আমি তখন রাঁচীতে থাকি...থাকি রাতু রোডের ধারেই একটা খোলামেলা ৰাংলো প্যাটার্ণের ৰাড়ীতে৷ ৰাড়ীর চারি পাশে ঘেরা একটি নাতিদীর্ঘ পাঁচিল৷ ভিতরে বাগান৷ বাড়ীর দরজা–জানলায় কাঠের ব্যবহার যতটা কাঁচেরও প্রায় ততটা৷
তখন নিশুতি রাত৷ ঘরের মধ্যে ঝন্ঝন্ ঝনাৎ শব্দ হ’ল৷ ঘুম তো ভাঙ্গৰেই....ভাঙ্গলও৷ দেখলুম একটি লোক আমার শোৰার ঘরের মাঝখানে৷ রঙ ফরসা..মুখ একটু লম্বাটে৷ কী যেন চায়৷
আমি ৰললুম– কে তুমি? কী চাও?
সে আবার কেমন যেন একটা আকুতি ভরা দৃষ্টিতে তাকাল৷ চোখ ৰন্ধ করলুম৷ চোখ খুলে দেখি কেউ নেই৷ ভোরৰেলায় দেখি জানলার সার্সি ভাঙ্গা৷ ঘরের আলমারিটার কাঁচগুলোও ভাঙ্গা৷ কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে ভেঙ্গেছে৷ ৰাড়ীর দেখাশোনা করার ভার যার ওপরে ছিল সে ৰললে–ৰাৰুজী, রাত্তিরে আমি নিজে মেন গেট ৰন্ধ করে দিয়েছি৷ ৰাড়ীর সমস্ত দরজা ৰন্ধ আছে কিনা দেখে নিয়েছিলুম৷ আপনার ঘরের জানালাগুলো বাইরের দিক থেকে খোলা যায়, সেগুলিও ৰন্ধ করে দিয়েছিলুম৷ তা সত্ত্বেও মাঝরাতে ঝন্ঝন্ ঝনাৎ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আপনার ঘরের দিকে এলুম৷ মনে হ’ল আপনার ঘর থেকে ছায়ার মত এক বা কয়েকজন বেরিয়ে গেল৷ যেতে যেতে শূন্যে মিলিয়ে গেল৷ ৰুঝলুম ঘরে কিছু অনর্থ হয়েছে৷ আপনার কুশল জানবার জন্য বাইরে থেকে ৰললুম–ৰাৰাজী, জেগে আছেন কি? আপনি ৰললেন–এইমাত্র ঘুম ভেঙ্গেছিল, আৰার ঘুম এসে গেছে৷ আমি ৰললুম–ৰাৰুজী, ঘুমোন ঘুমোন৷ আমি ৰুঝে গেলুম আপনি ভালই আছেন৷
আমি তাকে ৰললুম–এসে দেখ তো জানলা–আলমারির কাঁচ ভাঙ্গা৷ এ কী ব্যাপার আর কোন ঘরে এমনটা হয়েছে কি?
সে গোটা ৰাড়ীটা দেখে এসে ৰললে–না, আর কোথাও কিছু হয়নি৷ তৰে বাগানে সন্ধের সময় চেয়ার নিয়ে যে ৰেলফুলের গাছটার কাছে বসেন সেই গাছটা ওপড়ানো রয়েছে৷ তৰে গাছটাকে কেউ নিয়ে যায়নি৷ আমি গাছটাকে যথাস্থানে আবার লাগিয়ে দিয়েছি৷ ৰাড়ীর সকলেই ভাঙ্গা কাঁচের জানালা ও আলমারী দেখে হতবাক এ কী ৰ্যাপার
* * * *
গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি একটু খোলা হাওয়ায় বেড়াতে৷ প্রথমে যাৰ অফিসে৷ সেখানে কিছুক্ষণ কাজ সেরে তারপর খালি পায়ে হাঁটৰ৷ গেট থেকে বেরুবার পরেই ডানদিক থেকে দৌড়ে এল আমার যমুনা নামের গাইটা৷ শুনলুম রাত্তির থেকে সে অস্বাভাবিক৷ কী যেন দেখে পাঁচিলটার দিকে তাকাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে৷ আমাকে দেখে সে যেন কতকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে৷ কথা ৰলতে জানলে হয়তো সে অনেক কিছুই ৰলত৷
আরও একটু এগিয়ে রাতু রোড ছুঁচ্ছি এমন সময় দেখি এক ভদ্রলোক–রঙ মোটামুটি ফরসা....মুখটা লম্বা....গায়ে আধময়লা চাদর....হাতে একটা ছোট্ট হাতুড়ি....কামারের হাতুড়ি নয়, স্যাকরার হাতুড়ি৷ এ কী, এ যে অবাক কাণ্ড এ যে কাল রাত্তিরে দেখা সেই মানুষটি .....বয়স আন্দাজ ৩৫৷
আমি ৰললুম–কে আপনি?
