সেকালকার ৰাঙলায় ‘নীলদর্পণ’ বইটির নাম প্রতিটি শিক্ষিত লোকই শুনেছিলেন৷ নীল চাষীদের ওপর নীলকর সাহেৰদের অত্যাচারের ভিত্তিতেই এটি লিখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র৷ দীনবন্ধু মিত্র খুব সুশিক্ষিত লোক হয়েও জনসাধারণের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, তাঁদের ভাবভাষার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন৷ তিনি ছিলেন ৰঙ্কিমচন্দ্রের অন্তরঙ্গ ৰন্ধু৷ ‘নীলদর্পণ’ সম্ৰন্ধে জনসাধারণের কী মতামত তা জানবার জন্যে তিনি এলেন যশোরের এক গ্রামে৷ নৌকোয় নদী পার হচ্ছেন–নৌকোটা হাফিজ মিঞার৷ মাঝিমাল্লাদের আলাপ আলোচনায় তিনি বুঝলেন–তাদের গ্রামে তার আগেকার রাত্রে ‘নীলদর্পণ’ অভিনীত হয়েছে৷ সবাই তাই নিয়েই চর্চা করছে৷ তিনি হাফিজ মিয়াকে শুধোলেন, ‘‘হ্যাঁ ভাই, বইটা কেমন?’’ সে বললে–‘‘আর বলবেন না কত্তা, ভারী সুন্দর’’
মিত্রমশায় আবার শুধোলেন–‘‘নাট্যকার গরীব চাষীর ভাবভাষা ঠিকমত ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তো?’’
হাফিজ বললে–‘‘সে কথা বলতে কত্তা৷ নাটক দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল শালা যেন দেখতে দেখতে নিকেছে৷’’ শুনে দীনবন্ধু মিত্র ৰেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করলেন৷
সেদিন ‘নীলদর্পণ’–এর অভিনয় হচ্ছে৷ দর্শকদের মধ্যে অন্যান্য গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও রয়েছেন৷ দৃশ্যটা হূদয়বিদারক৷ নীলকর সাহেৰ একজন নিরীহ নীল চাষীর ওপর দারুণ অত্যাচার চালাচ্ছে৷ অভিনয়ে সাহেৰের নিষ্ঠুরতা ও চাষীর অসহায়তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে, চাষীর ওপর এই অত্যাচার দেখে বিদ্যাসাগর আর সহ্য করতে পারলেন না৷ তিনি তাঁর পায়ের থেকে তালতলার চটিটা *(*শ্যালদার পাশেই তালতলা৷ এককালে এই তালতলা চটি নির্মাণে প্রসিদ্ধ ছিল৷ বিদ্যাসাগর ওই তালতলার চটিই পরতেন৷ গল্প আছে, একবার ট্রেনে চড়ে তিনি যাচ্ছিলেন ৰর্ধমান৷ তাঁর সহযাত্রী ছিলেন একজন সাহেৰ৷ বিদ্যাসাগরের চোখে ঘুমের ঢুলুনি এসেছে৷ খানিক বাদে তিনি দেখলেন তাঁর চটি জোড়া নেই৷ তিনি বুঝলেন তাঁর সঙ্গে সাহেৰ মশ্করা করেছে৷ চটি জোড়া জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে৷ খানিকবাদে সাহেৰ কোটটা খুলে রেখে টয়লেটে গেল৷ বিদ্যাসাগর সাহেবের কোটটা জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন৷ সাহেৰ এসে শুধোলে–‘‘আমার কোটটা গেল কোথায়? বিদ্যাসাগর বললেন–‘‘তোমার কোটটা আমার চটির খোঁজে গেছে৷’’) খুলে মঞ্চের সাহেৰের দিকে ছুঁড়ে মারলেন৷
মঞ্চ পর্দায় ঢ়াকা পড়ে গেল৷
খানিকবাদে পর্দা সরল৷ মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন গিরিশ ঘোষ–মাথায় তাঁর বিদ্যাসাগরের তালতলার চটিটা৷ তিনি বললেন–‘‘অভিনয় করে এই ধরনের উচ্চ মানের পুরস্কার আমি জীবনে পাইনি৷ আমাদের অভিনয়–জীবনও সার্থক, ৰাঙলার রঙ্গমঞ্চও সার্থক৷ বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনুরোধ করব, এই চটিটা যেন তিনি আমাদের কাছেই থাকতে দেন৷ তাঁর জন্যে এক জোড়া তালতলার চটি আনতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি৷’’