যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধুন্ধুমার  কাণ্ড  প্রসঙ্গে

যাদবপুর  বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৯শে সেপ্ঢেম্বর  কেন্দ্রীয় মন্ত্রী  বাবুল সুপ্রিয়ের কর্মসূচীকে ঘিরে  যে ধুন্ধুমার কাণ্ড  ঘটে গেল তা মোটেই কাম্য নয়৷ একটি শিক্ষাক্ষেত্রে  এধরণের  ঘটনা প্রমাণ  করে আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা কোথায়  দাঁড়িয়েছে ৷  পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, নিয়মনীতি, শৃঙ্খলার লেশমাত্র দেখা গেল না৷ কোন্ গোষ্ঠী কোন  দল বা কে  কতখানি  এজন্যে দায়ী বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিশ্লেষণে পণ্ডশ্রম  না করে, সোজাসুজি বলা চলে দায়ী সংকীর্ণ দলীয়  রাজনীতি৷  যার পুরোধারা  শিক্ষাক্ষেত্রকে নিজেদের  ক্যাডার তৈরীর আখড়া বানিয়ে ফেলেছে৷ আর মাঝখান থেকে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ ডেকে এনেছে৷

শিক্ষা মানবসমাজের  মেরুদণ্ড৷  শিক্ষাকেন্দ্রগুলি প্রকৃত মানুষ তৈরীর কারখানা৷ অন্যান্য পশুরা  জন্ম থেকেই  ওই পশুর গুণ এমনিতেই পেয়ে যায়৷  কিন্তু  মানুষ জন্মেই প্রকৃত  মানুষ হয় না৷ শিক্ষাই তাকে  প্রকৃত  মানুষ করে গড়ে  তোলে৷ অন্ততঃ সে শিক্ষা যদি  যথার্থ শিক্ষা হয়৷ সামাজিক, আর্থিক, মানসিক আধ্যাত্মিক--- প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে৷ তবেই একটি মানুষকে ‘প্রকৃত মানুষ’ বলে গণ্য করা যায়৷ তবেই সে সমস্ত  মানুষরা  তাদের  নিজ নিজ জীবন তথা  সমাজকে  সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে৷ স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সেই জ্ঞানলাভের তপোভূমি৷ হ্যাঁ, জ্ঞানলাভ তপস্যারই  মত৷ আর শিক্ষার কেন্দ্রগুলিতে তপোবনের  মত সুস্থ সুন্দর  পরিবেশ থাকা  উচিত৷ 

মানুষ  উপযুক্ত শিক্ষালাভ  করে জ্ঞান অর্জন করে’ তারপর রাজনীতি করুক৷ সেটাই কাম্য৷ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সুস্থ শান্ত পরিবেশে  নিরপেক্ষভাবে জ্ঞানলাভের জায়গা, সেখানে যদি  দলীয় রাজনীতি  মত্ত হস্তীর  মত তাণ্ডব চালায়, তাহলে শিক্ষার পরিবেশ কিছুই থাকে না৷ যথার্থ বিচার বিবেচনা করার মত ছাত্র-ছাত্ররা পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন না  করেই বিভিন্ন দাদা-দিদিদের  অন্ধ অনুগামী হয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের  পরিবেশকে দূষিত করে৷  নবাগত বা নবাগতারা সেই  ধারাকে  অব্যাহত রাখে৷ স্বাভাবিকভাবে যা দেশের  পক্ষে  সর্বনাশের অশনি-সংকেত হয়ে দাঁড়ায়৷

বর্তমানে সারা দেশে এই রোগ ক্যানসারের মত ছড়িয়ে  গেছে৷ এটা যে দেশের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর তা দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা বা শিক্ষিত সমাজ কেউ উপলদ্ধি করতে পারছেন না ৷ অথবা উপলব্ধি করেও নিরুপায় হয়ে বা হতাশা হয়ে  হাতগুটিয়ে বসে আছেন৷ কই এই দিনের  আলোর মত সহজ  সত্যটা কেউ তো  জোরালোভাবে বলছেন না৷ দেশের  শিক্ষাবিদ্রা, বুদ্ধিজীবীরা, যারা সমাজের  ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, দেশের  শুভাকাঙ্ক্ষী ---তাদের উচিত  এ ব্যাপারে  মুখ খোলা, জনমত তৈরী করা৷ দেশের রাজনৈতিক নেতা- নেত্রীরা যদি  সত্যই দেশকে ভালবাসে তাহলে কেন তাঁরা  এই সহজ সত্যটাকে  মানতে চাইছেন না!