সে ৰললে–আমার নাম শ্রীকান্ত মুখোপাধ্যায়৷
আমি ৰললুম–কী দরকার, কী কাজ আছে সে তার একটা বিশেষ দুঃখের কথা ৰললে৷ সে ৰললে–আমার অনেক দিনের ইচ্ছা আপনার সঙ্গে দেখা করি৷ কারণ আমি জানি আপনাকে দিয়ে আমার কাজ হৰে৷ আর কেউ তা পারৰে না৷ অনেক চেষ্টা করেছি দেখা করবার কিন্তু পারিনি৷ কখনও ভেবেছি গেট যখন খোলা থাকে তখন ভেতরে গিয়ে গ্যারেজের পাশে লুকিয়ে থাকৰ৷ তারপর সুবিধেমত আপনি যখন বাগানে বেড়াৰেন তখন দেখা করৰ, কিন্তু সে সুযোগও হয়নি৷ কারণ সর্বত্রই আমার অবস্থা হয়েছিল পাল ছেঁড়া নৌকোর মত৷ লেখাপড়া শিখেছি বি. এ. পর্যন্ত, একটা ইস্কুলে ইংরেজী পড়াতুম৷ মাস দুয়েক হ’ল চাকরী গেছে৷ নক্সার কাজ কিছু কিছু জানতুম৷ তাই একটা স্যাকরার দোকানে কারিগরের কাজ জুটিয়ে নিয়েছি৷ অতিকষ্টে দিন চলছে৷ কাল রাত্তিরে নিজের ঘরের মধ্যে কেবল পাগলের মত ছটফট করেছি৷ ভেবেছি কোনক্রমে যদি আপনার ৰাড়ীর পাঁচিল টপকাতে পারি আপনার কাঁচের জানালা আমি যদি এই হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারি তবে ভেতরে যেতে পারব৷ যদি আপনার না ঘুম ভাঙ্গে তাহলে আলমারীতে হাতুড়ী দিয়ে আঘাত করার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাৰে৷
ভাবতে ভাবতে কেমন যেন একটা ঘোর এসে গেল৷ দেখলুম আপনি যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে৷ আপনি ৰললেন–কে তুমি? কী চাও?
ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলুম৷ কোন উত্তর দিতে পারলুম না৷ ঘোর কেটে গেল৷ দেখলুম যে নিজের ঘরেই রয়েছি৷ আপনি ৰললেন তোমার অসুবিধা দূর করে দোৰ৷ অসুবিধার যে অংশটা অর্থ সংক্রান্ত তার জন্যে পাঁচশ’ টাকা দিলুম৷ অন্য ভাবেও সাহায্য করৰ৷
সে হাসিমুখে চলে গেল৷
আমি চলে গেলুম অফিসে৷ পরে লোকটির সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলুম৷ কেউ কেউ ৰললে ওই নামে একজন লোক রাঁচীর ৰর্দ্ধমান কম্পাউণ্ডে থাকতেন৷ তবে অনেক দৈন্যের মাধ্যমে তাঁকে দিন কাটাতে হয়েছিল৷ একদিন তাঁকে তাঁর শোবার ঘরে বিষপানে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছল৷ হাতে ছিল ছোট্ট একটা স্যাকরার হাতুড়ি৷