আমরা ত্রিপুরায় বাস করি৷ ত্রিপুরা আমাদের প্রিয় বাসভূমি৷ ত্রিপুরা নিয়ে বিগত শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ থেকে কিছুসংখ্যক উন্নত অথবা অবনত মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষ পদবাচ্য জীবদের দ্বারা এই ভূখণ্ডে বলতে গেলে, বিসদৃশ রকমেরই জল্পনা-কল্পনা, সন্ধি-দূরভিসন্ধির নানা রকমের ঘাত-প্রতিঘাত হয়েই চলেছে৷ বিগত কয়েকশো বছর ধরে বড় জোর ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিক বা চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়া থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচশ কিংবা ছয়শ’ বছর আগে থেকে উত্তর বার্র্ম থেকে মু-চাং-ফা-য়ের নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত ও তিববত-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত উপজাতিরা ত্রিপুরায় এসেছিলেন৷ ওই সময় অনাবৃষ্টির কারণে বার্র্ময় (ব্রহ্মদেশ বা বর্তমান মায়ানমার) দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেখানকার উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষেরা বাঁচার তাগিদেই অন্যত্র পাড়ি দেবার মনস্থ করেছিলেন৷ কোনো কোনো বইতে লেখা রয়েছে যে, উত্তর বার্র্ম থেকে ‘টিপরা’ নামের উপজাতিরা আরাকান হয়ে ত্রিপুরার রাঙামাটিতে অর্থাৎ বর্তমানের অমরপুরের উত্তরাংশে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন৷ কেউ কেউ আবার এটাও উল্লেখ করেছেন যে ওই উপজাতিরা কাছাড় হয়ে ত্রিপুরায় আসেন৷ কিন্তু এই মন্তব্যের সমর্থনে কোন জোরালো ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ মিলছে না৷ কিন্তু কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে অসম রাজ্যের বড়ো ভাষাগোষ্ঠীদের অন্তভুর্ক্ত ত্রিপুরার এই টিপরা গোষ্ঠীর লোকেরা বলে জানা যায়৷ কেউ আবার বলছেন যে আজ থেকে পাঁচ-ছয়’শ বছর আগে থেকে উক্ত উভয় গোষ্ঠীর ভাষাগত বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি হয়ে গেছে৷ বর্তমানে ত্রিপুরার টিপরা কে প্রদত্ত বিচারে ভাষা পদবাচ্য বা লাঙ্গুয়েজ বলে বিবেচিত হতে গেলে ভাষাতাত্তিকদের মতে---(১) নিজস্ব শব্দভাণ্ডার (২) জনসমষ্টি (৩) লোকসাহিত্য (৪)লিপি বা হরফ (৫) ব্যাকরণ অর্থাৎ--- সর্বনামপদ, ক্রিয়াপদ, কারক বিভক্তি ইত্যাদির যুক্তি সমর্থিত প্রয়োগবিধি থাকতে হয়৷ সেই নিরিখে বিচার করতে গেলে কক-বরক, রিয়াংদের কথ্যভাষা ধ্রুবা কাউ-ব্রু, চাকমাদের যদিও নিজস্ব হরফ রয়েছে, কিন্তু এগুলো সম্ভবতঃ এখনও ভাষার মর্যাদা পাবার অধিকারের স্বীকৃতি পায়নি৷ তদ্রূপ, অবশ্য হিন্দী ও সংস্কৃতেরও নিজস্ব লিপি নেই, যদিও সংস্কৃত ভাষাটির বিশাল শব্দভাণ্ডার রয়েছে৷ আবার ব্যাপক ও সমৃদ্ধ সাহিত্যও রয়েছে৷
