আমাদের প্রিয় বাসভূমি ত্রিপুরা এর সাবেকি নাম ছিল পার্বত্য ত্রিপুরা বা হিল ত্রিপুরা আর এই নামের ইংরেজি বানান পূর্বে ছিল (Tipperah) রাজন্য আমলের নির্দেশন স্বরূপ একে রাজগী ত্রিপুরা বলে অভিহিত করা হয়৷ বর্তমানে এই ত্রিপুরার মোট আয়তন হচ্ছে, ১০,৪৯১,৬৯ বর্গকিমি৷ তাও আবার দুটি ভাগে বিভক্ত ঃ--- (ক) এডিসিভুক্ত এরিয়ার আয়তন ৭,১৩২.৫৬ বর্গ কিমি ও (খ) এডিসি এলাকার বাইরের আয়তন ৩,৩৫৯.১৩ বর্গকিমি৷ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে আয়তনের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাচ্ছে ভারতের যেকোনো রাজ্যের কোন জেলা থেকেও রাজ্যটির আয়তন কম হবে আর লোকসংখ্যাও কমই হবার কথা৷ সবচেয়ে বড় কথাটা কি ? বিগত চতুর্দশ শতাব্দির শেষ দিকে অথবা পঞ্চদশ শতাব্দির গোড়ার দিকে বার্মা থেকে তিপ্রা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ভূমিতে প্রথম আসেন৷ সেটি ঐতিহাসিক তথ্য৷ এরও পূর্বে এখানে এসেছিলেন আরকান থেকে মগেরা৷ উক্ত মগ ও তিপ্রাদের পরে অন্যান্য পাহাড়বাসী কিংবা জুমিয়া সম্প্রদায়ের (উপজাতি বা ট্রাইব্যাল বললে যেহেতু মানুষকে মানুষের মর্যাদা না দিয়ে হেয় করা হয় সেজন্যে এখানে আমি ‘পাহাড়বাসী’ বলতে তাদেরই বোঝাতে চাইছি৷) মানুষেরা এসেছেন বিভিন্ন সময়ে ও বসতি স্থাপন করেছেন৷ সর্বসাকুল্যে পাহাড়বাসীদের মধ্যে মোট ১৯টি গোষ্ঠীর লোক রয়েছে৷ তাদের মধ্যে তিপ্রা বা ত্রিপুরা, ত্রিপুরী, দেববর্মণ, নোয়াতিয়া, জমাতিয়া, উচইরা এসেছেন৷ বার্মা অর্থাৎ বর্তমান মায়ানমার থেকে, মগেরা এসেছিলেন আরাকান থেকে, রিয়াং হালামার চীন (মতান্তরে উত্তর বার্মা) থেকে, ভুটিয়া,চাইমল, লেপচারা ভুটান থেকে, চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে, ভিল মুন্ডা ও ওরাংরা ছোটনাগপুর থেকে, সাঁওতালরা ছোটনাগপুর বা মধ্যপ্রদেশ থেকে, গারো বা জেকে হিলস থেকে কুকি, লুসাই, রাংখাল, মলসমরাও বাইরের কোন কোন অঞ্চল থেকে এসে ত্রিপুরার বাসিন্দা হয়েছিলেন৷ মোদ্দা কথাটা হ’ল তিপ্রা, রিয়াং,হালাম প্রমুখরা মূলত মঙ্গোলীয় বংশদ্ধৃত ও বহির্ভারতীয়৷ মগ ও রাংখলরা আরাকান থেকে ত্রিপুরায় আসেন তখন বঙ্গদেশে পালরাজারা রাজত্ব করতেন৷ আর পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক৷ তাই মগেরা বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হন ও তারা পিলাক ও বক্সনগর অঞ্চলের বৌদ্ধ সভ্যতার প্রসার ঘটিয়েছিলেন৷ তখনও ত্রিপুরায় তিপ্রারা আসেন নি৷ পরবর্তীকালে তিপ্রারা আসেন৷ তিপ্রারা তাদের ভাষায় বৌদ্ধদের বলতেন ‘‘লিকা’’ ও আরাকান বাসীদের বলতেন ‘মামা’৷ যাক,বার্মা থেকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত হয়ে খাদ্যের সন্ধানে আমাদের এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিলেন৷ মু-চাও-ফা-য়ের নেতৃত্বে তিপ্রারা৷ তারা মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর উদ্ভূত ও তাদের ভাষা তিববত ও বর্মী গোষ্ঠীর আবার পিল্লাক শব্দটি হচ্ছে আরাকানী মগদের ভাষায় এর মানে বোঝায় স্তুপিকৃত সম্পদরাশি৷ পরবর্তীকালে মাটি খঁুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বৌদ্ধ সভ্যতার অনেক নিদর্শন খঁুজে পেয়েছেন৷ তিপ্রাদের ককবরক ভাষায় ‘তুই’ মানে জল ও ‘প্রা’-র মানে কাছাকাছি৷ তাই জলের কাছাকাছি দেশ এই অর্থেই এই ভূ-ভাগের নাম হয়ে যায় ‘তুইপ্রা’ ও তুইপ্রা থেকে তিপ্রা হয়ে ক্রমশঃ তৃপুরা, ত্রিপুরা হয়ে যায়৷ সংস্কৃতরূপ ধারণ করে৷ তিপ্রা থেকে ত্রিপুরায় এই নামের রূপান্তরণ ঘটে আজ থেকে বড় জোর সাড়ে পাঁচশ বা ছয়শো বছর আগে৷ কেননা ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রাচীনকালে এই ভূভাগ ছিল সমতটের অংশবিশেষ আর সমতট ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ও করদ রাজ্য৷ ইতিহাস পর্র্যলোচনায় আমরা দেখতে পাই সম্ভবত প্রায় দ্বিতীয় শতাব্দি থেকে প্রায় দশম শতাব্দি পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসন চলেছিল এই অঞ্চলে৷ সম্রাট বৈনগুপ্তের আমল পর্যন্ত ঐতিহাসিক নিদর্শনের খোঁজ পাওয়া যায়, ময়নামতি সহ লালমাঈ (বর্তমান বাংলাদেশ ও পূর্বতন পূর্ববঙ্গ) পাহাড়ে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রসস্তিতে এর প্রমাণ রয়েছে৷ পরবর্তীকালে উক্ত ভূভাগটির নাম হয়ে যায় (হরিকেল) রাজ্য৷ একথা অস্বীকার করা চলে না যে আজ আমরা পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার ইত্যাদি নামাঙ্কিত যেসব রাজ্যসমূহ দেখতে পাই সুদূর প্রাচীনকালে শুধু বাংলাদেশ বা পঞ্চগৌড় বলতে কখনও একই রাজা বা শাসকের অধীনে ছিল না৷ বরং তখন ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য তথা শাসকদের অধীনে এক একটি অংশ, সেগুলি আবার সময়ে সময়ে নাাম পরিবর্তন ও সীমানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও বদলে যেত৷ যেমন গুপ্তযুগের পর যখন মেঘনা বিধৌতি সমগ্র পূর্বাঞ্চলের এই পার্বত্য ত্রিপুরার বিরাট অংশের নাম হরিকেল রাজ্য হয়ে যায়৷ তখন বর্তমান আঠারো মুড়ার উত্তরাংশ সহ বর্তমান সীলেট অঞ্চল জুড়ে ভূ-ভাগের নাম ছিল শ্রীভূমি, আর সেই সময় এটি ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর, কামরূপের অংশবিশেষ৷ আমরা জানি যে বর্তমান অসম রাজ্যেরই পূর্বতন নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর ও কামরূপ৷ সূত্র-প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ্ ঐতিহাসিক প্রয়াত জহর আচার্যের লেখা ত্রিপুরার ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)৷ শ্রীভূমির সাক্ষ্য বহন করছে, এখনও বর্তমান বাঙলাদেশের অন্তর্ভুক্ত শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলা শহরটি৷ উক্ত সিলেট শহরেরই এম.সি.কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন ত্রিপুরার প্রয়াত মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব (দেববর্র্ম) আর কুমিল্লার (কমলাঙ্ক) ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন ত্রিপুরার প্রখ্যাত ও স্বনামধন্য সঙ্গীতকার ও সুরকার প্রয়াত শচীনদেব বর্মন৷ উল্লেখ থাকে যে, সুপ্রাচীনকালে চীনা পরিব্রাজক হিউ-য়েন.সাঙ সিলেট থেকে রওনা হয়ে ভারতের উত্তর পূর্র্বঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন৷ তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে সেই সময়ের মোট ছয়টি রাজ্যের নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলেন৷ কিন্তু কোথাও ত্রিপুরা নামটি ছিঁটে ফোঁটা লেখা মাত্র নেই৷ এ থেকেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, পরিব্রাজক-হিউয়েন-সাঙের সময়ে যদি ভারতবর্ষে অথবা পৃথিবীতে ত্রিপুরা নামে কোন ভূভাগের অস্তিত্ব থাকতো তাহলে অবশ্যই শ্রদ্ধেয় সাঙ মহাশয় তারও উল্লেখ না রেখে পারতেন না৷ এছাড়া, ভাষাবিশারদ অধ্যাপক সুনিতী কুমার চট্ট্যোপাধ্যায়ও স্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন যে মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত ও তিববতি বর্মী ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা কোন মতেই ১৫০০ শতাব্দী পূর্বে ত্রিপুরায় প্রবেশ করেননি বা হিন্দুত্ববাদকে গ্রহণ করেন নি৷ আমরা সকলে জানি যে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব মণিপুরে যাবার পথে ত্রিপুরায় পা রেখেছিলেন ও তখন ত্রিপুরার রাজা রত্নমাণিক্য বাহাদূর ও তাঁর পরিবারভুক্ত সকলে ও রাজপারিষদবর্গ সহ চৈতন্যদেবের দ্বারা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন৷ এ থেকেও প্রমানিত হয় যে, বর্তমান ত্রিপুরা নামক ভূখণ্ডের আবির্ভাব চতুর্দশ কিংবা পঞ্চদল শতাব্দীর পূর্বে কিছুতেই নয়৷ কেননা,চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালই সেই সাক্ষ্যবহন করেছে৷ আরও একটি প্রামাণ্য তথ্য দেওয়া যেতে পারে যে, পূর্র্বেক্ত রত্নমাণিক্য বাহাদুরই ছিলেন ত্রিপুরার ‘‘মাণিক্য’’ উপাধিধারী প্রথম অভিষিক্ত রাজা৷ তাঁর বংশগত নাম ছিল রত্নফা ও তা থেকে তিনি নাম ধারণ করেছিলেন রত্নমাণিক্য আর তাঁর রাজ্যভিষেক হয়েছিল রাজা হিসেবে ১৪৬৪ খ্রীষ্টাব্দে৷ তিনিই ত্রিপুরার প্রথম রাজা৷ তাঁর পূর্বে আমরা আর যাদের নাম পাই (যথা---মুচাংফা ও তাঁর পরবর্তী বংশধর যেমন ছেংকাছাগ, খিচুংফা, সীচুংফা, আচঙ্গফা, ডাঙ্গরফা বা ডুঙ্গুর ফা) এঁরা সকলেই ছিলেন ‘ফা-উপাধিথারী উপজাতি সর্দারগণ৷ রাজমালায় যে মহামাণিক্যদির নাম পাওয়া যায়, সেগুলো সবই হয় কাল্পনিক নাম নয়তো রাজমুকুটবিহীন উপজাতি সর্দার বিশেষ৷
