৪০ বছরে  নেলি গণহত্যা---বাঙালীর রক্তে ভেজা বিস্মৃত একটি দিন

লেখক
সাধন পুরকায়স্থ

যদিও বাঙালির চেতনায় ইংরাজি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখটি তার জাতিসত্ত্বার জন্যে চির স্মরণীয় হয়ে রয়েছে পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে---বর্তমান বাংলাদেশে---বাংলা ভাষার  জন্যে আন্দোলন করে পাকিস্তানী শাসকদের গুলিতে হত ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কারণে, সেই ফেব্রুয়ারী মাসের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আর রক্তে ভেজা দিন বাংলার স্মৃতিতে আজ আর নেই, কারণ ইতিহাস এই দিনটার কথা কে অনেক গভীরে কবর দিয়েছে৷ দিনটি ১৮ই ফেব্রুয়ারি৷ আজ থেকে ৪০ বছর আগে এই ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হয় দেশভাগ-পরবর্তী ভারতের  সব চেয়ে বড় আর কুখ্যাত বাঙালি গণহত্যা-অসমের নেলি গণহত্যা৷ সরকারি হিসেবে অসমের নেলি গণহত্যায় নগাঁও জেলার জাগ্গি রোড থানার অন্তর্গত নেলির ১৪টি গ্রামের ---আলীসিংহ, খুলাপাথর, বসুন্ধরী, বুগডুবা বিল, বাগডুবা হাবি, বড়জোলা, বুটুনি, ডোঙ্গাবাড়ি, ইঁদুর মারি, মাটি  পর্বত, মূলাধারী, মাটি পর্বত আট নম্বর, সিলভেটা, বড়বুড়ি আর নেলি-অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাসকারীকে হত্যা করা হয় ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩তে৷ যদি সরকারি হিসাবে সংখ্যাটা ২,১৯১, কিন্তু বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যাটা প্রায় ১০,০০০ যা ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা আর ২০০২ সালের গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার চেয়ে বহু বেশি৷ অথচ, আজ পর্যন্ত এই গণহত্যার ঘটনায় জড়িতরা কেউ শাস্তি তো পায়নি, বরং অসমের  বাঙালি-বিদ্বেষী মূলস্রোতের রাজনীতিতে তাদের চরম উন্নতি হয়েছে৷

অসমের নেলি গণহত্যা নিয়ে এককালে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল৷ কয়েক বছর আগে এই নেলি গণহত্যার পরে ভারত সরকারের সাথে অসম আন্দোলনের নেতৃত্বের চুক্তির ভিত্তিতে, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন,২০০৩ (সিএএ ২০০৩) অনুসারে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যখন ভারতীয় জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জী (এন.আর.সি) অভিযান অসমে চালানো হয় ও তার ফলে ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব হারান, তখন নেলির প্রসঙ্গ উঠে আসে৷

এককালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের হেমেন্দ্র নারায়ণ ও অসম ট্রিবিউন পত্রিকার বেদব্রত লহকার এই গণহত্যা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছিলেন, নানা তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছিল এই বিষয়ে৷ কিন্তু  যা অধরা থাকল তা হল এই গণহত্যার ঘটনার নিপীড়িত মানুষ ৪০ বছরেও ন্যায়ের মুখ দেখালেন না, বরং যে শক্তির প্ররোচনায় এককালে বাঙালি-বিরোধী অসম আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই শক্তি আজ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বাঙালি জাতির মধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ করে অসম ও ভারতের  কেন্দ্রে আজ ক্ষমতায় আসীন৷

নেলি গণহত্যা নিয়ে একটি ১৯৮৮ সালের প্রতিবেদন ঃ

কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার অসম প্রতিবেদক হয়ে তৎকালীন সময়ে সাংবাদিক অরূপচন্দ ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেলিতে যান ও সেখানে এই গণহত্যার ঘটনায় যে সব প্রত্যক্ষদর্শী তখনও বেঁচে ছিলেন তাঁদের কথা বলেন৷ তাঁর গ্রাউন্ড রিপোর্টটি ১২ই মার্চ ১৯৮৮-র স্যাটারডে ষ্টেটসম্যানে প্রকাশিত হয়৷

