‘ক্রম্’ ধাতু ড + কস্ + অচ্ = ক্রকষ৷ ‘ক্রকষ’ শব্দের অর্থ হ’ল– কোন কিছুকে সাজিয়ে গুজিয়ে আসর মাত করে দেওয়া, কোন অসুন্দর জিনিসকে সাজানোর গুণে সুন্দর ক’রে দেওয়া, অভিনয়ের সময় গ্রীণরুমে অভিনেতা–ভিনেত্রীদের নানান্ বস্তুর সাহায্যে অনুপম করে সাজিয়ে দেওয়া৷ যে কালো কুচ্ছিৎ ভুতুম–প্যাঁচার মত দেখতে তাকেও রজতোজ্জ্বল শিবতুল্য করে তোলা, পেত্নী–শাঁকচুন্নীকে তিলোত্তমা করে গড়ে তোলা৷ আলো–ছায়ার খেলা দেখিয়ে কচুরিপানায় ভরা এঁদোপুকুরকে নীল মহোদধিতে পরিণত করে তোলা৷ এ সবই ক্রকষ৷ ক্রকষের খেলা প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল৷
আমার এক বন্ধু ছিল–নাম ছিল বুবাই৷ বুবাইয়ের দিদির ডাকনাম ছিল টেৰী৷ ভাল নাম এখন মনে পড়ছে না–সম্ভবতঃ অনিন্দিতা৷
বুবাইয়ের দিদির তখন বিয়ের কথা চলছে৷ নানান দেশ থেকে বর পক্ষ আসছে কনের ইণ্টারবিউ (উপস্থিত পরীক্ষা) নিতে৷ যাদের কনে পছন্দ হচ্ছে তাদের সঙ্গে পাওনা–গণ্ডায় দানে–খাঁইয়ে মিলছে না৷ যাদের পছন্দ হচ্ছে না, তারা বলে যাচ্ছে–গিয়ে জানাব,.... লিখে জানাব৷ কন্যাপক্ষ এসব টেকনিক্যাল ভাষার (প্রযুক্তিগত বাগবিন্যাস) মর্ম ৰোঝেন৷
গোড়ার দিকে তাঁরা থালা সাজিয়ে ষোড়শোপাচারে পাত্রপক্ষকে আপ্যায়ন করতেন৷ শেষের দিকে সারতে লাগলেন একটা ছোট সাইজের রসগোল্লা, একটা তেকোণা নিমকি আর এক গ্লাস চা দিয়ে৷ পাত্রী টেবী গরম কালে ঘামে ভিজতে ভিজতে আর শীতকালে ঠাণ্ডায় ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে ইণ্টারবিউ দিয়ে আসতে লাগল৷ পছন্দ অনেকের হ’ল কিন্তু দেনা–পাওনায় মিলল না৷ তাই কোন জায়গায় বিয়ে কেঁচে গেল, কোন জায়গায় হতে হতে ফস্কে গেল৷
একবার পাত্রপক্ষ এলেন ভাটপাড়া থেকে৷ তাঁদের আবার ভারী বায়নাক্কা৷ তাঁরা মেয়ের পা জলে ভিজিয়ে মেয়েকে হাঁটতে বললেন, পায়ের ছাপ দেখবেন যে মেয়ে খড়ুমে–পা কিনা অর্থাৎ পায়ের সামনের দিকের ছাপ ও পেছনের ছাপের মাঝে সংযোজক ছাপ থাকছে কিনা৷ যদি থাকে তবে মেয়ে লক্ষ্মীশ্রী বলে গণ্য হবে৷ যদি সংযোজক ছাপ না থাকে তবে সে মেয়ে অলক্ষ্মী বলে গণ্য হবে৷
সেদিন দেখলুম টেবী প্রত্যেকটা পরীক্ষাতেই লেটার মার্ক পেয়ে পাশ করে গেল কিন্তু বিপর্যয় দেখা গেল শেষ মুহূর্ত্তটিতে৷ এই ইণ্টারবিউয়ের কিছুদিন আগে টেবী একবার গেছল মামার বাড়ী ন’দে জেলার মুড়াগাছায়৷ ওর মামা–মামীমার সঙ্গে টেবী ফিরে তো এল, সঙ্গে নিয়ে এল ওখানকার হাঁড়ি–ভরা নামজাদা ছানার জিলিপি আর কাঁচাগোল্লা৷ কিন্তু অজ্ঞাতসারে সঙ্গে করে নিয়ে এল হাড়কাঁপানো বমি–ওপচানো সেখানকার মালোয়াবি
জ্বর, আজকাল যাকে শিক্ষিতরা ‘ম্যালেরিয়া’ বলে থাকেন৷
এক কালে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এই ম্যালেরিয়া জ্বর প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করত৷ লোকে লক্ষ্য করে দেখলে যেখানে সাধারণতঃ ৰদ্ধ জলাশয় আছে সেখানেই এর প্রাদুর্ভাব৷ ভারতে এই রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিল কিছুটা পার্বত্য এলাকায়, তরাই অঞ্চলে ও পূর্ব ভারতে৷ খুঁটিয়ে দেখে আরও নজর পড়ল যেখানে বড় বড় জলাভূমি, বিল, ৰাওড়, হাউড়, ৰাদা, জলা আছে সেখানেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব৷ রোগটি ব্যাপক আকারে দেখা দিত অসমে, ৰাঙলার ময়মনসিং, রাজশাহী, যশোর, নদীয়া ও বর্দ্ধমান জেলায়৷
রোগটির কোন বাঁধা নাম গোড়ার দিকে ছিল না৷ সাহেৰরা ভাবতেন খারাপ জলাভূমি এলাকায় রোগটি হয়৷ তাই নাম দিলেন malareal fever অর্থাৎ খারাপ এলাকার জ্বর৷ পরবর্ত্তীকালে নামটি পাল্টে করে দেওয়া হ’ল ম্যালেরিয়া ফিবার বা ম্যালেরিয়া জ্বর৷ ৰাংলা ভাষায় শব্দটাকে সাজিয়ে গুজিয়ে করে দেওয়া হ’ল ‘মালোয়ারি জ্বর৷’
বর্দ্ধমানের নামডাক যে কেবল চাষেতেই তা’ নয়৷ এই ম্যালেরিয়া জ্বরেও বর্দ্ধমান হয়ে উঠল সবার সেরা৷ সেখানে ম্যালেরিয়া জ্বরের রাশ নাম হ’ল বর্দ্ধমান জ্বর৷ তোমরা জান তো, বাঙলার প্রতিটি মানুষের তিনটি নাম৷ একটি হ’ল তার ডাক নাম–যে নাম বাড়ীতে পাড়াতে চলে৷ দ্বিতীয়টি চলে স্কুলে কলেজে কোর্টে–কাছারীতে৷ সেটাকে আমরা বলি ভাল নাম, উত্তর ভারতে ৰলে শুভ নাম৷ তৃতীয় নামকে বলে রাশি নাম, রাশ নাম–তা’ ঠিকুজী কোষ্ঠীতে থেকে যায়৷ ব্যবহারে বড় একটা লাগে না৷ উত্তর ভারতে বলে থাকে–
‘‘এক এক মিঞা কা তীন–তীন নাম
ফৈজু–ফৈজল্–ফজল্ ইমাম্৷
তনীগো নুংগা দস্তরখান
তনীগো ঘোড় ৰাৰুর্চিখান’’৷