বর্তমান রাজনীতিতে  যে  নিয়ম-শৃঙ্খলা বর্জিত ক্ষমতা  দখলের লড়াই চলছে আর  তার জন্যে  যেভাবে  নীতিহীন, মানবতাহীন  কাণ্ড কারখানা চলছে --- তা কিন্তু  অতীতের  ভুলের পরিণতি৷  স্বাধীনতার  পর থেকে আমাদের নেতা-নেত্রীদের উচিত ছিল শত শত আত্মবলিদানের  ফলে যে স্বাধীনতা আমরা  অর্জন করেছি, সেই স্বাধীনতার মর্যাদা রাখতে সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতা ও সেবার ভাবনা নিয়ে দেশ সেবায়  প্রবৃত্ত হওয়া৷ তা না করে আমাদের দেশের অগ্রণী নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা  দখল ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখাটাকেই ধ্যান জ্ঞান করেছেন৷ আর সবাই তাদের ক্যাডার সংগ্রহের  জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন  কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে৷ এইসব শিক্ষাকেন্দ্রের কচি-কাঁচাদের মাথায় নিজেদের  গালভরা বুলি  ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের দলবৃদ্ধি করার  প্রতিযোগিতায় নেমেছে৷ তার পরিণতি আমরা সবাই দেখতে  পারছি ৷

আজ সমাজের  সর্বস্তরে  দলীয় রাজনীতির  অনুপ্রবেশ সমাজের  অবস্থাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে৷  সমাজের  সর্বস্তরে  যে ঐক্য ভালবাসা ছিল  দলীয় রাজনীতির ফলে সর্বত্রই তাতে প্রচণ্ড ধরণের ফাটল দেখা দিয়েছে ৷ বর্তমান যুগের  মহান্ দার্শনিক ‘প্রাউট’ দর্শনের  প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর  ‘আজকের  সমস্যা’ পুস্তকে  বলেছেন,  ‘‘মানবীয়  ঐক্যে যারা াধা দিচ্ছে  বা াধা দেবার চেষ্টা করে তাদের মধ্যে  দলীয়  রাজনীতি অন্যতম৷  বস্তুতঃ  এই দলীয় রাজনীতি  জিনিসটা  রোগজীবাণুর চাইতেও  ভয়ঙ্কর৷ এতে ধীরে ধীরে  মানব মনের সমস্ত সরলতা  তথা সেবাপরায়ণতা সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে ব্যষ্টির  যোগ্যতার  চাইতে দলীয় তক্মার  মর্যাদা বেশী, জনসেবা নয়--- আত্মসেবাই প্রধান  লক্ষ্য, কল্যাণ নয়--- মন্ত্রিত্বই  বড়, জনসাধারণকে ধোঁকা  দেওয়া, ডিগ্বাজী খাওয়া এগুলি খুবই  সাধারণ  জিনিস৷ জনসাধারণের দুর্বলতাগুলো  বুঝে বড় বড় বুলি কপচিয়ে জনসাধারণের একাংশকে  অন্য অংশের বিরুদ্ধে  লেলিয়ে দিয়ে  এরা রাষ্ট্রের  গদি  দখল করতে চায় বা কায়েম রাখতে চায়৷  মানুষকে  এদের  থেকে সতর্ক থাকতে হবে৷ সমাজজীবনে, ধর্মজীবনে, শিক্ষাক্ষেত্রে,সাহিত্যক্ষেত্রে  সর্বত্রই এরা  নাক গলাতে চায়৷’’

শিক্ষা সম্পর্কে প্রাউট- প্রবক্তা আরও বলেছেন ঃ ‘‘দলীয়  রাজনীতির  হাত থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে  সযত্নে মুক্ত  রাখা দরকার৷ শিক্ষা ব্যবস্থার  আর্থিক দায়িত্ব  রাষ্ট্রের কিন্তু  পঠন-পাঠন , পাঠ-রীতি তথা  পাঠ্য নির্বাচনের একচ্ছত্র অধিকার  শিক্ষাব্রতীদেরই থাকা উচিত৷’’