরিবার প্রথা, ব্যষ্টি স্বাধীনতা, মানুষের  মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিকের কথা শিকেয় তুলে বলা হয়---মানুষ ‘‘সাধ্যমত কাজ করবে আর প্রয়োজন মতো ভোগ করবে৷’’ এ নীতিকথা কি বাস্তবে সম্ভব?

কারণ মানুষ সুযোগ পেলে কম কাজ করবে আর যতবেশী পারে তত ভোগ করবে৷ বড় ডেয়ারী ফার্মের মত  বড় বড় কমিউন এর চিন্তা হলো--- যেখানে সবাই থাকবে  খাবে৷ মানুষ কি পশু? রাশিয়া ইত্যাদি দেশ ভেঙ্গে গেছে৷ ইউরোপে মার্কসবাদের সংশোধনী এনে যা করা হয়েছে তা ইউরো কমিউনিজম প্রচ্ছন্ন পুঁজিবাদ ছাড়া আর কিছু নয়৷ চীনে চলছে বকলমে স্বৈরতন্ত্র৷ ত্রিপুরায় ও পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন (৩০/৩৫ বছর) এক নাগাড়ে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার শাসন করেছে--- কিন্তু রাজ্য দুইটাতে বিষবৃক্ষ রোপন করে রেখে গেছে৷ দীর্ঘদিন এই দুইটা রাজ্যের মানুষকে তার কুফল ভুগতে হবে৷ কেরলের কথা জানি না৷ আসল ত্রুটিটা হলো সুষ্ঠু অর্থনীতি অভাব৷

১৯১৪-১৯ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল৷ ১৯৩৯-৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনবিক বোমায় জাপানের নাগাসাকি ও হিরোসিমাকে মরুভূমি বানিয়ে সারা পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে৷ মানুষ উর্দ্ধবাহু হয়েছে আর্তনাদ করছিল ---হে ভগবান, রক্ষা করো, থামাও যুদ্ধ--- আর নয়, আর নয়৷ ১৯৫৯ সালে এ যুগের পরিত্রাতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে অর্থনীতিবিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যুগোপযোগী বিজ্ঞানসম্মত অর্থনৈতিক দর্শন দিলেন---‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’ সংক্ষেপে প্রাউট৷ প্রাউট সকল প্রশ্ণের উত্তর, সকল হতাশার আশ্বাস৷ প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্র সমাজে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে৷

সংক্ষেপে প্রাউটের মূল কথা হলো--- ১৷ জগতের সকল  সম্পদের ১০০ শতাংশ উপযোগ নিতে হবে৷ তাতে ১০০ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান হবে৷ ফলে উৎপাদন বাড়বে, জিনিষের দাম কমবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে৷ ফলে সবার পারিবারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে৷ বলা বাহুল্য, আজকালকার  রাজনৈতিক দলগুলো বেকার সমস্যাকে জিয়িয়ে রাখে৷ নইলে, কে তাদের দল করবে?

২৷ মানুষে মানুষে ধর্মীয় মতামত,আহার, পোশাক ইত্যাদিতে কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই৷ সমাজে কেউ ক্রেতা আর কেউ বিক্রেতা৷ তাই প্রাউট চায়--- ‘‘ব্যষ্টিস্বার্থের সাথে সমষ্টি স্বার্থের সুষ্ঠু সমন্বয়৷’’ যা করতে পুঁজিবাদ ও মাকর্সবাদ উভয়েই ব্যর্থ হয়েছে৷

৩৷ সমাজে বা রাজ্যে অথবা দেশে প্রত্যেক মানুষের জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজনের গ্যারান্টি থাকতে হবে৷ বর্ত্তমানে এই নূ্যনতম প্রয়োজন হলো-৫৷ যথা---অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা৷ বর্ত্তমান রাজনৈতিক দলগুলো এতে ব্যর্থ হয়েছে৷

৪৷ প্রাউট বলে--- নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির পর অতিরিক্ত সম্পদ গুণ অনুপাতে বন্টন করে দিতে হবে৷ একজন পাথর ভাঙ্গা শ্রমিকের আহার্য্য আর একজন বিচারকের জীবনশৈলী এক হতে পারে না৷ সমাজে ‘তেল, ঘি একদর  হবে না৷’

বর্ত্তমানে কয়েকটা বড়ো রাস্তা, কয়েকটা পাকা বাড়ী নির্মানকে প্রগতি বলে৷ প্রাউটে প্রগতি বলতে  বুঝায় --- দেশের সবচেয়ে  গরীব লোকটা যে দিনে কোনপ্রকারে একবার আহার যোগাড় করে, রাতে রাস্তার পাশে শোয়ে এ অবস্থায় যদি দেশের বা রাজ্যের সবাই দুই বেলা পেট ভরে খেতে পায় আর নিজের কুঁড়ে ঘরে শুতে পায়--- তবে বুঝা যাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে৷

আলোচনার সংকীর্ণ পরিসরে হয়তঃ বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই৷ বারান্তরে প্রাউটের আরও নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে৷ প্রাউটের যুক্তিযুক্ত তত্ত্ব ও পদ্ধতি দেখে প্রবক্তা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীকে ৮ (আট) বছর  জেলে বন্দী করে, বিষ খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল৷ কিন্তু তাদের সবচেষ্টা বিফল হয়েছে৷ আনন্দমার্গ তথা প্রাউট পৃথিবীর প্রায় দুইশত দেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷

এখন কথা হলো--- সবার স্বার্থে প্রাউটের সুন্দর ব্যবস্থাগুলি প্রথমে জানা দরকার৷ তারপর প্রয়োগ করা দরকার৷ এতেই সকলের কল্যাণ৷ যতদিন যাবে ততই মানুষের কষ্ট বাড়বে৷

পরিশেষে অবশ্যই বলতে হয়--- শোষণমুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন ছাড়া অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আনা সম্ভব নয়৷ ঘাটতি অঞ্চলের মানুষ সবসময়ই কোন না কোন ভাবে শোষিত হতে থাকে৷ তাই প্রাউটের এ বিষয়টাকে যত দ্রুত বাস্তবায়িত করা যায় ততই মঙ্গল৷