আরও বলতে হচ্ছে যে, রাজমালায় যে মোট ১৮৪ জন রাজার নাম পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে মোট ১৩৯ জন রাজার ক্ষেত্রেই কোনও ঐতিহাসিক সত্যতার প্রমাণ মেলে না৷ এমনকি রাজমাতেই উল্লেখ রয়েছে ঃ ‘‘রত্নফা নাম তার পিতা রাখিছিলেন৷ রত্নমাণিক্য নাম গৌড়েশ্বরের কৈল৷’’ (সূত্র পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে)
ত্রিপুরার ইতিহাস আলোচনায় ‘‘রাজমালা’’ একটি আকর-গ্রন্থ হিসেবে অবশ্যই অপরিহার্য, কিন্তু রাজমালা সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক ও সত্যতথ্যের উপর লিখিত নয়৷ দ্বিতীয়ত, রাজমালাতে অনেক পৌরাণিক কিংবা কিংবদন্তিমূলক কাহিনীর ছড়াছড়ি রয়েছে,সেগুলো অনেকটাই বিভ্রান্তমূলক বলে নির্ভরযোগ্য নয়৷ সুতরাং সকল বৃত্তান্ত যুক্তি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করাটাই সমীচিন হবে বলে মনে করি৷ রাজমালার বিভ্রান্তির দুয়েকটি নজির তুলে দিচ্ছি৷ যেমন---সমতটের কয়েকটি রাজধানীর নাম রয়েছে---‘‘ত্রিপুর’’, ‘‘কর্ত্তৃপুর’ বাদ কামটা ইত্যাদি৷ সেক্ষেত্রে কর্ত্তৃপুরকে (কর-ত্রিপুর) বলে ভাঙিয়ে ‘ত্রিপুরা’ নামের উল্লেখ করা হয়েছে৷ দ্বিতীয়ত ঃ মধ্যযুগের (ত্রিপুর’-কে দেখানো হয়েছে ‘ত্রিপুরা’ বলে৷ কিন্তু, সেই ‘ত্রৈপুর’ ছিল মধ্যপ্রদেশের একটি স্থানেম নাম৷ তৃতীয়তঃ অনেকে দাবী জানান ত্রিপুরার অবস্থান মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পাণ্ডব বা এখানে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করছি যে, মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পাণ্ডব বা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়কাল ছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আর, তখন থেকেই যদি বার্মা বা বহির্ভারত কে তিপ্রা সম্প্রদায়ের লোকের ভারতবর্ষে আবির্ভূত হয়ে থাকতেন তাহলে তাদের ভাষা বা বুলিতে অবশ্যই বৈদিকী বা সংস্কৃত বা প্রকৃত ভাষার কোন না কোন প্রভাব থাকতই৷ তা তিববত---বর্মী গোষ্ঠী ভুক্ত ভাষা তাদের মুখের ভাষা রয়ে গিয়েছিল কোনযুক্তিতে৷ ফা, কক-বরক, তুই, আঙ, লিকা,রাঙ, কুরুই, খুলুমখা, ওয়ান ইত্যাদি শব্দমালা কী পরিচয় বহন করছে? ভারতীয় বংশোদ্ভূতেরা তো নদী-মাতৃক সভ্যতায় পুষ্ট৷ সমতলবাসীরা হালচাষের মাধ্যমে কৃষিকাজে অভ্যস্ত ৷ সেইস্থলে চাষবাসের প্রথম যুগের বহু শতাব্দী পূর্বের জুমচাষ প্রথা নিয়ে আজ অব্দি ত্রিপুরার পাহাড়বাসী পেছনে পড়ে রইলেন কোনযুক্তিতে৷ বাঙালী---সভ্যতা মৃৎশিল্পে ও বস্ত্রশিল্পেও উন্নত৷ সেক্ষেত্রে তিপ্রা প্রমুখ পাহাড়বাসী মাত্রেই তাদের পোষাক পরিধেয় ও বাসন কোসনের দিক থেকে তুলমানূলকভাবে অদ্যাবধি পিছিয়ে রয়েছেন কেন? প্রসঙ্গক্রমেই বলব, জাত্যাভিমান মানুষমাত্রেই থাকা স্বাভাবিক ও থাকুক সেটাই কাম্য৷ কিন্তু, জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় নিয়ে অত্যগ্রতা বর্তমানে বিশ্বায়ন তথা বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার যুগে সম্পূর্ণরূপেই বেমানান নয় কি?