দ্বিতীয়ত, যদিও টিপরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা স্থানিক দৃষ্টিতে ত্রিপুরা তথা ভারতের মাটিতে বহিরাগত আর্যদেরই বা নিগ্রোদেরই মতো তদুপরি ভাষাগত দৃষ্টিতেও কক-বরক ভারতীয় সংস্কৃত ভাষা জাত, প্রাকৃত ভাষা জাত, বৈদিক ভাষাজাত কিংবা দ্রাবিড় (অষ্ট্রিক ও নিগ্রোয়েড রক্ত ---সংমিশ্রণ জাত) গোষ্ঠীর ভাষা জাত নয় বলে কোনমতেই তারা ভারতের তথা বাংলার মাটির ভূমিপুত্র বা ‘আদিবাসী’ তথা ‘ইন্ডিজেনাস’ বলে গণ্য হবার নন (পণ্ডিতদের মতে, যারা ভারতের মাটিতে সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষাজাত ভাষা গোষ্ঠীর লোক, একমাত্র তারাই এদেশে ‘আদিবাসী’ বলে বিবেচিত হবার যোগ্য হবেন৷ কিন্তু যারাই ত্রিপুরাকে টিপরাল্যাণ্ড অর্থে ট্রাইব্যাল ল্যাণ্ড বলে ভাবার দাবী রাখেন, তাদের অবশ্যই যুক্তি বিচার বুদ্ধি নিয়ে চিন্তাভাবনা রাখা খুবই সঙ্গত একারণেই যে, ত্রিপুরা-নামের এই ভূ-ভাগের ‘‘ত্রিপুরা’’ নামটি কিন্তু খুব বেশীদিনের পুরনো নয়৷ কেননা, এই ভূভাগের নাম ‘‘ত্রিপুরা’’ হয়েছে এর পূর্বনাম ‘‘শ্রীভূমি’’ থেকে৷ আবার শ্রীভূমি নাম পাবার আগে এর নাম ছিল হরিকেল রাজ্য ও সমতট রাজ্য৷ হরিকেল রাজ্য ও সমতট রাজ্যের প্রমাণস্বরূপ প্রায় দেড়শতাধিক মুদ্রা ও সরকারী মিউজিয়ামে আর ‘রাজেন্দ্র কীর্ত্তিশালায় রক্ষিত রয়েছে’ বলে এরাজ্যের বর্তমানে প্রয়াত মুদ্রা গবেষক ও ইতিহাস-বিশ্লেষক শ্রী জহর আচার্জী মহাশয় তাঁরই রচিত ‘‘ত্রিপুরার ইতিহাস ১ম খণ্ড’’ বইতে উল্লেখ করে গেছেন৷ এছাড়াও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যথা পিলাকে ও বকসনগরে প্রাপ্ত বৌদ্ধসংস্কৃতির ধবংসস্তুপ থেকে প্রাপ্ত টেরাকোটাসহ নিদর্শনাদি, সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের স্তম্ভলিপি, গুনাইঘর---কীর্ত্তি, ময়নামতী, কুমিল্লা, ইত্যাদি স্থানে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি, বিগত মোগল আমল ও ব্রিটিশ আমলের দলিল-দস্তাবেজ ও রাজস্ব-আদায়ের রসিদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমেও যথেষ্ট প্রমাণের হদিশ মজুত রয়েছে, অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷ সুতরাং, নিঃসন্দেহেই এটি ঐতিহাসিক সত্য যে, বর্তমান ত্রিপুরা তথা পূর্বতন শ্রীভূমি--- কুমিল্লা, ময়নামতী, মোগল আমলের চাক্লা রোশনবাদ ও ব্রিটিশ আমলের ত্রিপুরা ডিষ্ট্রিক্ট তথা সমতল ত্রিপুরাসহ চট্টল ও চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভোলা অর্থাৎ বর্তমান নোয়াখালি--- এই বিস্তৃত বঙ্গ ডবাক বা উপবঙ্গ নামে কথিত ছিল৷ আর এই বঙ্গডবাক (ত্রিপুরাসহ পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পার্বত্য ত্রিপুরা বা হিলস্ টিপপারা বা রাজগী টিপপারা ও প্লেইন ত্রিপুরা), বরেন্দ্রভূমি (বর্তমান উত্তরবঙ্গ), সমতট, রাঢ় ও মিথিলাসহই ছিল অতীতে অখণ্ড বঙ্গদেশ তথা বাঙলাদেশ, যা এককালে পঞ্চগৌড় বা গৌড় দেশ বলেও অভিহিত হত৷ বলা বাহুল্য মাত্র যে রাঢ়ভূমি প্রায় ত্রিশকোটি বছরের প্রাচীন আর এই ত্রিপুরাও (পার্বত্য