সেই প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীরা যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন তৎকালীন ভারতে তা অভূতপূর্ব ও নৃশংস শোনালেও ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা, ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধবংস ও তার পরে সারা দেশে মুসলিম নিধন যজ্ঞ, ২০০২ সালের গুজরাট মুসলিম গণহত্যা,২০০৮ সালের উড়িষ্যার খ্রিষ্টান গণহত্যা,২০১৩ সালের মুজ্জাফরনগর গণহত্যা বা ২০২০ সালের দিল্লীর মুসলিম গণহত্যার পরে অনেক গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে৷

অসমের সাথে খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরার পরে চন্দ নেলি নিয়ে যে তদন্ত করেন সেই  নিয়ে তিনি নানা কথোপকথনে পিপলস রিভিউ কে তাঁর অভিজ্ঞতা জানান৷ এই প্রবন্ধে আমরা চন্দের ১৯৮৮ সালের রিপোর্টটির ভিত্তিতেই সেই গণহত্যার ঘটনাটি কে ফিরে দেখার চেষ্টা করবো৷

নেলি গণহত্যার পাঁচ বছর পরের দ্য স্টেটম্যান এর রিপোর্ট

নেলি গণহত্যা কাণ্ডের পাঁচ বছর পরে অরূপ চন্দের সরেজমিনে তদন্তমূলক রিপোর্ট প্রকাশিত ১২ই মার্চ ১৯৮৮ এর দ্য স্যাটারডে স্টেটস্‌ম্যান এ---

স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই অসমে বাঙালি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগিয়ে তোলা হয়৷ যদিও নিম্ন অসম মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ঐক্যবদ্ধ বঙ্গের সিলেট জেলা কে কেটে বানিয়েছিল বাঙালি মুসলিম কৃষকদের দিয়ে সেই উর্বর অঞ্চল জুড়ে চাষাবাদ করিয়ে কর বাবদ ঔপনিবেশিক শাসনের আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, অসমের জাতীয়তাবাদের চোখে বাঙালি সম্প্রদায়ের অসমে থাকাটাই চক্ষুশূল হয়৷ বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের বারবার করে জাতি হিংসার ও সরকারি সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়৷ নেলির গণহত্যা অসমে গত শতাব্দীর  ছয়ের  দশক থেকে শুরু হওয়া ‘‘বঙ্গাল খেদাও’’ আন্দোলন ও সাতের দশকের অসম আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ফল ছিল৷ এই গণহত্যার মধ্যে দিয়েই অসম আন্দোলনের পুরোধা অখিল অসম ছাত্র ইয়ূনিয়ন (আসু) ভারত সরকারের সাথে অসমের  মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি সই করতে পারে৷

১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কংগ্রেস (আই) দলকে  অসম আন্দোলনকে বিরুদ্ধে দাঁড় করান, যদিও মাটিতে, তৃণমূল স্তরে, তাঁর দলের লোকেরা কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি৷ অসম আন্দোলন ক্রমাগত হিংস্র আর শক্তিশালী হয়ে ওঠে৷ যেহেতু  এই আন্দোলনের ফলে জনগণের  মধ্যেই জাতি-ভিত্তিক বিভাজন তীব্র হয়, তাই শ্রীমতি গান্ধী এই আন্দোলনকে দমন করার জন্যে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেননি, যদিও এর আগে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে শিখ সম্প্রদায়ের খালিস্তান আন্দোলন কে দমন করতে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে পিছপা হননি৷

১৯৮৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় আসু নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয়৷ তারা দাবি তোলে যে বাংলাদেশ থেকে আগত তথাকথিত ‘‘বেআইনি অধিবাসীদের’’ অধিবাসীদের নাম ভোটার তালিকার থেকে বাদ দেওয়ার৷ যেহেতু আসুর চোখে সমস্ত বাঙালিই প্রায় বেআইনি অধিবাসী তাই তাদের  চোখে বাঙালি মুসলিম হিসাবে চিহ্ণিত ছিলেন৷ বার বার করে অসম আন্দোলনের নেতৃত্ব নেলির জনগণকে নির্বাচন বয়কট করার হুমকি দেয়, তবে সেখানকার সাধারণ মানুষ সেই দাবি মানতে অস্বীকার করেন৷