তারপরে আসছি বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যভাগ ও তিপ্রাল্যাণ্ড বানাবার চিন্তাধারা নিয়ে খানিকটা পর্যালোচনায়৷ স্থানাভাবে এই পরিসরে জিজ্ঞাসা এখানে তুলে ধরতে চাই৷
প্রথমত, এডিসি-এলাকা নিয়ে তিপ্রাল্যাণ্ড চাওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু,কোন এডিসি এলাকাই কি সম্পূর্ন উপজাতি অধ্যুষিত? যদি ধরে নেওয়া হয় যে, কোন একটি এলাকা মিশ্র বসতিপূর্ণ নয় অর্থাৎ বাঙালীশূন্য অথবা পুরোপুরি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক নিয়ে উপজাতি অধ্যুষিত৷ তাহলে, তিপ্রাল্যাণ্ড হলেও কি অদূর ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ-সহবস্থান সম্ভবপর হবে? ভবিষ্যতে তিপ্রাল্যাণ্ডের ভেতরে রিয়াং তথা ব্রু-ভাষীরা, ভিন্ন গোষ্ঠী চাকমা, মগ কিংবা লুসাই-কুকীরাও কি শান্তি সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাসে সক্ষম থাকবেন? বর্তমানে মিজোরাম থেকে বিতাড়িত রিয়াংদের কথা আমাদের আশঙ্কা জাগায় কি? তাহলে একবার ভাবুন, যদি ভবিষ্যতে ত্রিপুরাকে ১৯টি জনজাতি গোষ্ঠ+ ৩ টে মণিপুরী গোষ্ঠী (বিষ্ণুপ্রিয়া বা বিষেণপুরিয়া, মৈতে আর পাঙ্গাল)+ঝাড়খণ্ড+ বর্তমানে বসবাসরত বাংলাভাষীরা অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে (১+ + + ১) বা ২৪টি রাজ্যে ত্রিপুরাকে কবিভক্ত করতেই হয়, তখন তো সেদিনের বামফ্রন্টের তৈরী রাজ্যের মোট ৫৮টি ব্লককে ভাগ বাটোয়ারা করতে হবে ও তারফল দাঁড়াবে কোন কোন রাজ্যই ১টি, ২টি বা আড়াইটে ব্লক নিয়ে রাজ্যের মালিকানা নিয়ে খুশী থাকতে হবে৷ সেই পরিস্থিতিতে উক্ত কল্পিত রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক স্বরম্ভরতার উপায়ের উৎস কী হবে--- কেন্দ্রের অনুদান নির্ভর, না বৈদেশিক রাষ্ট্রের পরাধীনতা মেনে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি? দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক সুরাহা হলেও বা শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সংসৃকতি পরিবহন--- আধুনিক যুগে রাজ্য বা রাষ্ট্র চালাতে চাইলে যা,যা, যোগান চালু রাখতে হয়, তিপ্রাল্যাণ্ডের কলাকুশলীরা কি সেইসব ভাবনা তাঁদের মস্তিষ্কে স্থান দিয়েছেন?
তদুপরি বলব, শুধু রাজনৈতিক ভাগাভাগিতেই যদি মূল সমস্যাবলীর সমাধান হয়ে যেত, তাহলে ভারত উপমহাদেশকে ভেঙ্গে প্রথম দফায় ২টি অংশে ও দ্বিতীয় দফায় ৩টি অংশে বিভক্ত করেও কিন্তু শান্তি অধরাই রয়ে গেছে বরং সমস্যা বহুগুমে বেড়েছে বই কমেনি৷ এছাড়া এডিসি ঘটন করার পর সুস্থিতি পাওয়া যায় নি বলেই পরবর্তীকালে শোষণ, বঞ্চনা, হতাশাকে সম্বল করে কিছুকাল ‘‘স্বাধীন ত্রিপুরা’’-র স্বপ্ণ বিহ্বলতা অনেককেই বিভ্রান্ত করেছিল৷ এখন আবার চলছে তিপ্রাল্যাণ্ড এর স্বপ্ণাহুতা৷ এক্ষেত্রে বলব, ত্রিপুরায় আমাদের মূল সমস্যাটি অর্থনৈতিক আর এরও জন্যে দায়ী মূলতঃ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ ও সদিচ্ছার অভাব সুতরাং রাজনৈতিক ভাগাভাগি দিয়ে এর সমাধান কল্পনারও অতীত ৷ তাই, রাজ্যভাগের চিন্তাটা বুভুক্ষু, শোষিত, দুঃস্থ ও নিরীহ অসহায় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে উসকানী যুগিয়ে ভোট আদায়-এর পথ সুগম করে রাখা হয়৷
- Log in to post comments