অংশ) রাঢ়েরই সমসাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন মহান ইতিহাস বেত্তা ও প্রাউট দর্শনের প্রণেতা সত্যদ্রষ্টা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি আরও বলেছেন স্পষ্ট ভাষায় যে, সমস্ত ত্রিপুরাতেই বাঙালীরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে স্থায়ী বাসিন্দা আর পূবর্তন শ্রীভূমি-র ত্রিপুরা নামকরণও হয়েছে বার্র্ম থেকে আগত টিপ্রা উপজাতিদের ‘তুইপ্রা’ নামের অনুকরণেই৷ কক-বরক ভাষায় ‘তুই’ কথার মানে জল আর ‘প্রা’-র মানে হচ্ছে কাছাকাছি৷ অর্থাৎ দক্ষিণে বিশাল জলরাশি বঙ্গোপসাগর অথবা পূর্ব বাঙলার তথা বঙ্গডবাকের (ডবাক-কথাটির মানে ডুবে যাওয়া মাটি) জলরাশি দেখেই সম্ভবত ‘তুইপ্রা’ নামকরণ হয়েছিল৷ এ যুক্তির সমর্থনে ত্রিপুরার রাজমালার লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহ মহাশয়ই অনুরূপ মন্তব্য রাজমালাতেই প্রকাশ করেছেন বলে আমরা প্রয়াত জহর আচার্জী মশাইয়ের লেখা থেকেও জানতে পারি৷
তবে, এপ্রসঙ্গে উল্লেখ না করেও পারছি না যে, উঃ-পূর্ব ভারতে কর্মরত খ্রীষ্টান মিশনারি ও বৈদেশিক উস্কানীদাতাদের কু-পরামর্শে ও সর্র্বেপরি স্বাধীনোত্তর ভারতে পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠীর ক্রীড়নক শাসকগোষ্ঠীদের সাঙ্গপাঙ্গ দিশাহীন ও আদর্শহীন রাজনৈতিক বিভিন্ন দলসমূহের নানারকম চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়েই ত্রিপুরায় বর্তমানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ভ্রাতৃভূমি জনজাতিভুক্তরা নিজেদের আইডেন্টিটির প্রশ্ণ নিয়ে অস্থিরতার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন৷ সুদীর্ঘ কয়েকশ’ বছর ধরে নদীমাতৃক সভ্যতাপুষ্ট, প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত সভ্যতা সংস্কৃতির ধারক-বাহক বাঙালীকে পাশাপাশি শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রেখে জাতি ও জনজাতি উভয় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াসেই ভাল চলছিল৷ তবে কথায় রয়েছে না---গভ প্রপোজেস অ্যাণ্ড সাটার্ন ডিস্পোজেস৷ অর্থাৎ করুণাময় ঈশ্বরের মঙ্গলেচ্ছা থাকলেও কোথাও কোথাও দোজখের শয়তান ইবলিশেরা মানুষের জীবনে ডেকে আনে মহাদুর্র্যেগ---মহাসংকট৷ আর এসব অঘটন যুগে যুগে ঘটে চলেছে৷ মহা ভারতের যুগে শকুনি, রামায়ণের যুগে বিভীষণ, বাঙলার বুকে মীরজাফর, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অহিংসাবাদী আর পুঁজিবাদের ক্রীড়নক বর্গ আর স্বাধীনোত্তকালেও তথাকথিত ডেমোক্র্যাসীর আদলে ‘‘ডেমোনস্ ইন হিউম্যান্স ফর্মস’’--- এরা জাগ্রত মানবতা বিরোধী বেইমানচক্র৷ এই তারাই পোলিটিক্যাল ফাউল গেইম্ খেলে ফায়দা তোলার জন্যে ‘‘যযে ততে’’ ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে চলেছে৷ যার মানে যখন যেমন-তখন তেমন৷ (বাকী অংশ এর পরবর্তী সংখ্যায়)
- Log in to post comments